‘দিন: দ্য ডে’: দম ফাটানো হাসির অব্যর্থ টনিক!
বাংলা সিনেমার ইতিহাসে সেরা কমেডি সিনেমার তালিকায় অনায়াসে জায়গা করে নেবে অনন্ত জলিলের 'দিন: দ্য ডে'।
শতকোটি টাকা বাজেটের এ কৌতুকটি দেখতে গিয়ে আপনাকে হতাশ হতে হবে না, পকেটের টাকা গচ্চা গেল বলে আফসোস করতে হবে না। কারণ এ সিনেমার মতো প্রতি মিনিট অন্তর এত হাস্যরস হাল আমলের আর কোনো সিনেমায় আপনি দেখতে পাননি, এ হলফ করে বলতে পারি।
সাদা চামড়াদের ওপর ছড়ি ঘোরানোর যে চূড়ান্ত ফ্যান্টাসি বাঙালি চিরকাল মনে মনে লালন করে এসেছে, দিন: দ্য ডে সেই ফ্যান্টাসিকেই রুপালি পর্দায় আপনার সামনে উপস্থাপন করবে।
ভডভিল ধাঁচের কমেডি অভিনয় আর আশির দশকের বিদেশি সিনেমাগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ডাবিংয়ের মিলিত ফলাফল হলো অনন্ত জলিলের দিন: দ্য ডে। এ সিনেমার মোটামুটি ৮০ শতাংশ সংলাপের সঙ্গে শিল্পীর ঠোঁট নড়াচড়ার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আর সম্পাদনার এ হালের কারণে অভিনয়শিল্পীদের অখাদ্য অভিনয় আরও বিস্বাদে পরিণত হয়েছে। এর পাশাপাশি আরেকটি ব্যাপারও চোখে পড়ার মতো। সিনেমার মাঝখানে হুটহাট দ্রুতগতি আর স্লো-মোশনের খেলায় হলের ভেতরে এটি তৈরি করতে পেরেছে হিন্দি সিরিয়ালের সার্থক আবহ।
অনন্তের নামের মতো তার মেধাও যেন অনন্ত। নিজেই তিনি দিন: দ্য ডে প্রযোজনা করেছেন, আভিনয় করেছেন এমনকি গল্পও লিখেছেন। সংলাপ লেখার দায়িত্বটুকু সেরেছেন ছটকু আহমেদ। এ সুযোগে নিজের ইংরেজিটাও বেশ ঝালাই করে নিয়েছেন ভদ্রলোক।
এ সিনেমায় কোনো কথাই শোনার মতো বা সে দৃশ্য দেখার মতো ঠিক মনে হয় না। কিন্তু তা-তে অভিনয়শিল্পীদের ম্যাটিনি হিরোর মতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে সংলাপ ছোঁড়া আটকায়নি একটুও।
এ সিনেমা দেখার সময় 'গ্রামার নাৎসি'রা বারবার স্মরণ করিয়ে দেবে বাক্যগুলো শোধরানোর কথা, অনন্ত জলিল কীভাবে নিজের মতো করে ইংরেজি গ্রামারকে 'ব্যাকরণ মানি না' বলে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিয়েছেন সে কথা।
ইন্টারোগেশনের একটা দৃশ্যে আমরা অনন্ত জলিলকে শরীর ঝুঁকিয়ে, কণ্ঠে ভাবের কোনো ওঠানামা না করিয়ে বলতে দেখি, 'মজিদ, ইউ উইল বি ডাই হিয়ার।'
দিন: দ্য ডে সিনেমার প্লটটা যেন মানুষের আত্মার মতো। মানে বলতে চাইছি, মানুষের আত্মা আছে এটা সবাই জানে, কিন্তু আত্মাকে কেউ খুঁজে পায় না। দিন: দ্য ডে'র দশা হয়েছে একই। এটা আছে সেটা সবাই জানে, কিন্তু এর ভেতরে 'সিনেমা' খুঁজে পাওয়ার সাধ্য কারও নাই।
এটা দেখতে বসলে টাইম ট্রাভেলের অভিজ্ঞতাও নেওয়া যাবে। কারণ প্রতিটি দৃশ্যের পেছনে আবার ফ্ল্যাশব্যাকের ব্যবস্থা আছে যাতে আপনার ওই দৃশ্যটি কীভাবে এতদূর গড়াল সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা না হয়।
এ সিনেমা দেখার সময় আপনি ফোনের পাল্লায় পড়ে মনোযোগ হারাতেও পারবেন না, কারণ প্লটের এত গোলমেলে অবস্থা আপনাকে আগাগোড়া থ করে রাখবে।
বর্ষার পর্দায় আগমনের দৃশ্যটি আরো একবার মাথায় জট পাকিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। একটা স্কুলের সামনে তাকে দেখা যায় তিনটে 'ছেলেধরাকে' আচ্ছামতো ধোলাই দিতে। এরপর এক বাচ্চাকে উদ্ধার করে তার মায়ের ওপর আরেকচোট ঝাল ঝাড়েন তিনি। 'বাচ্চাকে একা ছেড়ে দেওয়ার' জন্য বর্ষা ওই মাকে দুকথা শোনানের পাশাপাশি দর্শকদের জন্য রাখা হয় ফ্ল্যাশব্যাকের ব্যবস্থা। এবারের ফ্ল্যাশব্যাকে দেখা যায় বাচ্চার মা পরকীয়ায় ব্যস্ত থাকার কারণে সন্তানের খেয়াল রাখতে পারেননি।
অনন্ত জলিলের মারদাঙ্গার দৃশ্যগুলোও একেবারে ভিন্ন মাত্রার। আশির দশকের অ্যাকশন হিরোদের কাজকারবারকেও লজ্জা পাইয়ে দিতে সক্ষম এগুলো। একদল গুণ্ডাকে ধাওয়া দিয়ে তাদের মাদকব্যবসায়ী পালের গোদাকে বন্দুকের মুখে কবজা করেন এজে।
শেষমেশ আর কোনো উপায় না দেখে তূণের শেষ বাণটি ছোঁড়েন ভিলেন মহাশয়। তিনি অনন্তকে তার কালোটাকার সম্পদ ফিফটি-ফিফটি ভাগের অফার দেন। এটা শুনে মুখে খানিক হাসি নিয়ে অনন্ত 'এই নে তোর ফিবটি' (দিস ইজ ইওর ফিবটি) বলে ভিলেইনের বুকে গুলি করেন।
এরপর ক্যামেরার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে লেন্সের দিকে সরাসরি তাকিয়ে হলে বসে থাকা হতভাগ্য দর্শকদের আত্মা পর্যন্ত দেখে ফেলা দৃষ্টি দিয়ে বলে ওঠেন, 'আর এটা হচ্ছে আমার ফিবটি।' এবার ক্যামেরা থেকে চোখ না সরিয়ে নিজের কাঁধের ওপর দিয়ে আরেকবার ভিলেইনকে গুলি করেন তিনি।
এভাবে বলতে গেলে এ সিনেমা নিয়ে বলা শেষ হবে না। এসব কিছু বিশ্বাস করতে হলে আপনাকে দিন: দ্য ডে দেখতেই হবে।
যে টেবিলে ছেলে পড়ালেখা করছে, সে টেবিলে এজে পেঁয়াজ কাটছেন, নারীবিদ্বেষী কৌতুকে সুর মেলাচ্ছেন, কখনো বউয়ের সঙ্গে প্রতারণা করার প্র্যাঙ্কও করছেন।
কেউ একবারও ভাবছে না কেন একই কক্ষের ভেতরে পেঁয়াজ কাটা, বচনামৃত প্রদান, আর পোশাক গোছানো হচ্ছে; বরং সব মনোযোগ গিয়ে থিতু হচ্ছে এজে'র কেশরতুল্য চুল ও তিনি তা কেন কাটেননি সে বিষয়ের ওপর।
দিন: দ্য ডে'র সিনেমাটোগ্রাফি ও আর্ট ডিরেকশন খুবই দুদার্ন্ত (খেলো অর্থে) কিন্তু ভাব এমন, ভীষণ 'সিরিয়াস'ভাবে কাজগুলো করা হয়েছে। আরেকটা ভুল বা সিরিয়াস কাজ করেছেন কলাকুশলীরা! পুরো সিনেমাটা আইম্যাক্সে শ্যুট করা হয়েছে (এটা জানার পর এখন থেকে এ সিনেমার বাজেট নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে দ্বিতীয়বার ভাববেন), কিন্তু হলগুলোর একটা বড় অংশই রেগুলার অ্যাসপেক্ট রেশিওতে দেখাচ্ছে সিনেমাটি। এর ফলে কাটা পড়ে গেছে সিনেমার নিচের এক তৃতীয়াংশ। আইম্যাক্সে শ্যুট করার এই সুফল!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হালে পানি পাচ্ছে না দিন: দ্য ডে। সমালোচকরাও বোধহয় বেশিই 'উন্নাসিক' হয়ে উঠেছেন দিন: দ্য ডে'র ক্ষেত্রে।
কন্টিনিউটি, যৌক্তিক গল্প, আর কমনসেন্স খোঁজা দর্শকগুলোই এসব তালগোল পাকাচ্ছে। এরা দুর্মুখ। নিঃসন্দেহে এ বছর সিনেমা হলে দিন: দ্য ডে আপনাকে সর্বোচ্চ বিনোদন দেবে। কাজেই অদূর ভবিষ্যতে 'আরেক দিন: অ্যানাদার ডে' দেখার যেন সুযোগ হয়, তা নিশ্চিত করতেই দয়া করে হলে গিয়ে দিন: দ্য ডে দেখে আসুন।