পশ্চিমা বিশ্বে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা বুমেরাং হয়ে ফিরছে
ইউক্রেন আক্রমণের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পশ্চিমা মিত্রদের ধারণা ছিল এরফলে মস্কো অর্থনৈতিক চাপে পড়বে এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও ইউক্রেনে অভিযান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি পশ্চিমা পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার ইঙ্গিতই দিচ্ছে। নিশানা যে লক্ষ্যমতো লাগেনি শুধু তাই নয়, উল্টো বুমেরাং হয়ে এখন পশ্চিমাদেরই ভুগাচ্ছে।
চীন ও ভারতের মতো বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দুই রাষ্ট্র রাশিয়া থেকে প্রায় একই পরিমাণ তেল কিনছে যা আগে পশ্চিমা দেশগুলোতে পাঠানো হতো। এর ওপর জ্বালানি তেলের দাম এত বেশি বেড়েছে যে রাশিয়া তেল বিক্রি করে যুদ্ধ শুরুর পূর্বে চার মাস আগে যা পেত, এখন তার চেয়েও বেশি লাভ করছে। এমনকি দেশটির অস্থিতিশীল মুদ্রা রুবলও ডলারের বিপরীতে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
পুতিনকে ভয় দেখাতে পশ্চিমা প্রচেষ্টাগুলো দেখে মুচকি হাসছেন রুশ কর্মকর্তারা। আর তেল বয়কটের প্রভাব বুমেরাং হয়ে উল্টো পশ্চিমাদের ওপরেই ভারি হয়ে পড়ছে। জো বাইডেন এখনও তার মেয়াদকালের অর্ধেক সময়ও পার করতে পারেননি। তার আগেই জ্বালানি তেলের আকাশছোঁয়া দাম এখন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্যই হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে বিশ্লেষকদের অনেকের মতে রাশিয়ার তেলের ওপর ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এখনও পড়তে শুরু করেনি। তবে এই নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে যার ওপর দেশটির ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই নির্ভর করছে। শুধু জ্বালানি তেলের বাণিজ্যখাতেই নয়, রাশিয়ার ব্যাংকিং এমনকি অন্যান্য শিল্প-প্রতিষ্ঠানের ওপরও এর প্রভাব পড়বে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
রাশিয়ার জ্বালানি আয় সম্পর্কে মস্কোর পিএফ ক্যাপিটাল কনসাল্টিং কোম্পানির প্রধান অর্থনীতিবিদ ইয়েভজেনি নাদরশিন বলেন, "সবচেয়ে খারাপ এমনকি ন্যূনতম প্রভাব থেকেও অবস্থা এখন বহুগুণে ভালো। দুর্ভাগ্যবশত, কঠিন সময়টি কেবল শুরু।"
পুতিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আর্থিক দিক থেকে আত্মবিশ্বাসী কি না, তা নিশ্চিতভাবেই এখন এক উন্মুক্ত প্রশ্ন। কিন্তু অন্যদিকে ইউক্রেন ও তার সমর্থকরা যে দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুত, সবদিক থেকেই তার ইঙ্গিত মিলছে।
সম্ভাব্য ইউক্রেনীয় পাল্টা-আক্রমণ থেকে বাঁচতে ইউক্রেনের ডেপুটি প্রাইম-মিনিস্টার ইরিনা ভেরেশচুক দক্ষিণ ইউক্রেনের রাশিয়া-অধিকৃত অংশে বসবাসকারী কয়েক হাজার মানুষকে আগাম সরিয়ে নিতে জরুরি আবেদন করেছেন।
মঙ্গলবার বাইডেন প্রশাসন অ্যাটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ডকে ইউক্রেনে এক ঝটিকা সফরে পাঠায়। গারল্যান্ড সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধে জড়িত রাশিয়ানদের বের করতে আমেরিকার হয়ে প্রসিকিউটর এলি রোজেনবাউমকে নিয়োগের ঘোষণা দেন। রোজেনবাউম নাৎসিদের তদন্তের জন্য পরিচিত একজন প্রবীণ প্রসিকিউটর। পুতিন অবশ্য বরাবরই ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছেন।
তবে এখনকার মতো রাশিয়াকে বিচারের আওতায় আনার চেয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকে কোণঠাসা করাই যুক্তরাষ্ট্র ও এর পশ্চিমা মিত্রদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু ব্রহ্মাস্ত্র বুমেরাং হয়ে এখন পশ্চিমা দেশগুলোকেই হুমকিতে ফেলেছে। এর অন্যতম কারণ এশিয়ায় রুশ জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের জন্য এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী।
মে মাসে চীনে রাশিয়ান তেল আমদানি আগের মাসের তুলনায় ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। চীনে জ্বালানির বৃহত্তম সরবরাহকারী সৌদি আরবকে সরিয়ে রাশিয়া নতুন রেকর্ড গড়ে। ভারত আগে রাশিয়ার জ্বালানির ওপর খুব একটা নির্ভর না করলেও মার্কেট রিসার্চ প্রতিষ্ঠান কেপলারের তথ্যানুসারে দেশটি বর্তমানে দৈনিক সাত লাখ ৬০ হাজার ব্যারেলের বেশি রুশ জ্বালানি কিনছে।
কেপলার বিশ্লেষক ভিক্টর ক্যাটোনা বলেন, "রাশিয়ার জ্বালানি উৎপাদন ব্যবস্থাকে রক্ষা করেছে এশিয়া। দেশটির জ্বালানি খাত সংকোচিত হওয়ার পরিবর্তে প্রায় মহামারি পূর্ব অবস্থার কাছাকাছি পৌঁছেছে।
ইন্ডিপেনডেন্ট রিসার্চ ও বিজনেস অ্যানালিটিকস প্রতিষ্ঠান রিস্ট্যাড এনার্জির মতে, মার্চ থেকে মে মাসে ইউরোপে রাশিয়ার জ্বালানি বিক্রি দিনে পাঁচ লাখ ৫৪ হাজার ব্যারেল পর্যন্ত কমেছে। কিন্তু এশিয়ার শোধনাগারগুলো দৈনিক প্রায় পাঁচ লাখ তিন হাজার ব্যারেল তেল কেনা বাড়িয়েছে।
রাশিয়া যদিও নিষেধাজ্ঞার কারণে বেশ বড় ছাড়েই তেল বিক্রি করছে, তারপরও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই ক্ষতি মোটামুটি পুষিয়ে ফেলা সম্ভব হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্যানুসারে, এপ্রিলের তুলনায় মে মাসে দেশটির জ্বালানি আয় বেড়েছে ১.৭ বিলিয়ন ডলার।
ইউরোপের জন্য পূর্ব-নির্ধারিত তেলের বাজার পুরোপুরি এশিয়ায় প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব হবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এখনকার মতো এশিয়ার জন্য রাশিয়ার তেল উৎপাদন অপরিবর্তিত রয়েছে। এভাবে চললে ভবিষ্যতে দেশটির জ্বালানিখাত সংকোচিত হবে কি না, সেই বিষয়টিও আগাম বলা কঠিন।
তবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেই যে ইউরোপে রাশিয়ার তেলের প্রবাহ ঠেকানো যাবে তা নয়। শোধনাগারগুলো অপরিশোধিত তেল ডিজেল বা গ্যাসোলিনে রূপান্তরিত করলে ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে পাঠানো জ্বালানিগুলোর মূল উৎস রাশিয়া কি না সেই পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন হবে। পশ্চিমা দেশগুলোতে রপ্তানি করা পরিশোধিত তেলের প্রসঙ্গে বলেন এনার্জি কনসাল্টিং প্রতিষ্ঠান এফজিই-এর সভাপতি জেফ ব্রাউন বলেন, "অথচ খনিজগুলোর অনেকটাই রাশিয়া থেকে আসে।"
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস