দক্ষ জনবলের অভাব সেবা খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির অন্তরায়
কোভিড পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে সফটওয়্যার ও ডেটা প্রসেসিং এর বাড়তি চাহিদা তৈরি হলেও দক্ষ জনবলের অভাবে তা কাজে লাগাতে না পারায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরও খাতটি থেকে মাত্র ৪৭০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৩.৩১% বেশি।
২০২৫ সালের মধ্যে আইসিটি বিভাগ রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি করা সম্ভব না হলে ওই সময়ের মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানিও সম্ভব হবে না।
কোভিড পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে পর্যটনের ধুম পড়লেও এখাত থেকেও বাড়তি রপ্তানি আয় প্রত্যাশা করতে পারছে না সরকার।
মূলত ব্রান্ডিং এর অভাব এবং ব্যবস্থা ও সেবায় দুর্বলতার কারণে পর্যটন খাতে ৯% এর মতো রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
চলতি অর্থবছর পণ্যখাতে ৫৮ বিলিয়ন ডলার এবং সেবা খাতে ৯ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পর পণ্য ও সেবার আইটেমভিত্তিক রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)।
সেবা খাতে যে ১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারই আসবে বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের ডিপ্লোমেটিক মিশন এবং ইন্টারন্যাশনাল মিশন ও সংস্থাগুলোতে দেওয়া সরকারের বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্য বাবদ।
বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের ডিপ্লোমেটিক মিশন এবং ইন্টারন্যাশনাল মিশন ও সংস্থাগুলোতে দেওয়া সরকারের বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্য বাবদ চলতি অর্থবছর ২.৮ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ইপিবি। এরমধ্যে এসব অফিস ব্যবস্থাপনা থেকে আয় হবে ১.৩ বিলিয়ন ডলার এবং অফিস স্থাপনের খরচ থেকে আয় হবে ১.২ বিলিয়ন ডলার।
গত বছর ডিপ্লোমেটিক মিশন এবং ইন্টারন্যাশনাল মিশন ও সংস্থাগুলো থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ২.৫ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়া, সমুদ্র ও বিমান পরিবহন থেকে বিভিন্ন সেবা ও চার্টার ফি বাবদ বাড়তি ২০০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা আছে।
বিমান পরিবহন থেকে গত বছর বাংলাদেশ রপ্তানি আয় করেছে, ৯০৪ মিলিয়ন ডলার, যা চলতি বছর ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আর সমুদ্র পরিবহন থেকে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১০.৩০% বাড়িয়ে ৮৩০ মিলিয়ন নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের সেবার মান বাড়াতে পারলে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ খাত থেকে অনেক বেশি আয় করার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, আইসিটি রপ্তানি বা কম্পিউটার সার্ভিসেস- সফটওয়্যার, ডাটা প্রসেসিং, হোস্টিং সার্ভিস ও কম্পিউটার কনসালটেন্সি সার্ভিস থেকে গত অর্থবছর আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪১৪ মিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছর খাতটি থেকে আয়ের পরিমাণ ছিল ৩০৩ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর প্রেসিডেন্ট একেএম ফাহিম মসরুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কোভিডের পর বৈশ্বিক বাজারে আইসিটি সেবা রপ্তানির সুযোগ বাড়ছে এবং প্রচুর চাহিদাও রয়েছে। কিন্তু দক্ষ জনবলের অভাবে আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না।
তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে প্রবৃদ্ধি আশা করছে, তা হয়তো অর্জন করা সম্ভব হবে, কিন্তু এভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে ২০২৫ সালের মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলারও আয় করা সম্ভব হবে না।
'গত কয়েক বছরে সরকার আইসিটিখাতে দক্ষ জনবল তৈরিতে অনেক প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে, প্রচুর অর্থও খরচ করেছে। কিন্তু তা কোন কাজে লাগেনি, বরং অর্থের অপচয় হয়েছে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল নিশ্চিত করা গেলে আগামী তিন বছরের মধ্যে এখাত থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় সম্ভব', বলেন তিনি।
পর্যটন খাত থেকে বাংলাদেশ পর্যটক, বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ৩২১ মিলিয়ন ডলার, এ বছর ৩৫০ মিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শিবলুল আজম কোরেশী টিবিএসকে বলেন, বিদেশিরা বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ এবং থাকা-খাওয়াসহ বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশে যে অর্থ ব্যয় করে, তাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় বলে এটিকে রপ্তানি আয় হিসেবে গণ্য করা হয়।
তিনি বলেন, পর্যটন খাত থেকে আরও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ আছে এবং তা কাজে লাগাতে হলে বিদেশে বাংলাদেশের ব্রান্ডিং করতে হবে।
এছাড়া, ভিসা অন অ্যারাইভাল সুবিধাপ্রাপ্ত ৪১টি দেশের নাগরিকদের জন্য ই-ভিসা চালু করতে হবে। অনেক সময়ই দেখা যায়, বিদেশিরা ঢাকা এয়ারপোর্টে এসে নামার পর তাদের ভিসা দেওয়া হয় না, ফেরত পাঠানো হয়।
তিনি বলেন, এতে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়, ই-ভিসা চালু না হলে এই সংকট কাটবে না।
'পর্যটন থেকে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে হলে দেশের বিভিন্ন সেবার মান বাড়াতে হবে। বিদেশিরা ভ্রমণে এসে উপযুক্ত সেবা না পেলে তারা আসতে আগ্রহ হারাবে', বলেন তিনি।
রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস; প্রফেশনাল অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস; টেকনিক্যাল, বাণিজ্য সম্মপর্কিত এবং অন্যান্য ব্যবসা সেবা রপ্তানি থেকে চলতি অর্থবছর ১.১৬ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০.৫৩% বেশি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ড. মোস্তফা আবিদ খান টিবিএসকে বলেন, প্রফেশনালস ও ফ্রিল্যান্সাররা এ খাত থেকে আয় করেন। বাংলাদেশি কোনো গবেষক বিদেশি কোনো কাজে কনসালটেন্সি করলে যে ফি পাওয়া যায়, তা ডলারে পেমেন্ট হয় এবং রপ্তানি হিসেবে দেখানো হয়।
তিনি বলেন, ফ্রিল্যান্সাররা বিদেশে বিভিন্ন ডিজাইন বিক্রি করেও আয় করেন। এজন্য দক্ষতা বাড়ানোর উপর জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশের সেবাখাতের রপ্তানির আয়ের মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলার আসে কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস খাত থেকে, যার বড় অংশই দেশের ভেতরে রপ্তানি হয়।
যেমন, পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিংবা কর্ণফুলী টানেলের মতো প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদারদের বিভিন্ন পণ্য ও সেবা সরবরাহ করেছে আবদুল মোনেম লিমিটেড, বিএসআরএম, বসুন্ধরা গ্রুপসহ বিভিন্ন কোম্পানি।
বিদেশি ঠিকাদার কোম্পানিগুলো এসব পণ্য ও সেবামূল্য ডলারে পরিশোধ করে, যা রপ্তানি আয় হিসেবে বিবেচনা করে সরকার।
চলতি অর্থবছর এখাত থেকে ১.১৬ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ইপিবি, যা আগের বছরের চেয়ে ১৫% বেশি।
দেশীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা যতো বাড়বে, এ খাত থেকে আয়ের পরিমাণও ততো বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের সেবা খাতের দুবর্লতার কারণে এ খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রপ্তানি আয় সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে বাংলাদেশকে মূলত পণ্য রপ্তানির ওপরই নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে।
বহু বছর ধরে রপ্তানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণের কথা বললেও চলতি অর্থবছরের লক্ষমাত্রা অনুযায়ী, পণ্যখাতে ৫৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানি থেকেই ৪৬.৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হবে, যা মোট রপ্তানির প্রায় ৮১% এবং এটি আগের অর্থবছরের তুলনায় ৯.৮৩% বেশি।
ফার্মাসিউটিক্যাল খাতকে তৈরি পোশাক পরবর্তী সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রপ্তানিখাত হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও চলতি অর্থবছর এ খাত থেকে মাত্র ২৩০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২২% বেশি।
গত অর্থবছর পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও চলতি অর্থবছর এখাত থেকে রপ্তানিতে ১৩.৫১% প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করেছে ইপিবি। সংস্থাটি মনে করছে পাটপণ্যের উপর ভারতের বিদ্যমান অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার হতে পারে। এতে নেতিবাচক ধারা থেকে ইতিবাচক রপ্তানি ধারায় ফিরবে জুট ইয়ার্ন, জুট ব্যাগ ও বস্তা।
গত অর্থবছর জুট ইয়ার্ন রপ্তানিতে ১২.৬৭% নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও এবার ১৪.৬৫% ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে এবং জুট ব্যাগ ও স্যাক্স রপ্তানিতে গতবছর ১৪% নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও এবার ৯% প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে।
সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত হোম টেক্সটাইলখাতের রপ্তানি আয় এ বছর ২২% প্রবৃদ্ধি নিয়ে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার হবে বলে আশা করেছে ইপিবি। শুধু ক্যাপ রপ্তানি থেকেই এবছর ৪১০ মিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, গতবছর এর পরিমাণ ছিল ৩৬৪ মিলিয়ন ডলার।
এখন দেখার বিষয় এসব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় কি না।