‘ইস্তাম্বুলে’ই মিলবে অথেনটিক টার্কিশ খাবার!
টার্কিশ খাবার নিয়ে একধরনের মাদকতা রয়েছে বিশ্বজুড়ে। খাবারের স্বাদ বা পরিবেশনের দিক থেকে অটোম্যান সাম্রাজ্যের ধারা এখনও দেশটি বজায় রেখেছে বহাল তবিয়তে। স্বাদ আস্বাদনে অদম্য কৌতূহল নিবারণে চলে যাওয়া একটুকরো 'ইস্তাম্বুলে'।
কী ভাবছেন, খাবারের স্বাদ পেতে সরাসরি ইস্তাম্বুল? না, ঐতিহ্যবাহী এ খাবারের স্বাদ পেতে তুরস্কের বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত 'ইস্তাম্বুল' নামের রেস্টুরেন্টটিতে মিলবে অথেনটিক স্বাদের টার্কিশ খাবার।
ভোজনরসিকদের কাছে বেশ পরিচিত আলো-আবছায়ায় ঘেরা রেস্টুরেন্টটির ভেতরে প্রবেশের সময় দরজার দুপাশে বাংলাদেশ ও তুরস্কের সুশোভিত পতাকা স্বাগত জানাবে আপনাকে। বড় হলরুমটির শেষমাথা পর্যন্ত একটু পরপর সাজানো বিভিন্ন আকৃতির রং-বেরঙের লণ্ঠন, দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতি অনায়াসেই কেড়ে নেবে মন।
দেয়ালজুড়ে ছোট ছোট জানালা, তার ওপাশে সাজিয়ে রাখা লণ্ঠন একইসঙ্গে সৌন্দর্যবর্ধন আর আলোক চাহিদা দুই-ই পূরণ করছে স্বাচ্ছন্দ্যে। আর একটু পরপর সাজিয়ে রাখা চিত্রকর্মগুলো মুহূর্তের জন্য হলেও আপনাকে নিয়ে যাবে তুরস্কের নাম না জানা কোনো ঐতিহাসিক শহরে!
অন্দরসজ্জার কৃতিত্ব পুরোটাই তুরস্কের নাগরিক আলী গন্সের। পেশায় রন্ধনশিল্পী গন্সের রান্নার পাশাপাশি রুচির তারিফ করতেই হয়। ২০১৩ সালে এমকে গ্রুপের তত্ত্বাবধানে তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাণিজ্যের কারণে প্রায়ই তুরস্কে যাওয়া-আসা ছিল গ্রুপটির একজন ব্যবসায়ীর। সে সময় তুরস্কের ইস্তাম্বুল নামে একটি রেস্তোরাঁয় প্রায়ই বসতেন ওই ব্যবসায়ী। খাবারের স্বাদ ও পরিবেশনের ধরন বেশ ভালো লেগে যাওয়ায় রেস্টুরেন্টটির মালিকের ছেলে আলী গন্সকে বাংলাদেশে একই ধরনের একটি রেস্টুরেন্ট চালানোর অনুরোধ করেন তিনি।
পরে ভাইকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন আলী গন্স। প্রথমে বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে পার্টনারশিপে গুলশানের ১১৩ নম্বর রোডে চালু করা হয় রেস্টুরেন্টটি। ২০১৯ সালের নভেম্বরে করোনাভাইরাসের আগ দিয়ে এ রেস্টুরেন্টটি গুলশান ২-এর ৫৩ নং সড়কে স্থানান্তর করা হয়। তবে বর্তমানে কেবল এমকে গ্রুপই এর মালিকানায় রয়েছে বলে জানালেন রেস্টুরেন্টটির ইনচার্জ ফারজানা ইসলাম।
শুরু থেকেই আলী গন্স তুরস্কের ইস্তাম্বুলের মতো করেই এ রেস্টুরেন্টটি সাজান। তাই ঘরের প্রতিটি কোণের সাজসজ্জাতেই রয়েছে তুরস্কের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা।
চা হাজির
রেস্টুরেন্টটির সজ্জা দেখতে দেখতেই টার্কিশ চা না কফি খাব জিজ্ঞেস করতে ওয়েটারের আবির্ভাব। তার মুখ থেকেই শুনলাম চা বা কফি দিয়ে আপ্যায়ন করাটা টার্কিশ রীতি। বাঙালিদের সঙ্গে এদিক থেকে কিন্তু মিল রয়েছে।
তবে চা দেওয়ার পাত্রটি বেশ আলাদা। একে ঠিক কাপ বা মগ বলা যাবে না, কিছুটা গ্লাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক ধরনের পাত্র দিয়ে তুরস্কে চা খাওয়া হয়, এ রেস্টুরেন্টেও একই পদ্ধতি। স্বাদেও বেশ সন্তোষজনক।
অ্যাপিটাইজার পর্ব
চা পর্ব শেষ না হতেই অ্যাপিটাইজার হিসেবে চলে এলো রুটি আর সালাদভর্তি দুটি প্লেট। একে ঠিক সালাদ না বলে ভর্তা বললেও ভুল হবে না। এক প্লেটে হাজির হামুস, বাবাগনেস, ইজমি, হাইদারি, পালতিকান! প্রত্যেকটিই মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী সব আইটেম।
এরমধ্যে ছোলাদানার সঙ্গে তাহিনি, লেবুর রস আর রসুন দিয়ে তৈরি হামুস গ্রিসের না তুরস্কের এ নিয়ে দ্বন্দ্ব আজকের নয়। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম এ খাবারটির কথা সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে বলেও দাবি ইহুদিদের।
তুর্কিদের বেগুন, ক্যাপসিক্যাম, টমেটো খুব প্রিয় খাবার। তার প্রমাণ পেলাম সালাদের এ প্ল্যাটারটিতে। বেগুন দিয়ে তৈরি বাবাগনেস নামক এ আইটেমটি খুব জনপ্রিয়, গ্রিল বা রোস্টেড বেগুনের সঙ্গে তাহিনি, অলিভ অয়েল ও আরও বেশকিছু উপকরণ দিয়ে তৈরি এ আইটেমটিকে বেগুন ভর্তাও বলা যাবে না। এক টুকরো রুটি বাবাগনেসে মাখিয়ে মুখে দিলে আরামে চোখ বন্ধ হয়ে যাবে এটি নিশ্চিত।
টমেটো পিউরি আর অলিভ অয়েলের সঙ্গে অন্যান্য আনুষঙ্গিক দিয়ে একটু টক, হালকা ঝাল আর কিছু মিষ্টি এ আইটেমটি টার্কিদের সবচেয়ে কমন একটি খাবার। এরপর টকদই দিয়ে তৈরি হাইদারি বা বেগুনের কিছুটা খাট্টামিঠাজাতীয় আইটেম পালতিকানসহ সবকিছুই রুটি দিয়ে খেতে অনন্য।
আর রুটি! অ্যাপিটাইজার হিসেবেই এলো সিমিট, পিট্টা, রামাদান নামে তিন ধরনের রুটি। হালে বেকারির রুটি জায়গা করে নিলেও ওসমানীয় বা অটোমান সাম্রাজ্যের সময়ও তুরস্কে রুটির বিশেষ করে হাতে বানানো রুটির চাহিদা ছিল অনেকবেশি। সেই ধারাই বজায় রেখেছে ইস্তাম্বুল। কেননা রেস্টুরেন্টটির প্রত্যেকটি রুটিই নিজেদের বানানো।
এরপর এলো ঐতিহ্যবাহী লামাচান। আরবি শব্দ লামাচানের মানে করলে দাঁড়ায় ময়দার দো'র ওপরে মাংসের কিমা। রুটির চেয়ে পুরু কিন্তু নানের চেয়ে পাতলা, মুচমুচে, একইসঙ্গে পিজ্জার চেয়েও আরও মসৃণ মাংসের কিমা ও টমেটোর প্রলেপ দেওয়া এই খাবারটি যখন পাপরিকা দিয়ে মাখানো পেঁয়াজ এবং টমেটো দিয়ে পরিবেশিত হবে, তখন অদ্ভুত এক ভালোলাগা খানিকের জন্য আপনার মন যে ছুঁয়ে যাবে, সে তো বলাই বাহুল্য।
একসঙ্গে এত কিছু!
কী নেই এক প্ল্যাটারে! চিকেন, বিফ দিয়ে তৈরি দুরকমের আদানা কাবাব, ডোনার কাবাব, শিশ কাবাব, ল্যাম্বের ড্রাম স্টিক সঙ্গে আবার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। বাহারি স্বাদের এসব কাবাব কী দিয়ে খাবেন, এটি নিয়ে আলাদা করে ভাবার প্রয়োজন নেই, কেননা এখানেও রয়েছে সেই সিমিট, রামাদান আর পিট্টা রুটি! আর প্ল্যাটারটির একপাশে সাজানো লামাচান তো রয়েছেই।
টার্কিশ রান্নার অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে, এতে ঝাল থাকে না। তাই পোলাউয়েও ঝাল নেই বললেই চলে। তাই বলে অল্প কিছু মশলার অনবদ্য স্বাদ কিন্তু উপেক্ষার সুযোগ নেই। মজার বিষয় হচ্ছে, পোলাউয়ের শেষের দিকে দেখা মিলবে নিচে আরেক লেয়ারে সাজানো বেশকিছু রুটির অস্তিত্ব। এবারেও সেই পিট্টা রুটি।
আর এসব খাওয়ার জন্য মরিচ দিয়ে পেঁয়াজ মাখানো, ধনেপাতা কুচি ও টকদই তো রয়েছেই সঙ্গে। ৭টি আইটেম দিয়ে সাজানো এ কাবাব প্ল্যাটারটি দুজনের জন্য বলা হলেও তিনজনের হয়ে যাবে চোখ বুজে।
আর স্বাদ! প্রতিটি কাবাবই তার নিজস্ব স্বাদে অনন্য। গরু আর ভেড়ার মাংসের কিমা দিয়ে তৈরি ডোনার কাবাব মুখে দিলে মিলিয়ে যাবে। পাতলা স্লাইস আর তেল মশলার পরিমিত ব্যবহারের কারণে স্বাচ্ছন্দ্যে খেয়ে ফেলা যায় বেশ অনেকখানি।
বিখ্যাত টার্কি কাবাব আদানা বা শিশ কাবাব, স্বাদে আলাদা হলেও দুটোই মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়। কাবাবগুলো নরম হওয়ার পেছনে ওসমানীয় বা অটোম্যানদের সুলতানদের ভূমিকা প্রচুর।
জানা যায়, ওসমানীয় সুলতানদের সামনে নাকি আস্ত মাংসের কাবাব হাজির করতে হতো। তবে সেসব কাবাব খেতে তারা কোনো কাঁটাচামচ বা অন্য কোনো চামচ ব্যবহার করতেন না। সুলতান বলে কথা! তাই খাওয়ার সময় যাতে তাদের আলাদা করে কোনো শ্রম না দিতে হয়, কেবল হাত দিয়ে মাংস ছিঁড়ে খেতে পারেন, সেজন্য তখন থেকেই যেকোনো মাংস বা কাবাব-জাতীয় খাবার হতে হতো খুব নরম।
খাবার শেষে মিষ্টিমুখ না করলে কি হয়! এলো বিখ্যাত বাকলাভা। প্রথমে মুখে দিলে মনে হবে মুচমুচে কিছু, মুহূর্তেই মিষ্টির শিরা আর পেস্তা বাদাম গুঁড়ার এক অনবদ্য মিশ্রণ এ ধারণা বদলে দেবে নিমিষেই। মিষ্টিপ্রেমীদের তো বটেই, যারা ভালোবাসেন না এমন তাদেরও মন কেড়ে নেবে সহজেই।
তুরস্কের অথেনটিক স্বাদ কেন পাওয়া যাবে `ইস্তাম্বুলে'
তুরস্কের অন্যতম প্রধান খাবার হচ্ছে কাবাব। আর যে কাবাবই খেতে চাইবেন, রুটি থেকে শুরু করে আনুষাঙ্গিক সবকিছুই কাবাবটির সঙ্গে পরিবেশিত হবে অনেকটা প্ল্যাটারের মতো।
অর্থাৎ যে কাবাবই অর্ডার করা হোক, পরিবেশনের সময় বেশ কয়েক ধরনের রুটি, পোলাউ, সবজি, সালাদ সবকিছুই থাকবে বড় ওই ডিশে। তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী এ খাবার পরিবেশনের ধরনটি ধরে রেখেছেন আলী গন্সও, এমনটি বলছিলেন রেস্তোরাঁটির ইনচার্জ।
তুরস্কের অথেনটিক স্বাদ কেন পাওয়া যাবে 'ইস্তাম্বুলে'—এর পেছনের কারণ হিসেবে ফারজানা জানালেন, রন্ধনশিল্পী গন্সের অনুরোধে খাবারের স্বাদ যাতে ঠিক থাকে, সেজন্য মাখন থেকে শুরু করে এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ও সানফ্লাওয়ার অয়েল এই তিন আইটেম ছাড়া অন্য কোনো তেল বা এ জাতীয় কিছু ব্যবহার করা হয় না ইস্তাম্বুলে।
এছাড়া খাবারের স্বাদ ও মান ঠিক রাখতে ড্রাই মিন্ট, চা, কফি, চিজ বানানোর কাঁচামাল মায়াচান, সালাদে ব্যবহারের জন্য সুমান নামে টকজাতীয় বেশকিছু আইটেম সরাসরি নিয়ে আসা হয় তুরস্ক থেকে। এ কারণে খাবার তৈরিতে খরচ কিছুটা বেশি হয়ে যায় বলে জানালেন তিনি। এছাড়া অন্যান্য সব আইটেম তৈরিতে যত উপকরণ প্রয়োজন হয় তার সবই গন্সের শেখানো পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় রেস্টুরেন্টটিতেই।
মাংসের যে আইটেমগুলো রয়েছে সেগুলো রেস্টুরেন্টের পক্ষ থেকেই প্রস্তুত করা হয়। বিশেষ করে বাজার থেকে কেনা কিমার ব্যবহার কখনোই করা হয় না। পুরো মাংস কিনে এনে এরপর রেস্টুরেন্টটিতেই প্রসেস করা হয়। শুধু ফ্রিজ ব্যবহার করে মাংস ভালো রাখা যায় না তাই প্রসেসিংয়ে সুবিধা ও তাপমাত্রার সঠিক নিয়ন্ত্রণের জন্য চিলার ব্যবহার করা হয় রেস্টুরেন্টটিতে। ৭৫ বর্গফুটের এ চিলারটি আনা হয়েছিল আলী গন্সের কথায়। কাবাব ও রুটি তৈরিতে সুবিধার জন্য রান্নাঘরেই রয়েছে কয়লা দেওয়া বড় উনুনের ওভেন।
রেস্টুরেন্টটির খাবার অথেনটিক হওয়ার পেছনে আরেকটি মূল কারণ এর শেফ বা বাবুর্চিরা। প্রধান শেফ থেকে শুরু করে তাদের সহকারী মোট ১৬ জনের প্রত্যেককেই নিজ হাতে রান্না ও এর আনুষঙ্গিক কাজ শিখিয়েছেন তুরস্কের রন্ধনশিল্পী আলী গন্স।
খদ্দের কারা
খদ্দের নিয়ে ফারজানা ইসলাম জানালেন, ইস্তাম্বুলের বেশিরভাগ খদ্দেরই বিদেশি অথবা ব্যবসায়ী শ্রেণির। ফলে ভিড়ভাট্টা খুব একটা নেই বললেই চলে রেস্টুরেন্টটিতে। তাই টার্কিশ মিউজিকের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কাটানো সময়টুকু বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে সহজেই।
যদিও সম্প্রতি কমবয়সীদের কথা বিবেচনায় রেখে নতুন করে প্ল্যাটার বানানো হচ্ছে বলেও জানালেন তিনি।
দাম কেমন
ভেড়া ও গরুর কাবাবগুলো এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাবে। এছাড়া রয়েছে একটি শেয়ারিং প্ল্যাটার। সেখানে একজনের জন্য প্ল্যাটার থেকে শুরু করে ৮ জন একসঙ্গে বসে খেতে পারবে এমন প্ল্যাটারও রয়েছে।
একটি কাবাব অর্ডার করলেই রুটি থেকে শুরু করে সবজি, সালাদসহ অন্যান্য সব আনুষঙ্গিক দেওয়া হয় গ্রাহকদের। এছাড়া সব রান্নায় পেস্তা, চিজ, বাটার, জলপাই অলিভ অয়েল বেশি ব্যবহৃত হয়। তাই আপাতদৃষ্টিতে দাম কিছুটা বেশি মনে হলেও, খাবারের পরিমাণ দেখে ও খেয়ে মান নিয়ে সন্তুষ্ট হতে বাধ্য হবে সবাই—এমনটিই দাবি ফারজানার।