অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া শিশুর পরিবারে দুর্ঘটনা হানা দিয়েছে বারবার, প্রাণ গেছে আরও সদস্যের
নতুন শিশুর আগমনে যে বাড়ির উঠানে থাকার কথা ছিলো আনন্দ-উচ্ছ্বাস, সেখানে এখন একই পরিবারের তিন জনের কবর। বাবা-মা-বোনকে হারিয়ে স্তব্ধ নিহত জাহাঙ্গীর আলম ও রত্না দম্পতির আরো দুই সন্তান, ১০ বছর বয়সী মেয়ে জান্নাত ও সাত বছর বয়সী ছেলে এবাদত।
জাহাঙ্গীর আলমের মামাতো ভাই মোহাম্মদ আল আমিন জানান, এর আগে ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরের ছোটভাই ফজলুল হক ও ২০০৪ সালে জাহাঙ্গীরের চাচা শামসুল হক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।
'এই সড়ক আমারে শেষ করে দিছে'- বলে আহাজারি করছিলেন শিশুটির দাদি।
এই দম্পতির সন্তান জান্নাত আক্তার বলেন, 'মোবাইলে আমার বোনের ছবি দেখেছি। তাকে কোলে নিতে ইচ্ছা করছে। আদর করতে ইচ্ছা করছে। দাদা-দাদি ও আমি মিলে তাকে লালন-পালন করবো। ছোট ভাই এবাদত কবরের পাশেই বসে থাকে।'
ঘটনার দিন শনিবার রাতে জানাজা শেষে নিজ বাড়িতে দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী রত্না ও মেয়ে সানজিদাকে কবর দেওয়া হয়।
দুর্ঘটনায় মৃত সব সদস্যের কবরই বাড়ির সামনে।
যখন পৃথিবীর আলো দেখলো শিশুটি তখনই তার পরিবারের সদস্যদের প্রাণ গেছে সড়কে। দুর্ঘটনায় মৃত মায়ের পেট থেকে জন্ম নেওয়া নবজাতক শিশুটিকে ময়মনসিংহ চরপাড়া এলাকায় লাবিব হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালটির মালিক মোহাম্মদ শাহজাহান ও তার স্ত্রীর তত্ত্বাবধায়নে শিশুটি রয়েছে।
মোহাম্মদ শাহজাহান জানান নিহত জাহাঙ্গীর আলম তার পারিবারিক বন্ধু, তাদের বাড়ি একই এলাকায়। শুরু থেকে শিশুটিকে তিনিই চিকিৎসার দখভাল করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ত্রিশালের বাসিন্দা এক শিল্পপতি শিশুটির যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
ময়মনসিংহ সিবিএমসিবি হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মো কামরুজ্জামান শিশুটির চিকিৎসা করছেন। তিনি জানান ডান হাতের হাড় ভেঙ্গে গেছে শিশুটির, তবে এখন বিপদমুক্ত আছে।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় হাসপাতালে প্রচুর সংবাদমাধ্যম কর্মী ও উৎসুক জনতা ভিড় করছেন ছবি তুলছেন লাইভ করছেন। এতে বাচ্চার জন্য সংকট তৈরি হতে পারে।
'ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ছে,' বলেন তিনি।
নিহত জাহাঙ্গীরের বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু ও মা সুফিয়া আক্তার দুইজনই শারীরিক প্রতিবন্ধী। তারা জানান, জায়গা না থাকায় বাড়ির উঠানেই বানিয়েছেন কবরস্থান। থাকার ঘরটিও ভাঙ্গা টিন আর মাটির তৈরি। দরিদ্র পরিবারে মোস্তাফিজই ছিল উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
তাকেসহ তিনজনকে একসঙ্গে হারিয়ে আরও অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। এখন নবজাতকসহ তিন সন্তানের ভবিষ্যতও অনেকটা অনিশ্চয়তার মুখে।
রোববার দুপুরে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ প্রবেশন অফিসার আসাদুজ্জামান শিশুটির খোঁজ নিতে লাবিব হাসপাতালে যান। তিনি জানিয়েছেন শিশুটির নিরাপত্তা ও চিকিৎসার বিষয়টি তারা নিশ্চিত করছেন। অনেকেই শিশুটির পরিবারের কাছে দত্তক নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
'যদি কোনো পরিবার দত্তক দেয় তাহলে আইন মেনে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে দেওয়া হবে। তবে যতটুকু জানতে পেরেছি দত্তক দিতে রাজি নয় তার দাদা দাদি ও চাচারা।'
ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন জানান ট্রাকটি আটক করা হয়েছে। চালককে খুঁজছে পুলিশ।
৯ মাস গর্ভে থাকা সন্তান কেমন আছে জানতে ত্রিশালের অন্তঃসত্ত্বা রত্না বেগম শনিবার গিয়েছিলেন আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশাল কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় ট্রাকচাপায় রত্না, জাহাঙ্গীর ও তাদের মেয়ে সানজিদা মারা যায়।
দুর্ঘটনাস্থলেই মৃত মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়ে আসে শিশুটি। কান্নার আওয়াজে জীবিত বুঝতে পেরে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরে ময়মনসিংহ সিবিএমসিবি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।