বিখ্যাত মোটর কোম্পানি নিসান যে কারণে পতনের মুখে
জাপানি গাড়ি নির্মাতা নিসান গুরুতর আর্থিক সংকটে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি জানিয়েছে, তারা বর্তমানে "জরুরি অবস্থায়" প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতে বিক্রি কমার কারণে নিসান বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। ফলে কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শীর্ষ কর্মকর্তার দাবি অনুযায়ী, নিসান আগামী ১২ মাসের মধ্যে বড় ধসের সম্মুখীন হতে পারে।
ব্লুমবার্গের তথ্যমতে, এই শঙ্কার মূল কারণ ২০২৬ সালে নিসানের বন্ড ম্যাচুরিটি, যেখানে প্রতিষ্ঠানটির ৫.৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এটি নিসানের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ঋণ।
এছাড়া, ২০২৫ সালে আরও ১.৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
তবে ব্লুমবার্গকে দেওয়া বিবৃতিতে নিসান জানিয়েছে, আসন্ন ঋণ পরিশোধের জন্য তাদের কাছে পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে এবং তারা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত।
১৯১৪ সালে প্রথম গাড়ি তৈরি করা নিসান এখন তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে রয়েছে।
১৯৯৯ সালে যখন রেনল্ট-নিসান অ্যালায়েন্স গঠিত হয়, তখন নিসান বিশাল ঋণের বোঝায় জর্জরিত ছিল। এই সংকট কাটাতে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী ২১ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছিল, যা তাদের মোট কর্মশক্তির ১৪ শতাংশ ছিল।
তবে এই কঠিন সিদ্ধান্তের ফলে নিসান এক বছরের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ায় এবং রেনল্টের বার্ষিক নিট মুনাফার অর্ধেক অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
তৎকালীন রেনল্ট ও নিসানের প্রধান কার্লোস ঘোন এই সফলতার মূল স্থপতি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তবে ২০১৮ সালে ঘোন কোম্পানির তহবিল অপব্যবহারের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানার মুখোমুখি হন এবং জাপান থেকে পালিয়ে যান।
২০২৪ সালে বিশ্বের দুটি বৃহত্তম গাড়ির বাজার চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রে নিসানের বিক্রি প্রত্যাশার চেয়ে কম ছিল। এর ফলে নিসানের মুনাফা ৩০৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এই সংকট মোকাবিলায় ৯ হাজার কর্মী ছাঁটাই এবং মিতসুবিশি-তে তাদের মালিকানা অংশ কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে সবকিছুই নিসানের হতাশাজনক নয়। যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয়ভাবে তৈরি নিসান রোগ বিক্রিতে শীর্ষ দশের তালিকায় নবম স্থানে রয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ মডেলটি প্রায় ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৫৬ ইউনিট বিক্রি হয়েছে।
২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রে নিসানের বিক্রি ২.২ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী টয়োটার এবং কিয়ার বিক্রি যথাক্রমে ৮ শতাংশ ও ৬ শতাংশ কমেছে। জেনারেল মোটরস-এর (জিএম) বিক্রি কমেছে ১.৯ শতাংশ।
তবে ফোর্ড ০.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে আর স্টেলান্টিস ২০ শতাংশ পতনের শিকার হয়েছে।
নিসান গ্রুপের যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি ০.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে বাজারের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ছিল ০.৭ শতাংশ।
নিসানের যুক্তরাষ্ট্র প্রধান জানান, হাইব্রিড গাড়ির বিকাশের সুযোগ কাজে লাগানোর মতো সঠিক মডেল লাইন আপ তাদের নেই। নিসানের 'ই-পাওয়ার' হাইব্রিড যুক্তরাষ্ট্রে আসতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে।
নিসানের বিক্রিতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে চীনের বাজার থেকে। বছরভিত্তিক তুলনায় কোম্পানির বিক্রি ১৪.৩ শতাংশ কমে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে শুল্ক-সংক্রান্ত আলোচনা চলছে, যা চীনের বাজারে আরও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তবে চীনে বিক্রিতে সমস্যা থাকা সত্ত্বেও, যুক্তরাষ্ট্রে নিসানের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। দেশটিতে তাদের পাঁচটি ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট ছাড়াও গবেষণা ও ডিজাইন কেন্দ্র রয়েছে।
ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে চীনের বাজারে জাপানি গাড়ি নির্মাতারা বিক্রিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন। চীনা ব্র্যান্ডগুলোর কাছে তারা ৮.৮ শতাংশ বাজার শেয়ার হারিয়েছেন। এটি একটি উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যান, কারণ চীনে প্রতি বছর প্রায় ৩ কোটি নতুন গাড়ি বিক্রি হয়।
চীনের গাড়ি রপ্তানি শিল্পের বিশ্বব্যাপী প্রসারের ফলে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রি কমছে, আর সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মতো অন্যান্য দেশেও।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে নিসান চীনের দশম সর্বাধিক বিক্রি হওয়া ব্র্যান্ড হিসেবে অবস্থান ধরে রেখেছে। ডংফেং-এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত নিসান চীনে টিকে থাকলেও জাপানি ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে তালিকায় রয়েছে কেবল টয়োটা (তৃতীয়) এবং হোন্ডা (চতুর্থ)।
কারনিউজচায়না.কম-এর তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের প্রথম নয় মাসে নিসানের বিক্রি সবচেয়ে বেশি কমেছে (২৬.১ শতাংশ)। হোন্ডার বিক্রি কমেছে ২০.১ শতাংশ আর টয়োটা তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় ছিল। তবে তাদের বিক্রি কমেছে মাত্র ৪.১ শতাংশ।
তবুও নিসানের ছোট গাড়ি সিলফি চীনের চতুর্থ সর্বাধিক বিক্রি হওয়া মডেল হিসেবে জায়গা ধরে রেখেছে। টেসলা মডেল ওয়াই এবং বিওয়াইডি-এর কিন প্লাস সেডান ও সং প্লাস এসইউভি-র পর এই গাড়িটির অবস্থান। যদিও সিলফির বিক্রিও ২২.১ শতাংশ কমেছে।
নিসান সিলফির বাজার শেয়ার মাত্র ১.৬ শতাংশ হলেও, টেসলা মডেল ওয়াই-এর শীর্ষস্থানীয় শেয়ারও ২.১ শতাংশ। টেসলার বিক্রি ৩ লাখ ২০ হাজার ১৯ ইউনিট, যেখানে নিসান সিলফি বিক্রি করেছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৩৮০ ইউনিট।
ইউরোপে নিসানের বিক্রি ২০২৪ সালে ০.৮ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে ইউরোপীয় গাড়ি নির্মাতাদের সংগঠন ইউরোপীয় অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (এসিইএ) জানিয়েছে, এই অঞ্চলের গাড়ি বিক্রি ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬.১ শতাংশ কমেছে।
যুক্তরাজ্যে নিসানের কাশকাই ও জুক এসইউভি যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। কাশকাই ধারাবাহিকভাবে শীর্ষ তিনে থাকছে এবং ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় গাড়ি ছিল। অক্টোবরে নিসানের বিক্রি ১৫.৮ শতাংশ বেড়ে ৮৬ হাজার ৩৫৩ ইউনিটে পৌঁছেছে, যা টয়োটা থেকে মাত্র ৫০০ ইউনিট পিছিয়ে।
অস্ট্রেলিয়ায় নিসানের বিক্রি অক্টোবর পর্যন্ত ১৬.২ শতাংশ বেড়ে নবম স্থানে রয়েছে। পেট্রোল এসইউভি রেকর্ড পরিমাণে বিক্রি করেছে এবং জুকের নতুন সংস্করণ বিক্রিতে ৫৮.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।
নিসানের নতুন 'দ্য আর্ক' পরিকল্পনায় ২৭টি বৈদ্যুতিক মডেল উন্মোচনের লক্ষ্য রয়েছে, যার মধ্যে ১৯টি হবে ব্যাটারি-চালিত। একইসঙ্গে ছোট মডেলগুলোতে ই-পাওয়ার হাইব্রিড প্রযুক্তি যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে কিছু দেরি হতে পারে।
নিসান প্রেসিডেন্ট ও সিইও মাকোতো উচিদা বলেছেন, "গাড়ি শিল্পে আমাদের পরিকল্পনা, উন্নয়ন, উৎপাদন ও বিক্রির পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। 'নিসান নেক্সট' পরিকল্পনায় অগ্রগতি হলেও, রূপান্তর যথেষ্ট ছিল না।"
২০২৭ সালের শুরুর দিকে অস্ট্রেলিয়ার বাজারে নতুন নিসান নাভারা ও নিসান লিফ ইলেকট্রিক হ্যাচব্যাক আসবে। ২০২৬ সালের শেষে ডান-হাতি চালিত নতুন ওয়াই৬৩ পেট্রোল এসইউভি প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ায় উন্মোচিত হবে।
নিসান স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত পেট্রোল ও নাভারা ওয়ারিয়র মডেলগুলো পরবর্তী প্রজন্মেও যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে।