বাণিজ্যযুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে মেক্সিকো, কানাডা ও চীনের ওপর শুল্ক আরোপ ট্রাম্পের
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শনিবার কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ এবং চীনা পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী মঙ্গলবার থেকেই এ সংক্রান্ত নির্দেশ কার্যকর হবে। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে মন্দা এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ট্রাম্পের লিখিত আদেশ অনুযায়ী, মঙ্গলবার রাত ১২টা ১ মিনিট থেকেই শুল্ক আদায় শুরু হবে। তবে যে-সব পণ্য শনিবার রাত ১২টা ১ মিনিটের আগেই জাহাজ বা অন্য পরিবহণ মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পথে রয়েছে, সেগুলো শুল্কের আওতামুক্ত থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসন ও ফেন্টানিল মাদকের সংকট মোকাবিলা না হওয়া পর্যন্ত এ শুল্ক বহাল থাকবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। শুল্ক ঘোষণার পরপরই কানাডা ও মেক্সিকো পালটা ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেয়, যদিও চীন এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
তবে মার্কিন তেল শোধনাগার ও মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর উদ্বেগের কারণে কানাডার জ্বালানি পণ্যের ওপর মাত্র ১০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়েছে, যেখানে মেক্সিকোর জ্বালানি আমদানিতে পূর্ণ ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হবে।
২০২৩ সালে কানাডা থেকে আমদানি করা অপরিশোধিত তেলের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার, যা দেশটির মোট মার্কিন রপ্তানির প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
নতুন শুল্ক বিশেষভাবে অটোমোবাইল খাতকে প্রভাবিত করবে, কারণ কানাডা ও মেক্সিকোতে তৈরি যানবাহন ও যন্ত্রাংশ একাধিকবার সীমান্ত পার হয়ে চূড়ান্ত সংযোজনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে।
হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সংকট নিরসন না হওয়া পর্যন্ত শুল্ক বহাল থাকবে, তবে এটি প্রত্যাহার করতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি।
২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের সময় ট্রাম্প যে হুমকি দিয়েছিলেন, এটি তার বাস্তবায়ন হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, এই শুল্ক নীতির ফলে মার্কিন ও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং ভোক্তা ও ব্যবসার জন্য ব্যয় বাড়তে পারে।
রিপাবলিকানরা ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও শিল্পগোষ্ঠী ও ডেমোক্র্যাটরা এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে সতর্ক করেছেন।
ন্যাশনাল ফরেন ট্রেড কাউন্সিলের (এনএফটিসি) প্রেসিডেন্ট জেক কোলভিন বলেছেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ 'অ্যাভোকাডো থেকে শুরু করে গাড়ি পর্যন্ত' সব কিছুর দাম বাড়াবে। তিনি দ্রুত সমাধানের আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা অর্জন এবং বিশ্ববাজারে মার্কিন কোম্পানিগুলোর রপ্তানি সহজ করার দিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত।'
কানাডার প্রাদেশিক কর্মকর্তারা ও ব্যবসায়ী নেতারা এই শুল্ক নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং মার্কিন পণ্যের ওপর কঠোর পালটা শুল্ক আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে কানাডা ও মেক্সিকোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, নতুন শুল্ক থেকে কোনো দেশই ছাড় পাবে না। কানাডা, মেক্সিকো বা চীন যদি মার্কিন পণ্যের বিরুদ্ধে পালটা শুল্ক আরোপ করে, তাহলে ট্রাম্প আরও বেশি হারে শুল্ক বসানোর পরিকল্পনা করছেন।
অন্টারিওর প্রিমিয়ার ডগ ফোর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে জানিয়েছেন, কানাডার এখন 'কঠোর প্রতিশোধ নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই'। তিনি বলেন, 'অন্টারিওর প্রিমিয়ার হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের সমান হারে পালটা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ফেডারেল সরকারকে আমি সম্পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি।'
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এর আগে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, ট্রাম্প শুল্ক আরোপ করলে কড়া প্রতিশোধ নেওয়া হবে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি শনিবার পরবর্তী পদক্ষেপ ঘোষণা করবেন।
মেক্সিকোর অর্থনৈতিক মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে দেশটির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, মেক্সিকোও শনিবার পালটা শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছে।
হোয়াইট হাউস আরও জানিয়েছে, কানাডাকে আর 'ডি মিনিমিস' মার্কিন শুল্ক ছাড় দেওয়া হবে না। এর ফলে কানাডা থেকে ৮০০ ডলারের কম মূল্যের ছোট চালানগুলোও এখন শুল্কের আওতায় আসবে।
যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, মেক্সিকো ও কানাডা ছোট ছোট পার্সেলের মাধ্যমে ফেন্টানিল ও এর রাসায়নিক উপাদান পাচার করছে, যা কাস্টমস কর্মকর্তারা প্রায়শই পর্যবেক্ষণ করতে পারেন না।
শুক্রবার ট্রাম্প শুল্ক সংক্রান্ত নীতির ব্যাপারে দীর্ঘ বক্তব্য দেন। তিনি স্বীকার করেন, এতে আমেরিকানদের জন্য কিছু অসুবিধা তৈরি হতে পারে, তবে তিনি এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলার পরিকল্পনা করেননি।
ট্রাম্প বলেন, এই শুল্ক আরোপের উদ্দেশ্য চীন, মেক্সিকো ও কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিল ও এর রাসায়নিক উপাদান প্রবাহ বন্ধ করা এবং অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধ করা।
এই সিদ্ধান্তে নেতৃত্ব দিয়েছেন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ স্টিফেন মিলার, যিনি অবৈধ অভিবাসনবিরোধী কঠোর অবস্থানের জন্য পরিচিত। ট্রাম্পের বাণিজ্যসচিব হিসেবে মনোনীত হাওয়ার্ড লুটনিকও এই পরিকল্পনায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন এবং শুক্রবার ট্রাম্পের সঙ্গে ফ্লোরিডায় যান।
দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর দুই সপ্তাহেরও কম সময়ে ট্রাম্প তার নীতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক নীতি পালটে দিচ্ছেন।
ইওয়াইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ গ্রেগ ডাকোর এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ট্রাম্পের এই শুল্ক ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে, কানাডা ও মেক্সিকোকে মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রে 'স্ট্যাগফ্লেশন' সৃষ্টি করতে পারে।
ডাকো সতর্ক করে বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের ফলে অর্থনৈতিক সংকোচন এবং মূল্যস্ফীতির যুগপৎ ধাক্কা আসতে পারে, যা অর্থবাজারে অস্থিরতা তৈরি করবে।'
এই অস্থিরতার কিছুটা প্রভাব ইতোমধ্যেই দেখা গেছে। শুক্রবার ট্রাম্প শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর মেক্সিকান পেসো ও কানাডিয়ান ডলারের মান হ্রাস পেয়েছে। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্টক মার্কেটেও দরপতন হয়েছে এবং ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন