বিএসআরএম: ট্রেডিং ব্যবসা থেকে শীর্ষ ইস্পাত উৎপাদনকারী হয়ে ওঠার গল্প
দেশের শীর্ষ ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম। রড উৎপাদনে দীর্ঘ ৭০ বছরের ইতিহাস প্রতিষ্ঠানটির। প্রতিষ্ঠানটির আটটি কারখানায় বর্তমানে বছরে ১৬ লাখ টন রড ও ১৮ লাখ টন বিলেট উৎপাদন হয়। করোনা মহামারিতে রডের চাহিদা কমে গেলেও কোনো কর্মী ছাঁটাই না করেই উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। পরে পণ্যটির চাহিদা ও দাম বৃদ্ধি পেলে সেই মজুদকৃত পণ্যই ২০২০-২১ সালে সর্বোচ্চ মুনাফা এনে দিয়েছে বিএসআরএমকে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে সাড়ে চার হাজার কর্মী কর্মরত আছেন। ২০২৩ সালে উৎপাদনে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির আরো একটি কারখানা। যেখানে বছরে সাত লাখ টন রড উৎপাদিত হবে।
প্রতিষ্ঠানটির শুরু থেকে বর্তমান অর্জন, ৭০ বছরের দীর্ঘ পথচলার গল্প শুনিয়েছেন বিএসআরএম এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলী হুসাইন।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড চট্টগ্রামের ব্যুরো চিফ সামছুদ্দিন ইলিয়াস ও স্টাফ করেসপন্ডেন্ট জোবায়ের চৌধুরী।
বিএসআরএম এর শুরু হয় কিভাবে? এই পর্যায়ে কিভাবে আসা?
১৯৫২ সালে চট্টগ্রামে বিএসআরএম প্রথম ইস্পাত উৎপাদন শুরু করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ভারতের গুজরাট থেকে জমা টাকা-পয়সা নিয়ে আমাদের পরিবার করাচিতে স্থানান্তরিত হয়। সেখান থেকে ১৯৪৮ সালের দিকে আমাদের পরিবার চট্টগ্রামে আসে। সেসময় আমাদের ট্রেডিং বিজনেস ছিল। বেশিরভাগ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ট্রেড করতো আমাদের পরিবার।
সেসময় আমার দাদা এবং তাঁর ভাইয়ের অনুভব করলেন, চট্টগ্রামে কোনো শিল্প কারখানা নেই। যা শিল্প ছিল, বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে। ওইসময় তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, এখানে রোলিং কারখানা করবেন। তখন ভারতে এই শিল্পের ভিত বেশ শক্তিশালী ছিল। পাশাপাশি সেখানকার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও আমাদের ভালো যোগাযোগ ছিল।
১৯৫২ সালে প্রথম চট্টগ্রামের নাছিরাবাদ শিল্প এলাকায় রোলিং কারখানা স্থাপন করা হয়। আমাদের প্রথম পণ্য ছিল ৪০ গ্রেডের ইস্পাত। পরে আমরা ধাপে ধাপে ইস্পাত উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াই। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আমরাই জাহাজ ভাঙা শিল্প শুরু করি। এই শিল্পে নতুন উদ্ভাবন যুক্ত করতে থাকি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের সব সম্পত্তি রাষ্ট্রের অধীনে চলে যায়। তখন সিদ্ধান্ত ছিল- সব শিল্পকে জাতীয়করণ করা হবে। সরকারই পরিচালনা করবে বেশিরভাগ শিল্পকে।
দেশ স্বাধীনের পর শেখ মুজিব সাহেব আমাদের প্ল্যান্ট পরিদর্শন করেন। তিনি আমাদের পরিবারকে চিনতেন। ১৯৭৩ সালে আমাদের সবকিছু আবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়। শেখ মুজিব সাহেব দেখলেন, আমরা এখানে থাকতে চাই। বিনিয়োগ করতে চাই।
১৯৮০ এর দশকে আমরা সেমি অটোমেটেড প্ল্যান্ট শুরু করি। এরপর আমরা আন্তর্জাতিক মান মেনে ৬০ গ্রেডের ইস্পাত উৎপাদন শুরু করি। শিল্পের মূল প্রসার হয়েছে ১৯৯০ এর পর। আমাদের বহু বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমার শুধু এগিয়ে গিয়েছি। নতুন প্রযুক্তি এনেছি, নতুন যন্ত্রাংশ এনেছি। এভাবেই আমাদের প্রসার হয়েছে।
শেখ মুজিব সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গি এবং লক্ষ্য অনেক বড় ছিল। ওইসময় দেশের অবস্থা ভালো ছিল না। অর্থনৈতিক অবস্থা খুব দুর্বল ছিল। এখানে তেমন শিল্পকারখানা ছিল না। তাই তিনি চাইতেন, এখানে শিল্প গড়ে উঠুক। তিনি শিল্পকারখানা ফিরিয়ে দিয়েছেন। ওইসময়ে তার এক সিদ্ধান্তে সবকিছু পাল্টে গেছে। সরকারপ্রধানের ভালো সিদ্ধান্তের বা নীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের আজকের প্রতিষ্ঠান (বিএসআরএম)।
মহামারিতে বিএসআরএম কিভাবে কাজ করেছে?
এখন পরিস্থিতি খুব ভালো।
আমাদের দেশের মানুষ বেশি। অর্থনৈতিকভাবেও অনেক বেশি শক্তিশালী নই। দরিদ্রতার ইস্যু আছে। পরিবেশের ইস্যু আছে। সবমিলিয়ে মহামারিতে দেশের সবকিছু পুরো বন্ধ করে দিলে আরো ক্ষতি হতো। সরকার খুব তাড়াতাড়ি সেটা বুঝতে পেরেছে, সবকিছু বন্ধ নীতি আমাদের দেশের জন্য ঠিক হবে না।
মহামারিতে যখন শিল্প প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়, তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো ছিল। দেশের পর্যটনখাত, বিমানখাত, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। যখন সব বন্ধ ছিল, তখন পণ্যের চাহিদা কম ছিল। সরবরাহ করতে অনেক কষ্ট হতো। তবে সরকার যে উদ্দীপনাগুলো দিয়েছে, তা আমাদের সহযোগিতা করেছে।
এই মহামারিতে আমরা কোন কর্মীকে চাকরিচ্যুত করিনি। প্রথম দুই মাস অনেক কষ্ট হয়েছে। তখন অনেক বেশি চাপ ও টেনশন ছিল। চারদিকে চাকরি হারাচ্ছিলেন মানুষ। তবুও আমাদের চিন্তা ছিল, আমরা যতদিন পারি টিকে থাকার চেষ্টা করবো। কারণ সবাই মিলেই আমাদের পরিবার। আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা অনেক কষ্ট করেছেন। গণপরিবহন বন্ধ ছিল। স্বাস্থ্যবিধি মেনে করখানায় শ্রমিক আনা-নেওয়া খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। তবুও কারখানা চালু রেখেছি। বড় বড় প্রকল্পগুলোতে কিছুটা ধীর গতি থাকলেও প্রয়োজন অনুসারে ইস্পাত সরবরাহ করেছি। মহামারির সময়ে উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমাতে হয়েছিল। তখন বিক্রয় অনেক কমে গিয়েছিল। তবুও আমরা উৎপাদন চালু রেখে মজুদ করছিলাম।
বিএসআরএম ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ মুনাফা দেখিয়েছে। বিক্রয় বৃদ্ধি পেয়েছে এক-তৃতীয়াংশ। মহামারির পর ইস্পাতের চাহিদা বেড়েছে। এই বিশাল চাহিদা বিএসআরএম কিভাবে ম্যানেজ করছে?
মহামারির কারণে গত বছর ইস্পাতের চাহিদা কম ছিল। আগের বছর ও বর্তমান বছর সবমিলিয়ে একসঙ্গে চাহিদা বেড়ে গিয়েছে। এ কারণে আমরা ভালো করেছি। পাশাপাশি সরকারও উদ্দীপনা দিয়েছে। সুদের হার এক সংখ্যায় (সিঙ্গেল ডিজিট) নামিয়ে এনেছে। এর ফলেই পুরো শিল্পের আর্থিক ব্যয় কমে গিয়েছে। আশা করি, সরকার সুদের হার এই অনুপাতে রাখবে। এটি দেশকে অনেকটা সহযোগিতা করবে। বেসরকারি খাতকে আরো এগিয়ে নেবে।
বিএসআরএম এর নতুন পণ্য বা নতুন প্রকল্প নিয়ে কোনো পরিকল্পনা রয়েছে?
আমরা নতুন একটি ওয়্যার ইউনিট শুরু করেছি। আমরা এখানে এসিএসআর কোর ওয়্যার করি, যেটা আগে আমদানি করতে হতো। এরসঙ্গে আমরা পিসি ওয়্যারও করছি। এটাও শতভাগ আমদানি করা হতো। এখন এটি দেশে তৈরি হওয়াতে ডলার সেভ হবে। আমদানি নির্ভরতা কমছে।
পাশাপাশি আমরা অনেক সেইফটি-সিকিউরিটি বিষয়ক পণ্য তৈরি করি। এসব আমাদের দেশের জন্য নতুন। মহামারির কারণে চীন ও ইউরোপ থেকে দেশে টেকনিক্যাল লোকজন আসতো না। তাই এসব ইক্যুইপমেন্ট উৎপাদন এবং সরবরাহ পুরো প্রক্রিয়ায় ধীরগতি ছিল। তবে এখন ভালো গতিতে চলছে।
বিএসআরএম কি নতুন কোনো ক্ষেত্রে/সেক্টরে তাদের ব্যবসা বিস্তৃত করতে চায়?
এখন কোনো পরিকল্পনা নেই। আমাদের দেশে নতুন সেক্টরে যাওয়া খুবই সহজ। প্রবৃদ্ধি আছে। কিন্তু আমাদের সম্পদ সীমিত।
আমাদের শিল্প মূলধন নির্ভর। তাই আমরা এখানে বিনিয়োগ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি আমরা নতুন একটি রড উৎপাদন প্রকল্প শুরু করেছি। নতুন রোলিং বেল হবে। সেখানে সাত লাখ টন আরো সক্ষমতা বাড়বে। নতুন এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। ২০২৩ এ আমরা উৎপাদনে যেতে পারবো।
চীন এখন ইস্পাত উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলো আবার বাড়িয়ে দিচ্ছে, কারণ সেখানে উন্নয়নের সুযোগ আছে। বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন প্রকল্প চলছে। এখানে ইস্পাত চাহিদা আছে। আপনি বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্পের কেমন সম্ভবনা দেখছেন?
আগামী ২০-৩০ বছর বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর অবকাঠামোগত অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এখন পর্যন্ত একটি পদ্মা সেতু করছি আমরা। পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য আমাদের অবকাঠামোগত বিনিয়োগ মাথাপিছু আয়ের তুলনায় অনেক কম।
দেশের অনেক জায়গায় রাস্তাঘাট এখনো অনেক খারাপ। যাতায়াতে অনেক সময় লাগে। ৮০-১০০ কিলোমিটার দূরে যেতেও অনেক সময় লেগে যায়। এদিকে উন্নয়ন করতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাবে অনেক সম্পদের সদ্ব্যবহার করা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ বেল্ট থেকে বেনাপোল ৮০০ কিলোমিটারের মতো হবে। এই দূরত্বে যেতে ৮ ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা না। চট্টগ্রাম থেকে কাপ্তাই ৫০ কিলোমিটার হবে। এটুকু যেতে দুই-আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়।
এছাড়া, কক্সবাজারেও সিঙ্গেল লেনের সড়ক। পর্যটন শিল্পের প্রসার হতে দিচ্ছে না সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা। সব জায়গায় চার লেন, ছয় লেনের সড়ক করতে হবে। পর্যটন শিল্পের সম্ভবনাকে কাজে লাগাতে হবে। এতেই অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। পুরো দেশে সঠিকভাবে যোগাযোগ সংযোগ স্থাপন করতে হবে। তখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকও ফসলের ন্যায্যা মূল্য পাবে। অবকাঠামোগত সংকটের কারণে পরিবহন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়।
বিএসআরএমের রপ্তানির সম্ভবনা নিয়ে বলুন...
রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের ভালো সক্ষমতা রয়েছে। কারণ এখানে লোকবল আছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পুরোপুরি চালু হোক। বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন হোক। প্রতিবেশি দেশের তুলনায় ফ্রেইট বেশি। সরকারের মনোযোগ দিতে হবে এটি কিভাবে কমানো যায়। এক্ষেত্রে সরকার কি বন্দরের সক্ষমতা বাড়াবে? নাকি নির্দিষ্ট লাইনেজ চালু করবে? এসব বিষয়ে কৌশলী হতে হবে যেন সর্বোপরি ফ্রেইট কমে এবং আমদানি ব্যয়ও যেন কমে।
নতুন নতুন প্রকল্প হচ্ছে। কাজ শেষ হতে হতে আরো চাহিদা বাড়বে। সমুদ্র বন্দর, জ্বালানী, বিমান বন্দর, রেলওয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ সবসময় তৈরি করে রাখতে হবে। যেন একদিকে সমস্যা হলে অন্যদিক দিয়ে সামাল দেওয়া যায়। একটি প্রকল্পের কাজ চলার সময় চাহিদার তুলনায় সক্ষমতা বাড়ানো হলে কিন্তু ব্যয় খুব বেশি বাড়বে না। অথচ পরে আবার নতুন করে বর্ধিত করতে গেলে অনেক ব্যয় বাড়বে।
দেশের ইস্পাত শিল্পকে আরো এগিয়ে নিতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে কী কী নীতি দরকার? এক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ বা সুপারিশ কী?
কিছু কিছু নীতি রয়েছে যা শুধু ইস্পাত শিল্পকে নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। আমাদের করসংক্রান্ত নীতিমালাগুলোকে অনেক পরিমার্জন করতে হবে। এটি অনেক জটিল। দেশের যেকোনো কোম্পানির অডিট করলে কিছু না কিছু ঝামেলা থাকে। কারণ আমাদের করসংক্রান্ত নীতিমালা অনেক বেশি বিভান্তিকর। এখানে আমূল পরিবর্তন দরকার।
জলবায়ু পরিবর্তন ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনা নিয়ে কী চিন্তা করছে বিএসআরএম?
পৃথিবীজুড়ে এখন সবুজ বিপ্লব চলছে। ইস্পাত শিল্প কারখানাগুলোর মধ্যে মৌলিক ইস্পাত উৎপাদনের কারখানাগুলো কার্বন নিঃসরণ করে থাকে। আমরা ইস্পাত উৎপাদন করি স্ক্র্যাপ পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে। আমার পরিবেশবান্ধব শিল্প পরিচালনা করি। আমাদের ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়া কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ একেবারে কম। এছাড়া আমাদের বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ সিস্টেম থাকে। কার্বন নিঃসরণ কম করায় আমাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে।