দেশে বড় ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে
দেশের বাজারে বড় আকারের ইলিশের সরবরাহ বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা এবং জাটকা নিধনে কার্যকরী পদক্ষেপের কারণে পাঁচ বছরের ব্যবধানে বড় আকারের ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) এক গবেষণায় দেখা গেছে, জেলেদের জালে ৮০০ গ্রাম থেকে ১ হাজার গ্রামের বেশি ওজনের ইলিশ আহরণ বেড়েছে। ২০১৯ সালে এই ওজনের ইলিশ ধরা পড়েছে মোট ইলিশের ২২ শতাংশ। যা ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশে।
বিএফআরআই বলছে, ইলিশের গড় আকার ধারাবাহিকভাবে ২৮ সেমি থেকে বেড়ে ৩৭ সেমি এ দাঁড়িয়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বর্তমানে ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ ৮৯ হাজার মে. টন, যা এক দশক আগের তুলনায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে ২৫ শতাংশই ছিল ৮০০-১০০০ গ্রামের বেশি ওজনের ইলিশ। এছাড়া ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ধরা পড়েছে ৮ শতাংশ, ৫০০-৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১৮ শতাংশ, ৪০০-৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১৬ শতাংশ, ৩০০-৪০০ গ্রাম ওজনের ১০ শতাংশ এবং ২০০-৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ধরা পড়েছে ১৪ শতাংশ।
বিজ্ঞানীরা বলছে, ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দুটি প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা বন্ধ রাখা হয়। অক্টোবর-নভেম্বর ও ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসকে প্রজনন মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। জাটকা ধরা, পরিবহন ও বিক্রির উপর কয়েক বছর ধরেই কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ইলিশ ধরার জন্য যে জাল ব্যবহার করা হচ্ছে সেখানেও সরকার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। এসব পদক্ষেপের কারণে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে এবং প্রতিনিয়তই বড় ইলিশের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজশাহী, খুলনা, চাঁদপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ইলিশ আহরণ করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আকারের ইলিশ ধরা পড়ে কক্সবাজারে, যেগুলোর গড় দৈর্ঘ্য ৪২ সেমি এবং এসব ইলিশের গড় ওজন ৮৫০ গ্রাম। গড় দৈর্ঘ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে চাঁদপুর ও বরিশালের ইলিশ। এর মধ্যে বরিশালের ইলিশের গড় ওজন বেশি। বরিশালের ইলিশের গড় ওজন ৮০০ গ্রাম, যেখানে চাঁদপুরের ইলিশের গড় ওজন ৭৭৫ গ্রাম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, 'ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে গবেষণা চলমান রয়েছে। এর কৃত্রিম প্রজনন নিয়েও কাজ চলছে।'
তিনি বলেন, 'প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা বন্ধ এবং জাটকা নিধনে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সে কারণে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। একইসঙ্গে বড় ইলিশও ধরা পড়ছে এবং প্রতিনিয়তই এই সংখ্যাটা বাড়ছে।'
গবেষকরা বলছেন, প্রথম দুই বছরে ইলিশ মাছ দ্রুত বড় হয়। এর মধ্যে প্রথম বছরে একেকটি ইলিশ ৩০ সেমি পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় বছরে প্রায় ৪০ সেমি পর্যন্ত বাড়ে। তবে বাংলাদেশে ইলিশের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৫৭-৬১ সেমি পর্যন্ত হতে পারে। অবশ্য এই গ্রোথের জন্য ৫-৭ বছর সময় প্রয়োজন হয়।
গবেষণার তথ্য বলছে, আমরা যত বড় বড় ইলিশ বাজারে পাই তার প্রায় সবটাই স্ত্রী ইলিশ। পুরুষ এবং স্ত্রী ইলিশ মাছের অনুপাতে ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। এর দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। একটি পুরষ মাছ স্ত্রী মাছের তুলনায় কম দিন বাঁচে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩০ সেমি আকারের ইলিশের অধিকাংশ এবং ৪০ সেমি আকারের বড় ইলিশের প্রায় সবই স্ত্রী ইলিশ।
তবে ইলিশের উৎপাদন ও বড় আকারের ইলিশের পরিমাণ বাড়লেও এখনো অপরিপক্ক ইলিশ আহরণের হার অনেক বেশি। বর্তমানে ২৬.৭ শতাংশই অপরিপক্ক ইলিশ। অপরিপক্ক ইলিশের আকার ২৬-৩২ সেমি। এ কারণে সরকার ৬.৫ সেমি অপেক্ষা ছোট ফাঁসবিশিষ্ট সব ধরনের জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। যাতে করে ৩০ সেমি এর নিচের কোন ইলিশ ধরা না হয়।
পদ্মা, মেঘনা ও সমুদ্রে মূলত ইলিশ ধরা হয়। ইলিশ মাছের খাদ্য তালিকায় মোট ২৭ প্রজাতির উদ্ভিদ কণা রয়েছে। তবে গবেষণায় একটি সংকটের কথাও উঠে এসেছে। মেঘনা নদীতে আগে যে পরিমাণে প্রাকৃতিক খাবার ছিল তা এখন হ্রাস পাচ্ছে। ২০০৬ সালের তুলনায় প্রতি লিটার পানিতে প্রাকৃতিক খাবারের পরিমাণ ২০২০ সালে গড়ে প্রায় ৬ শতাংশ কমে গেছে। এ কারণে মেঘনায় দুর্বল স্বাস্থ্যের কিছু কিছু জাটকা দেখা যাচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সরকার ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে নিবন্ধিত জেলেদেরকে খাদ্য সহায়তা, বিকল্প কাজের সুযোগ তৈরি ও গবেষণা পরিচালনা করছে। মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণ করতে ইলিশ জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ২০২০ সাল থেকে পাঁচ বছর মেয়াদী ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার।