ট্রাম্পকে মোকাবিলার উপায় খুঁজতে বুদাপেস্টে ইইউ নেতারা
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অধিকাংশ সদস্য দেশসহ ইউরোপের নেতাদের বড় একটি দল উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠকে অংশ নিতে বুদাপেস্টে একত্রিত হয়েছেন।
উচ্চপর্যায়ের এই বৈঠকে মূলত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করা হবে: ট্রাম্পকে কীভাবে মোকাবিলা করব?
ব্রাসেলস থেকে শুরু করে ওয়ারশ পর্যন্ত ইউরোপীয় দেশগুলো ট্রাম্পের বিজয়ের পর এখন ভাবছে, তার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সি ইউরোপের জন্য কী তাৎপর্য বয়ে আনবে? ইউরোপের অনেক দেশ ইতোমধ্যেই নানা অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার মধ্যে একটি হলো, যুক্তরাষ্ট্রে আসা সব বিদেশি পণ্যের ওপর ট্যারিফ আরোপ করা। যদি এই পরিকল্পনা কার্যকর হয়, তাহলে ইউরোপের রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতির জন্য সেটি বিশাল ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এছাড়া, চীনবিরোধী কঠোর নীতির ফলে ইউরোপে বেইজিং-এর বাণিজ্য প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় চীন বাজারে নতুন করে সস্তা পণ্য নিয়ে আসতে পারে। এটি বাজারে চলমান প্রতিযোগিতাকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিনি দেশীয় জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পকে সমর্থন করবেন, প্যারিস চুক্তি থেকে (পুনরায়) বেরিয়ে যাবেন এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার প্রচেষ্টা ব্যাহত করবেন।
তবে, ইউরোপীয় নেতাদের জন্য ইউক্রেন এবং ন্যাটো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে আসবে।
ট্রাম্প স্পষ্টভাবে হুমকি দিয়ে বলেছেন, তিনি ইউক্রেনকে দেয়া ওয়াশিংটনের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পুনঃবিবেচনা করতে পারেন বা তা বন্ধ করে দিতে পারেন। তিনি আরও বলেছেন, ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলো প্রতিরক্ষা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে তিনি রাশিয়াকে দেশগুলোর সাথে "যা খুশি" তা করতে "উৎসাহিত" করবেন।
ট্রাম্প "২৪ ঘণ্টার মধ্যে" ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ করতে চুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ফলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তিনি রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে কিয়েভের ওপর ক্ষতিকর 'আঞ্চলিক আপস' চাপিয়ে দিতে পারেন।
প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প তার বিদেশ নীতিতে একটি "ব্যবসায়িক" দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন। এই নীতির ফলে, দীর্ঘদিনের মার্কিন নীতির পরিবর্তে শুধু লাভ-ক্ষতির ওপর ভিত্তি করে কূটনৈতিক সম্পর্ক মূল্যায়িত হয়েছিল।
এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, কারণ তারা নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
এই অনিশ্চিত পরিস্থিতির কারণে ইউরোপীয় কমিশন বিভিন্ন নির্বাচনী ফলাফলের জন্য প্রস্তুতি নিতে একটি বিশেষ কর্মদল গঠন করেছে।
তবে ট্রাম্পের অনিশ্চিত আচরণ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। কোনো ইউরোপীয় দেশ বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আগাম পরিকল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবুও, ইউরোপীয় ইউনিয়ন দৃঢ়ভাবে তাদের মূল্যবোধ রক্ষা করতে এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে প্রস্তুত।
বুদাপেস্টে বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) এবং শুক্রবার (৮ নভেম্বর) শুরু হতে যাওয়া একাধিক বৈঠকে ইউরোপীয় নেতারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। এর মধ্যে রয়েছে– অভিবাসন, অর্থনীতি এবং নিরাপত্তা।
প্রথম আলোচ্য বিষয়গু হবে, ইউরোপীয় রাজনৈতিক সম্প্রদায় (ইপিসি)। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর ইপিসি প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই সম্মেলনে ইউক্রেন, মলদোভা, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক এবং পশ্চিম বলকানসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতা অংশগ্রহণ করবেন। তবে, কতজন সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান বৈঠকে উপস্থিত হবেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে পূর্ববর্তী ইপিসি বৈঠকে প্রায় ৪০ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সাঞ্চেজ উপস্থিত থাকবেন না, কারণ তিনি ভ্যালেন্সিয়া অঞ্চলে প্রলয়ংকরী বৃষ্টিপাতের প্রভাবে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যস্ত। আয়ারল্যান্ড, স্লোভেনিয়া এবং আইসল্যান্ড এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন এবং তার "ভিক্টরি প্ল্যান" এগিয়ে নিতে আরো অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তার জন্য মিত্রদের প্রতি আবেদন জানাবেন।
ট্রাম্পের বিজয়ের পর এই অনুরোধ আরও জরুরি হয়ে উঠতে পারে। তবে বৈঠকের আয়োজক এবং হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান এই সামরিক সহায়তাকে "যুদ্ধপ্রেমী অ্যাজেন্ডা" হিসেবে উপেক্ষা করেছেন।
ইপিসি বৈঠকের পর অরবান ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের জন্য একটি ডিনার আয়োজন করবেন। সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ভবিষ্যৎ এবং জর্জিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হবে।
অরবান ট্রাম্পের প্রতি ইতোমধ্যেই গভীর প্রশংসা জানিয়েছেন এবং বিশ্বাস করেন, ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন ব্রাসেল-এ দেশটির বিরোধী অবস্থানকে সঠিক প্রমাণ করতে সহায়ক হবে।
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান বলেন, "বছরের শেষে পশ্চিমা বিশ্বের শান্তির পক্ষে থাকা নেতারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবেন এবং যুদ্ধপন্থীদের পরাজিত করা সম্ভব হবে বলে আমরা আশা করছি। তিনি আরও বলেন, "ট্রাম্পের জয় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং হাঙ্গেরি-আমেরিকা সম্পর্ককে আবার সোনালি যুগে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে সহায়ক হতে পারে।"
স্লোভাকিয়ার রবার্ট ফিকো এবং ইতালির জর্জিয়া মেলোনির মতো কয়েকজন শীর্ষ নেতা আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে সরাসরি যুক্ত হওয়ার সুযোগকে স্বাগত জানাতে পারেন।
শুক্রবার ইইউ নেতারা এক অনানুষ্ঠানিক সম্মেলনে একত্রিত হয়ে "নতুন ইউরোপীয় প্রতিযোগিতামূলক চুক্তি" নিয়ে আলোচনা করবেন। ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি তার প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করেন। দ্রাঘি এবং ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লেগার্ডও সম্মেলনে অংশ নেবেন।