জিমি কার্টার: এক দুর্ভাগা প্রেসিডেন্ট, সৌভাগ্যবান মানুষ
আজকের বেশিরভাগ আমেরিকান জিমি কার্টারকে একজন বয়স্ক সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবেই জানেন, যিনি কেবল কোনো রোগের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কিংবা কাউকে ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার মতো কাজের জন্য সংবাদের শিরোনাম হতেন। তার প্রেসিডেন্টের সময়কালকে ১৯৭০ এর দশকের বিভিন্ন সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
বর্তমানে বহু আমেরিকান রয়েছেন, যাদের জন্ম ১৯৮১ সালে জিমি কার্টারের প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর। এছাড়াও প্রায় এক-পঞ্চমাংশ আমেরিকান ভোটার থাকতে পারেন, যারা কার্টারকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হতে এবং তার প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হতে দেখেছেন।
কার্টারের দীর্ঘ জীবনের বিভিন্ন সময়ে তার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দার সময়ে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেওয়া শিশু হিসেবে তার ব্যক্তিত্ব, হাইমান রিকওভারের নেতৃত্বে তৎকালীন আধুনিক পারমাণবিক সাবমেরিন বাহিনীতে কাজ করা প্রতিভাবান নেভাল একাডেমি গ্র্যাজুয়েট হিসেবে ব্যক্তিত্ব, একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে এবং প্রেসিডেন্ট পরবর্তী আধুনিক জীবনধারার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে।
এ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে একটি বিষয় স্পষ্ট যে বয়স্ক কিংবা যৌবনকালই বলা হোক, আর শক্তিশালী কিংবা দুর্বল অবস্থার কথাই বলা হোক না কেন, কার্টার সবসময় একই রকম ছিলেন।
কার্টারের ভূমিকা যাই থাকুক, বাইরের মানুষই বা তাকে যেভাবে মূল্যায়ন করুক, ভাগ্য তার পক্ষে ছিল কি না, সব ক্ষেত্রেই কার্টারকে কখনোই ভিন্ন কেউ মনে হয়নি।
সব ক্ষেত্রেই কার্টার ছিলেন আত্মনিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ। তিনি রসিকতা পছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং রাজনৈতিক দিক থেকে বেশ কৌশলী। বিষয়টি এমন যে ভাগ্য ও পরিস্থিতি বদলেছে ঠিকই, কিন্তু কার্টার বদলাননি।
কার্টার নিজ হাতে তার ভাগ্য গড়েছেন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ভাগ্য তার সহায় ছিল। নিজস্ব শৃঙ্খলা, প্রতিশ্রুতি ও কৌশল ছাড়া এটি তিনি কখনও করতে পারতেন না।
তিনি আইওয়া অঙ্গরাজ্যের প্রত্যেক মানুষের দ্বারে গিয়েছেন। তার দলই প্রথম বুঝতে পেরেছিল যে নতুন আইওয়া ককাস বাইরের কোনো প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ করে দিয়েছে।
প্রথম জীবনে জিমি কার্টার ছিলেন একজন চীনাবাদাম বিক্রেতা। তিনি তার বাড়িতে চীনাবাদামের চাষ করতেন। পরে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
এটি ছিল এমন এক সময়ে যখন কার্টারের জাতীয় পরিচিতি ছিল মাত্র ১ শতাংশ। তিনি সারাদিন ধরে অচেনা মানুষদের কাছে যেতেন এবং তাদের বলতেন, 'আমি জিমি কার্টার, আমি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী।'
কার্টার অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মিশেছেন এবং আইওয়ার ছোট ছোট বহু সভায় অংশ নিয়ে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছেন। এ কারণে তিনি ককাসে জয় পান এবং মনোনয়ন পেয়ে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেন।
একজন ডেমোক্র্যাট হিসেবে ১৯৭৬ সালে রিপাবলিকান জেরাল্ড ফোর্ডকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। এর আগে কখনোই তার মতো অপরিচিতি কোনো প্রার্থী হোয়াইট হাউসের দৌড়ে জয়ী হননি। কার্টার ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট।
এভাবেই কার্টার ও তার দল নিজেরাই নিজেদের সাহায্য করেছিলেন। যদিও আরও কিছু বিষয় বা ঘটনা তাদের জয়ে ভূমিকা রেখেছিল, তবে এ বিষয়গুলো নিয়ে তাদের কখনোই পরিকল্পনা ছিল না।
কার্টার ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। এখানেও কাজে-কর্মে অত্যন্ত শৃঙ্খলা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও বুদ্ধিমত্তার ছাপ রেখেছেন তিনি।
কার্টারকে এমন এক যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার নিতে হয়েছিল, যে সময় দেশটি বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত ছিল। যেমন- জ্বালানি সংকট, মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদি।
এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও প্রথম বছরে কার্টার তার পরে আসা বেশিরভাগ প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছিলেন, কেবল বুশ পরিবারের দুই প্রেসিডেন্ট ব্যতীত, যারা যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থায় বেশি সমর্থন পেয়েছিলেন।
অনেকের মতে, কার্টার সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানকে ভালোভাবেই পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসতে পারতেন, যদি ইরানে "ডেজার্ট ওয়ান" উদ্ধার অভিযানে আরেকটি হেলিকপ্টার পাঠানো হতো, কিংবা পাঠানো হেলিকপ্টারগুলোর মধ্যে কম হেলিকপ্টার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হতো।
অথবা যদি না কার্টারের নিজ দল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য টেডি কেনেডি তার বিরুদ্ধে প্রার্থী হতেন, কিংবা যদি না জন অ্যান্ডারসন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ না নিতেন। এমন অনেক প্রশ্নই এখন উঠছে যে যদি এটি না হতো তাহলে কি হতো?
কার্টার বছরের পর বছর ধরে দাবি করে এসেছেন যে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার কাছাকাছি ছিলেন, যদি না ইরানের সেই অভিযান ব্যর্থ হতো। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা উভয় ক্ষেত্রেই প্রচেষ্টা ও ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল কার্টারের।
৯৮ বছর বয়স পর্যন্ত সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রেও ভাগ্য পাশে ছিল কার্টারের। তিনি তার প্রিয় স্ত্রী রোজালিনের সঙ্গে ৭৬তম বিবাহবার্ষিকী পালন করেছেন। প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পর তিনি ৪২ বছর জীবিত ছিলেন, যা তার প্রেসিডেন্ট পদে থাকা সময়ের ১০ গুণ।
হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর মানবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজের সুনাম অর্জন করেন কার্টার। তিনি ছিলেন একজন ভালো টেনিস খেলোয়াড়। এছাড়াও তিনি ভালো দৌড়াতেন। তার এই খেলাধুলার অভ্যাস ও সুস্থ জীবনযাপন বয়সজনিত বিভিন্ন অসুখ থেকে তাকে সুস্থ রাখতে ভূমিকা রেখেছে। তার বিশ্বাস, ইচ্ছাশক্তি, আদর্শ ও উদ্দেশ্য দায়িত্ব শেষ করার পর সাবেক প্রেসিডেন্টদের জন্য একটি নতুন ভূমিকা তৈরি করতে সাহায্য করেছে।
আন্তর্জাতিক সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে পেতে নিরলস প্রচেষ্টা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতিসাধন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে কার্টার ২০০২ সালে প্রায় ৮০ বছর বয়সে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। এর আগেই যদি তিনি মারা যেতেন, তাহলে তিনি আর এ পুরস্কার পেতেন না। কারণ, ওই সময় মৃত ব্যক্তিদের নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করার প্রচলন ছিল না।
সে সময়ের মার্কিন রাজনীতির বিষয়টি বলা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে সে সময় ডেমোক্র্যাটদের অবস্থান বেশ শক্ত ছিল। আর পশ্চিম উপকূলে দলটির অবস্থান ছিল দুর্বল। কার্টার ভার্জিনিয়া ছাড়া সবগুলো সাবেক কনফেডারেট স্টেটে জিতেছিলেন এবং রকি পর্বতমালার পশ্চিমে অবস্থিত হাওয়াই ছাড়া থাকা প্রতিটি স্টেটে হেরেছিলেন।
১৯৭০ এর দশকে আমেরিকার সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছিল। রকি, ট্যাক্সি ড্রাইভার, দ্য কনভারসেশন, ডগ ডে আফটারনুন, অথবা স্যাটারডে নাইট ফিভার এবং স্টার ওয়ার্স এর মতো সিনেমাগুলো দেখলে সেই সময়ের অবস্থা অনুমান করা যায়। দেশটি বিভিন্ন দিক থেকে ভেঙে পড়ছিল। সে সময় দেশটি সবে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রভাব থেকে বের হতে শুরু করেছিল এবং বিশ্বায়ন এবং পরিবেশগত সীমাবদ্ধতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে শুরু করেছিল।
প্রেসিডেন্ট থাকাকালে কী কী করেছেন কার্টার? কার্টার অনেক কিছুই করেছেন। তিনি জলবায়ু এবং পরিবেশ নিয়ে দূরদর্শী চিন্তা করেছিলেন। তিনি ফেডারেল আদালত গঠন পরিবর্তন করেছিলেন।
কার্টার ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে অন্য যেকোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের চাইতেই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনার জন্য বেশি প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন ও মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের মধ্যেকার চুক্তিটি কার্টারের পূর্ণ এবং নিরবচ্ছিন্ন সম্পৃক্ততা সম্ভব হতো না।
কার্টার প্যানামা ক্যানাল চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘ বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। তিনি তার মানবাধিকার নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে কয়েক প্রজন্মের সম্মান উপহার দিয়েছেন। তিনি তার অনেক তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে পেয়েছেন। যেমন, প্রায় সম্পূর্ণভাবে গিনি কৃমি রোগ নির্মূল করা।
কার্টার স্থানীয় সময় রোববার বিকেলে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের প্লেইনসে নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১০০ বছর। তিনিই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি তার ১০০তম জন্মদিনে পৌঁছেছিলেন। গত অক্টোবর মাসে তার ১০০তম জন্মদিন উদযাপিত হয়।