তামাক নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতির পরিকল্পনা করছে সরকার
দেশে তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আরো কঠোর নীতির কথা ভাবছে সরকার।
'সিগারেট' এখনও অত্যাবশকীয় পণ্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত থাকায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে ২০ জুলাই বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষকে একটি চিঠি দেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের (এনটিসিসি) সমন্বয়ক (অতিরিক্ত সচিব) হোসেন আলী খোন্দকার।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৫৬ সংশোধন করে অত্যাবশকীয় পণ্যের তালিকা থেকে সিগারেটকে বাদ দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে এ চিঠিতে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. জাহিদ মালেকও এতে সম্মতি দিয়েছেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
৬৬ বছর আগে প্রণীত দ্য অ্যাসেন্সিয়াল কমোডিটি অ্যাক্টের আওতাভূক্ত কোনো পণ্য সারাদেশে অবাধে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিপণন করা যায় এবং দেশে জরুরি পরিস্থিতির সময়ও এসব পণ্য বিপণনে বাধা বা বিধি-নিষেধ আরোপ করা যায় না।
অত্যাবশকীয় পণ্যখাতে শ্রমিকরা ধর্মঘটও ডাকতে পারে না এবং কোন অত্যাবশকীয় পণ্য মজুদ করা যায় না।
এ কারণেই কোভিডের সময় সাধারণ ছুটি চলাকালে যখন দেশের প্রধান রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে যায়, তখনও সিগারেট কোম্পানিগুলো চালু ছিল।
সারাদেশে যাতে অবাধে সিগারেট বিপণন করা যায়, সেজন্য জেলা ঐসময় প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়।
পাকিস্তান আমলে প্রণীত এই আইনে আরও অনেক পণ্য রয়েছে যেগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে মোটেই অত্যাবশকীয় পণ্য নয়। ২০১৩ সালে সরকার এই তালিকায় সয়াবিন ও পামঅয়েল, হলুদ, মরিচ, জিরাসহ আরও বেশকিছু পণ্য অন্তর্ভূক্ত করলেও পুরনো তালিকা থেকে কোন পণ্য বাদ দেয়নি।
এই আইনের আওতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময় ভোজ্যতেল ও চিনির মূল্য নির্ধারণ করে এবং মজুদবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সিগারেট ছাড়াও ফ্ল্যাশলাইটের ব্যাটারি, সেলাই মেশিন এবং এর খুচরা যন্ত্রাংশ, টাইপরাইটার, টিম্বার, ৩৫ মিলিমিটার (সিনে) র ফিল্ম এর মতো পণ্যগুলো এখনও অত্যাবশকীয় পণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ ও ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন আয়োজিত সাউথ এশিয়ান স্পিকার্স সামিট এর সমাপণী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
"এ্যাসেন্সিয়াল কমোডিটি অ্যাক্টে সিগারেট অত্যাবশকীয় পণ্য হিসেবে তালিকাভূক্তির কারণে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী তামাকমুক্ত দেশ গড়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। তাই আইনটি সংশোধন করে সিগারেটকে অত্যাবশকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া জরুরি। এ প্রস্তাবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রীর সম্মতি রয়েছে," চিঠিতে লিখেছেন হোসেন আলী খোন্দকার।
এই আইনে সিগারেট অত্যাবশকীয় পণ্য হিসেবে তালিকাভূক্ত হওয়ায় ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। বরং এ্যাসেন্সিয়াল কমোডিটি অ্যাক্ট এই আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সিগারেটের ধোঁয়ায় সাত হাজারেরও বেশি রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ২৫০টি মানবদেহের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। এরমধ্যে ৭০টি রাসায়নিক মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য সরাসরি দায়ী।
তবে, সিগারেট সরকারের রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। ২০২১-২২ অর্থবছরে সিগারেট থেকে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পুরক শুল্ক বাবদ ২৭ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বৃহৎ করদাতা ইউনিট।
আগের অর্থবছর এটি ছিল ২৬ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। বৃহৎ করদাতা ইউনিটের বাইরেও বিভিন্ন ভ্যাট কমিশনারেটও সিগারেট থেকে রাজস্ব আহরণ করে।
এদিকে, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক সেবনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে সরকারের ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, প্রতি ৩০০টি সিগারেট তৈরির জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ গাছ কাটা পড়ছে এবং মাত্র একটি সিগারেট উৎপাদনের জন্য ৩.৭ লিটার পানির অপচয় হয়।