ভুয়া ব্যাংক খুলে চাকরির নামে ভারতে যেভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিল প্রতারক চক্র
কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের পুলিশ জানতে পারে যে, দেশটির ছত্তিশগড় রাজ্যের একটি গ্রামে প্রতারক চক্র লোগো, অফিসের আসবাবপত্র ও এমনকি কিছু কর্মচারীসহ ব্যাংকের একটি ভুয়া শাখা স্থাপন করেছে। বিবিসি হিন্দির পক্ষ থেকে বিষয়টি জানার চেষ্টা করা হয়।
জ্যোতি যাদব তার গ্রামের কাছে সম্প্রতি চালু করা একটি ব্যাংকের শাখায় অফিস সহকারী হিসাবে চাকরি পেয়ে বেশ আনন্দিত ছিলেন। ক্রমশ বাড়তে থাকা আর্থিক চাপের মুখে তিনি চার বছর ধরে চাকরি খুঁজছিলেন।
ব্যাংকের কর্মকর্তারা জ্যোতিকে অবিলম্বে চাকরিতে যোগদান করতে বলেছিলেন। তিনি এতে রাজিও হয়ে যান। কেননা ব্যাংকটি ছিল সরকার পরিচালিত দেশের বৃহত্তম ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই)।
কিন্তু জ্যোতির যোগদানের মাত্র এক সপ্তাহ পরে এসবিআই-এর নিকটবর্তী শাখার পুলিশ ও অফিসাররা ব্যাংকটিতে অভিযান চালায়। ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুর থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে এসে জানায়, তাদের ব্যাংকটি ভুয়া।
এমনটা জেনে জ্যোতি যেন কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়েন। কেননা চাকরির ক্ষেত্রে তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড দেওয়া হয়েছে৷ একইসাথে ৩০ হাজার রুপি বেতনের কথাও বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে অন্য আরও পাঁচজনের সাথে তিনি চাকরিতে যোগদান করেন৷
এই ঘটনায় পুলিশ ইতোমধ্যেই একজনকে গ্রেফতার করেছে। একইসাথে আরও আট জনকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছে।
চাকরির কথা বলে কেলেঙ্কারির ঘটনা ভারতে নতুন নয়। কেননা দেশটিতে কোটি কোটি তরুণ একটি নির্ভরযোগ্য চাকরি খোঁজার জন্য মরিয়া। ২০২২ সালে প্রায় দুই ডজনেরও বেশি মানুষকে রেলে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণায় ফেলা হয়।
বিশেষ করে ভারতের ছোট ছোট শহর ও গ্রামে চাকরির সংকট বেশ তীব্র। সেখানে কাজের সুযোগ সীমিত থাকায় চাকরি পেতে প্রায়ই তরুণেরা ঘুষ দিয়ে চাকরি দেওয়ার মতো ঝুঁকি নিতে বাধ্য হয়৷ কেননা এতে করে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে পারবে বলে মনে করেন।
পুলিশ জানিয়েছে যে, ভুয়া ব্যাংকটির ছয়জন কর্মচারী আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চাকরির জন্য ঘুষ হিসাবে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করেছিলেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বিবিসি হিন্দিকে জানান, মূল উদ্দেশ্য ছিল চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে প্রতারণা করা।
প্রাথমিক তদন্ত থেকে জানা যায়, বিপুল সংখ্যক লোকের কাছে চাকরির নিশ্চয়তার দেওয়ার অজুহাতে অর্থ চাওয়া হয়েছিল। এমনকি প্রশিক্ষণের জন্য ভুয়া আরেকটি ব্রাঞ্চে তাদের পাঠানোও হয়েছিল।
সেখানে প্রায় দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে চাকরিপ্রত্যাশীদের বলা হয়, তাদেরকে খুব শীঘ্রই এসবির ব্রাঞ্চে নিয়োগ দেওয়া হবে। যারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন তারা বলছেন, প্রতারকরা ব্যাংকটিকে একেবারে আসলের মতো করে তুলে ধরেছিলেন।
যাদব বলেছেন যে, তিনি একটি অনলাইন ফর্ম পূরণ করেছেন। যেখানে তার শিক্ষাগত সার্টিফিকেট আপলোড করেছেন এবং অনবোর্ডিং প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে বায়োমেট্রিক তথ্য জমা দিয়েছেন। বহু ভারতীয় সংস্থায় যোগদানের সময়ই এমনটা করা হয়।
যাদব বলেন, "আমি এক মুহূর্তের জন্যও অনুভব করিনি যে, আমি প্রতারণার শিকার হয়েছি। কিন্তু এখন সবই তছনছ হয়ে গেছে।"
যাদব জানান, তিনি আড়াই লাখ রুপি ঘুষ হিসেবে দিয়েছিলেন। এই অর্থ সংগ্রহ করতে তাকে বেশ অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
পার্শ্ববর্তী জেলার একটি গ্রামের রোহিনী সাহুকে ভুয়া চাকরিদাতারা মার্কেটিং অফিসার হিসেবে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিল।
সাহু বিবিসি হিন্দিকে বলেছেন যে, তার অফার লেটারে এসবিআই-এর রায়পুর শাখায় নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল। তবে এর আগে তাকে এই শাখায় প্রশিক্ষণ নিতে হবে। চিঠি, সাইনবোর্ড, বিল্ডিং ও অবকাঠামো দেখে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, এটি একটি আসল ব্যাংক।
সাহু বলেন, "কেউ এটা দুঃস্বপ্নেও ভাবেন নাই যে, এটি একটা বৈধ ব্যাংক না।"
এদিকে যে গ্রামে শাখাটি ছিল সেখানকার বাসিন্দারা জানান, এটি চালুর সময় তারা ব্যাংকিং পরিষেবাগুলি সহজে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে খুশি হয়েছিল।
কিন্তু গ্রামবাসীদের মধ্যে যারা অ্যাকাউন্ট খুলতে চেয়েছিলেন তাদের বলা হয়েছিল যে, এখনও ব্যাংক সার্ভার ইনস্টলের কাজ চলছে। তাদের পরের মাসে আসতে হবে।
কেউ কেউ ব্রাঞ্চটির কারণে ব্যবসার নতুন সুযোগ খুঁজছিলেন। ঠিক তেমনি একজন অজয় আগারওয়াল। তিনি অবিলম্বে ব্যাংকের বাইরে সীমিত পরিসরে নানা সুবিধা দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ও আবেদন করেছিলেন।
কিন্তু অজয়ের আবেদন মঞ্জুর না হওয়ায় শীঘ্রই তার সন্দেহ তৈরি হয়। এক্ষেত্রে তিনি শাখাটি সম্পর্কে জানতে নিকটবর্তী এসবিআই শাখায় যান।
এই খবর জানতে পেরে পুলিশ অনতিবিলম্বে ভুয়া ব্যাংকটিতে অভিযান চালান। কিন্তু ততক্ষণে ব্যাংকটির তথাকথিত ম্যানেজার পালিয়ে যায়।
যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তিনি চাকরি সংক্রান্ত আরেকটি জালিয়াতির সাথে যুক্ত। তবে সে এখনো পর্যন্ত পুলিশের কাছে কোনো জবানবন্দি দেয়নি।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান