সিরিয়ার বিদ্রোহী নতুন নেতৃত্বের সাথে রাশিয়ার গোপনে মধ্যস্থতা চলছে
সিরিয়ার পশ্চিমে হুমাইমিম বিমান ঘাঁটির প্রবেশদ্বারে রয়েছে ভ্লাদিমির পুতিনের একটি প্রতিকৃতি। এই ঘাঁটিতে এখনো অবস্থান ধরে রেখেছে দেশটির ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের মিত্র রুশ বাহিনী। সাম্প্রতিক পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে সিরিয়ার নানা প্রান্ত থেকে সৈন্য ও যানবাহন সরিয়ে নিয়ে এই বিমান ঘাঁটিতে একত্রিত করছে মস্কো।
হুমাইমিম বিমান ঘাঁটি হয়েই দামেস্ক পতনের মুখে আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে এই স্বৈরশাসকের পতনের পর দেশটিতে রুশ বাহিনীর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনেকেই ধারণা করছেন, বিদ্রোহীদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) দেশটি থেকে রুশ সৈন্যদের হয়তো বিতাড়িত করবে। তবে ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে দুই পক্ষ বরং নিজেদের মধ্যে মধ্যস্থতা শুরু করেছে।
মধ্যস্থতার সাথে যুক্ত এইচটিএসের এক সূত্র জানায়, রাশিয়ার সাথে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বিষয়ে গোষ্ঠীটি বাস্তববাদী চিন্তা করছে। সেক্ষেত্রে তারা সম্ভবত রাশিয়াকে তার কিছু বা সমস্ত ঘাঁটি রাখারই অনুমতি দেবে। একইসাথে আসাদ রেজিমের সময় হুমাইমিমের প্রায় ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে তারতুস বন্দরে রাশিয়াকে ইজারা দেওয়ার চুক্তিটিও হয়তো রক্ষা করবে। এতে করে মস্কো আগের মতোই ভূমধ্যসাগরে নিজেদের নানা সুবিধাজনক অবস্থান বজায় রাখতে পারবে। অন্যদিকে আসাদকে ফিরিয়ে আনা যে অনেকটা অসম্ভব; সেটাও বিদ্রোহী গোষ্ঠীরা উপলব্ধি করতে পারছেন।
সূত্র জানায়, "অসম্ভব কিছুই নয়। সবকিছুই হবে সুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখে; আদর্শভিত্তিক নয়।"
২০১৫ সালে পুতিনের নেতৃত্বে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছিল রাশিয়া। এতে করে সেই সময়ে প্রায় ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যাওয়া আসাদ রেজিম মস্কোর সহযোগিতায় টিকে যায়। যার বিনিময়ে দেশটিতে বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি লুফে নেয় ক্রেমলিন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘাঁটি হচ্ছে হোমসের টি৪ ঘাঁটি ও হুমাইমিমের বিমান ঘাঁটি। এমনকি ২০১৭ সালে সিরিয়ার তারতুস বন্দর ৪৯ বছরের জন্য লিজ নেয় রাশিয়া। যদিও ১৯৭০-এর দশক থেকেই সেখানে নিজেদের উপস্থিতি জারি রেখেছিল মস্কো।
গত এক দশকে রুশ বিমান বাহিনী বিদ্রোহীদের দমন করতে বহু অভিযান চালিয়েছে। আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। সেক্ষেত্রে তীব্র প্রতিরোধে পালানোর জন্য এই স্বৈরশাসকের রাশিয়া ছাড়া অন্য কোথাও জায়গা ছিল না। এমনকি আসাদ ছাড়াও তার আত্মীয় থেকে শুরু করে রেজিমের সহযোগী অনেককেই বিমানে করে পালানোর সুযোগ করে আশ্রয় দিয়েছে মস্কো।
গত সোমবার পালিয়ে যাওয়ার পর প্রথম বিবৃতি প্রকাশ করেন ক্ষমতাচ্যুত আসাদ। সেখানে তিনি হুমাইমিম বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে রাশিয়ার সহযোগিতায় মস্কো আশ্রয় গ্রহণের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
সম্প্রতি দেশটিতে থাকা রুশ বাহিনী বিজয়ী গোষ্ঠী এইটিএসের সাথে যোগাযোগ করতে বাধ্য হচ্ছে। যদিও কিছুদিন আগেও পুতিন প্রশাসন তাদের 'সন্ত্রাসী গোষ্ঠী' হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছিল।
রাশিয়ার ঘাঁটিগুলো সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীরা ঘেরাও করে রেখেছে। এক এইচটিএস সদস্য জানায়, রুশ সৈন্যরা খাবার ও পানির তীব্র সংকটে রয়েছে। ঘাঁটিতে ময়লা-আবর্জনা বাড়ছে। তবে রুশ বাহিনীকে টি৪ বিমান ঘাঁটি খালি করে হুমাইমিমে একত্রিত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীরা।
হুমাইমিম অঞ্চলে নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও রুশ নাগরিকদের দেখা যায়। সেখানে সৈন্যরা ক্যাফে কিংবা ফার্মেসির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থ হিসেবে রুবল ব্যবহার করেন। এক দশক ধরে আসাদকে টিকিয়ে রাখতে বহু মানুষ হত্যা করলেও সেখানে বেশ নিরাপদেই ছিলেন রুশ সৈন্যরা। এতে করে তাদের ওপর এখন বহু সিরিয়ান নাগরিক নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
বিমান ঘাঁটির বাইরে পাহারায় থাকা এক এইচটিএস সদস্য বলেন, "রাশিয়া একটি সন্ত্রাসী দেশ। আমি আশা করছি তারা এখান থেকে চলে যাবে।"
অন্যদিকে রাশিয়া পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, তারতুস বন্দর ও হুমাইমিম বিমান ঘাঁটিতে অবস্থানের সুবিধা অব্যাহত রাখা হলে তারা সিরিয়াকে মানবিক সহায়তা দেবে। কিন্তু সিরিয়ার নতুন নেতৃত্ব শুধু এতেই সন্তুষ্ট নয়। বরং তারা মস্কোর সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক চায়। অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে থাকা ইউক্রেন দামেস্ককে গম পাঠাতে চায়।
সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বকে সামনে বেশ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এইচটিএস এক সদস্য জানায়, তারা বৈশ্বিক নানা পরাশক্তির সাথে সমতা রক্ষা করে চলতে চাচ্ছে। কোনো একক শক্তির ওপর ভর করতে চাইছে না। তবে এটাও সত্য যে, তাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রয়োজন। এক্ষেত্রে এইচটিএস সদস্যরা নিজেদের অবস্থা যাতে আফগানিস্তানের তালেবানদের মতো বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী না হয় সেদিকে খেয়াল রাখছেন।
বহু নির্মম ঘটনার পেছনে রুশ বাহিনী দায়ী থাকলেও এইচটিএসের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ না নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। একইসাথে দেশটি থেকে যে রাশিয়া একদম গুটিয়ে চলে যাবে এমনটাও মনে হচ্ছে না। এখন যারাই যে প্রস্তাব দেবে; মস্কো সেটি গ্রহণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এক কর্মকর্তা বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, "আমরা মধ্যস্থতার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। রক্তপাত বন্ধের চেষ্টা করছি। মানুষ একটি নতুন জীবন গড়তে চায়। তাই আমাদের সম্পর্ক পুনরায় ঠিক করতে হবে। দেশ এখন মৃত্যুপুরী; মানুষ বেশ দারিদ্রতার মধ্যে রয়েছে।"
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান