কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে ৪০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ পাবেন ট্যানাররা
আসন্ন ঈদুল আযহায় কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে ট্যানাররা ৪০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ পাবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত এ ঋণের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় ১৮৩ কোটি টাকা কম; এই ঋণ সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করা হবে।
এর আগে, কোরবানির ঈদে চামড়া সংগ্রহের জন্য ট্যানারি শিল্পের অনুকূলে ৫০০-৬০০ কোটি টাকা ঋণ সংস্থানের ব্যবস্থা করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় ট্যানারি মালিকরা।
শিল্পমালিকরাও বলছেন, কাঁচা চামড়া কেনা ও ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে ঋণ সহায়তা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, প্রতিবছর কোরবানি ঈদের সময় ঋণের ব্যবস্থা করতে সরকারের নীতি সহায়তা চান উদ্যোক্তারা।
ট্যানারি শিল্প উদ্যোক্তাদের পূর্বের ঋণের বড় একটি অংশই খেলাপি থাকায় ব্যাংকগুলো সহজে ঋণ দিতে চায় না, যার কারণে ঋণ পেতে সরকারের সহায়তায় চান তারা।
আসন্ন ঈদুল আযহার কোরবানির কাঁচা চামড়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাসহ প্রাসঙ্গিক বিষয় ও ঋণের ব্যবস্থা করতে গত ২১ জুন বাণিজ্য সচিবকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন।
পাশাপাশি কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে চাহিদামাফিক লবণ সরবরাহের ব্যবস্থা, কাঁচা চামড়া পাচার ঠেকাতে ঈদের পর অন্তত ৩০ দিন পর্যন্ত বর্ডার এলাকায় টহল বাড়ানো ও কাঁচা চামড়া ক্রয়ে ঋণ সরবরাহে ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতাও চেয়েছে সংগঠনটি।
এবং বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক এবং সালমা ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ টিবিএসকে বলেন, "চামড়া একটি পচনশীল পণ্য, যা দ্রুত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হয়। সারাদেশ থেকে বিভিন্ন আড়তের মাধ্যমে সংগৃহীত চামড়া কিনতে হয়, যার জন্য নগদ টাকা প্রয়োজন হয় কারণ মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনে আড়তে বিক্রি করে।"
তিনি বলেন, "ট্যানারি মালিকরা নিজস্ব ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দিয়ে ব্যবসা করলেও কোরবানির সময় বেশি নগদ অর্থের প্রয়োজন হয়, যা নিজস্ব ফান্ড থেকে ম্যানেজ করা সম্ভব হয় না।"
"সাভার ট্যানারি শিল্পপার্কে কারখানা স্থানান্তর করা হলেও জমির লিজ ডিড সম্পন্ন হয়নি, যার কারণে এই জমির বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, সেজন্যই ঋণের ব্যবস্থা করতে সরকারের নীতিসহায়তা প্রয়োজন।"
ট্যানার্স এসোসিয়েশন চামড়া খাতের উদ্যোক্তাদের সর্বোচ্চ বডি, এই খাতের শিল্প মালিকরা সারা দেশ থেকে আড়তের মাধ্যমে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করে।
প্রক্রিয়াকরণের পর উদ্যোক্তারা কেউ কেউ চামড়া শিল্পের সংযোগ শিল্পে বিক্রি করে ও কেউ কেউ আবার বিদেশে রপ্তানি করে।
ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সূত্রমতে, ট্যানারি মালিক ও বাণিজ্যিক রপ্তানিকারক মিলিয়ে সংগঠনটির বর্তমান সদস্য প্রায় ৮০০ জন। সারাদেশে ১৮৬৬টি বৃহৎ ও মাঝারি আড়ত রয়েছে।
এর বাইরেও ছোট আকারে অনেক আড়ত রয়েছে, যারা মৌসুমী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ঈদুল আযহার সময় চামড়া সংগ্রহ করে।
আড়তদাররা মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহের পর নিজেরাই লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে, পরবর্তীতে বড় ট্যানারীর কাছে বিক্রি করে।
রাজধানীর পোস্তা, নাটোরের রেলওয়ে বাজার, যশোরের রাজারহাট, গাইবান্ধার পলাশবাদী, রংপুরের তারাগঞ্জ, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, আমিনবাজার ও টঙ্গী-গাজীপুরের আড়ৎসমূহে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও মজুদ করা হয়।
বাণিজ্য সচিবকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা আয়, জাতীয় প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও মূল্য সংযোজনের নিরিখে সম্ভাবনাময় খাত চামড়া শিল্প। এই শিল্পের সিংহভাগ কাঁচা চামড়া সংগৃহীত হয় ঈদুল আযহায়।
ছাড়ানো ও সঠিক সংরক্ষণের অভাবে প্রতিবছর প্রায় ৩০% চামড়া নষ্ট হয়, যার জন্য চামড়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
বিটিএ'র চিঠিতে বলা হয়, কাঁচা চামড়া প্রাথমিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণে শুধু কোরবানির ঈদে সবমিলিয়ে কমবেশি ১.২৫ কোটি পিস চামড়ার জন্য প্রায় ৮১ হাজার মেট্রিক টন লবণের চাহিদা রয়েছে।
তবে কোরবানির ঈদের সময় লবণের দাম বৃদ্ধি পায়। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও লবণের দাম যাতে বাড়াতে না পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও সারাদেশে লবণ সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়ে জানানো হয়।
গতবছরের ন্যায় এবারও আবহাওয়া গরম থাকবে, যার জন্য স্থানীয় মাদরাসা বা এতিমখানার মাধ্যমে চামড়া সংগ্রহের পর যেন লবণ লাগানো হয়, সে জন্য পশু সম্পদ বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন, তথ্য কর্মকর্তা ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে ভূমিকা রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে বিটিএ।
৩০ দিন পর্যন্ত বর্ডার এলাকা দিয়ে চামড়া যাতে পাচার না হয়, সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিজিবি ও পুলিশকে নির্দেশনা প্রদান ও টহল বাড়ানো এবং স্থানীয় প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার অনুরোধ জানিয়েছে ট্যানার্স এসোসিয়েশন।
বেড়েছে রপ্তানি, সাথে উদ্যোক্তাদের আশাও
২০১৭ সালে উচ্চ আদালতের রায়ে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারীগুলোকে সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তর করা হয়।
কমপ্লায়েন্স ইস্যু ও স্থানান্তরের কারণে চামড়া রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, ফলে রপ্তানি কমে যায়।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রায় তিনবছর পর আবার চামড়া রপ্তানি বাড়ছে, যাতে আগামীতে সম্ভাবনা দেখছেন উদ্যোক্তারা।
শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, দীর্ঘদিন পর চামড়া রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে, বিদেশী ক্রেতাদের চাহিদাও এখন বেশ ভালো। রপ্তানি ত্বরান্বিত ও বর্তমান ট্রেন্ড ধরে রাখতে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম নয়মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় হয়েছে।
এই রপ্তানির পরিমাণ সরকারের নির্ধারিত টার্গেট ও আগের বছরের চেয়ে অনেক বেশি।
২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে চামড়া রপ্তানি হয়েছে ১১১.৫৬ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি। আর রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৮% বেশি।
উল্লেখ্য, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০১.৯৮ কোটি ডলারের চামড়া রপ্তানি হয়। এই সময়ের পর দুই অর্থবছরে এক বিলিয়ন ডলারের কম পণ্য রপ্তানি হয়েছে।