আর্কিটেক্ট থেকে গারবেজম্যান, বর্জ্য নিয়ে তার কাজ
যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই
পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন!
দেড়শো বছর আগে কবি ছাই উড়িয়ে অমূল্য রতন খোঁজার উপদেশ দেওয়ার সময় কি ভেবেছিলেন একসময় ময়লা-আবর্জনা 'উড়িয়ে' রতন খুঁজে পাওয়া যাবে! জঞ্জাল ভেবে ফেলে দেওয়া জিনিসকে রূপান্তরিত করা যাবে মূল্যবান ব্যবহার্যে! উন্নত দেশে কিন্তু আবর্জনা থেকে এই রতন খুঁজে বের করার কার্যক্রম এতদিনে বেশ পরিচিত। বর্তমানে আমাদের দেশেও বর্জ্য রিসাইকেল করে মূল্যবান সম্পদে পরিণত করার কাজ করছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে অন্যতম "গারবেজম্যান"।
আর্কিটেক্ট থেকে হলেন গারবেজম্যান
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেকচারে গ্র্যাজুয়েশন শেষে ঢাকা শহরের নানা সমস্যা নিয়ে বিচলিত ছিলেন ফাহিম উদ্দিন শুভ। বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচার নিয়ে যা শিখেছেন তার সাথে বাস্তবতাকে মেলাতে পারছিলেন না তিনি। অপরিকল্পিত ভবন, ময়লা-আবর্জনায় ঢাকা রাস্তাঘাট, আর অদক্ষ শহর ব্যবস্থাপনাকে এড়িয়ে শিক্ষাজীবনের নান্দনিক ভবন নকশা করার বিদ্যাকে প্রয়োগ করতে পারছিলেন না কর্মজীবনে। কিন্তু আর্কিটেক্ট হিসেবে সমস্যা সমাধান করাও তার কাজের একটা বড় জায়গা। শহরের এই নানাবিধ সমস্যা সমাধানকেই তাই তিনি মূল লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিলেন। শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক করে সাজিয়ে সেই বর্জ্য থেকেই যেন অর্থ উপার্জন করা যায় সেই চিন্তায় ২০১৭ সালে শুরু করেছিলেন গারবেজম্যানের পরিকল্পনা। ফাহিমের ভাষ্যে, "'ক্লিনার' ও 'গ্রিনার' ঢাকা গড়ার স্বপ্ন থেকেই আমাদের কাজের শুরু।"
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ইন্টারন্যাশনাল আর্কিটেকচার কনফারেন্স "এনগেজ ঢাকা"-তে দেশ-বিদেশের বরেণ্য আর্কিটেক্টদের আলোচনা থেকে কাজের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ফাহিম। কনফারেন্সে পাওয়া আইডিয়া সম্প্রসারিত করতে ৭ জনের দল নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি।
কাজ শুরু বাসার ছাদে
ঢাকার দক্ষিণখানের যে বাসায় তিনি থাকেন সে বাসাতেই ১২টি ফ্ল্যাটে দুইটি করে ময়লা ফেলার বালতি রেখে এসেছিলেন শুরুতে। পচনশীল বর্জ্য ফেলার জন্য একটি বালতি আর অপরটি ছিল অপচনশীল বর্জ্যের জন্য। পুরো বাসার ময়লা সংগ্রহ করে সেগুলো ছাদে জমা করে বানিয়েছিলেন কেঁচো সার। প্লাস্টিকের মতো অপচনশীল আবর্জনাগুলো পুনঃব্যবহার করে নতুন কিছু তৈরির চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চাইলে বড় পরিসরে কাজ শুরু করতে হবে, বুঝতে পারেন কাজ এগোতে গিয়ে।
ফাহিমের কাছে সমাজ সেবা মানে শুধু চ্যারিটি বা দান করা না। নিজের ব্যবসায়িক মডেলকে বাস্তবায়িত করে শহরের সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে সমাজ সেবা করতে চেয়েছিলেন তিনি। শুরুতে একটি আর্কিটেকচারাল ফার্মে কাজ করলেও গারবেজম্যানের আইডিয়াকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে সে চাকরি ছেড়ে দেন ফাহিম উদ্দিন শুভ। সেসময়ে ব্যবসায়িক আইডিয়া নিয়ে নানা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন তিনি। একপর্যায়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ থেকে ১০ লাখ টাকার সরকারি অনুদান পায় গারবেজম্যান।
"নাথিং ইজ আ ওয়েস্ট"
"নাথিং ইজ আ ওয়েস্ট"- স্লোগান নিয়ে দক্ষিণখানে ২০০০ বর্গফুট জায়গা নিয়ে শুরু হয় গারবেজম্যানের প্রথম ফ্যাক্টরি। এই কাজে মানুষকে সচেতন করা ছিল তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। সাধারণ ময়লা-আবর্জনাও যে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার হতে পারে সে বিষয়ে ধারণা ছিল না অধিকাংশেরই।
"ব্যবসায়িক প্রজেক্টের প্রাথমিক পর্যায়ে ৩০টি চায়ের দোকান, দুইটি রেস্টুরেন্ট আর একটি কাঁচাবাজারের বর্জ্য সংগ্রহ করে সেগুলো পুনঃব্যবহার উপযোগী করার উদ্যোগ নেই আমরা," বলেন ফাহিম। পচনশীল বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে ভার্মিকম্পোস্ট তৈরি করেন শুরুতেই। মাটির উর্বরতা বাড়িয়ে গাছকে শক্তিশালী করে তুলতে সার হিসেবে জনপ্রিয় এই ভার্মিকম্পোস্ট। গারবেজম্যানের এই ভার্মিকম্পোস্টের ক্রেতা হলেন ছাদবাগানীরা।
ট্র্যাশ টু ক্যাশ
পচনশীল বর্জ্যের পাশাপাশি অপচনশীল বর্জ্য সংগ্রহের জন্যও গারবেজম্যানের আছে অভিনব ব্যবস্থা। গারবেজম্যানের ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করে সাধারণ মানুষ বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তাদের বাড়ির অপচনশীল আবর্জনা জমা দিতে পারে তাদের কাছে। শিডিউল করা সময়ে গারবেজম্যানের কর্মীরা নির্দিষ্ট বাসাগুলো থেকে সেই আবর্জনাগুলো নিয়ে যায় তাদের কারখানায়। বিনিময়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কেনাকাটায় নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাড় পাওয়ার সুযোগ থাকে বর্জ্য জমাকারীদের।
এসব অপচনশীল বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে বেশ কিছু রিসাইকেলার প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করে গারবেজম্যান। বর্তমানে ঢাকার ১৪টি পয়েন্টে বাসা-বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা চালু আছে তাদের।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোই বর্জ্যের বড় জোগানদার
বর্জ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় সাথে সাধারণ মানুষ খুব একটা পরিচিত না হওয়ায় সৃষ্টি হয় বেশ কিছু সমস্যা। পচনশীল আর অপচনশীল বর্জ্য আলাদা না রাখতে পারা, ঠিকভাবে বর্জ্য সংগ্রহ করে আনতে না পারায় সময়, শ্রম ও অর্থের ব্যয় বাড়ে। তাই ব্যবসায়িক লক্ষ্য ঠিক রাখতে ফাহিম সিদ্ধান্ত নেন যারা এই কাজের সাথে আগেই কিছুটা পরিচিত আর আগ্রহী তাদের সাথেই বড় পরিসরে কাজ করবেন। সে লক্ষ্যেই ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, ইউনিলিভারের মতো বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি হয় গারবেজম্যানের। সময়ভেদে এমন প্রতিষ্ঠান থেকে রোজ ৫০০ কেজি থেকে ৮০০ কেজি বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারতেন তারা। ২০২০ সাল থেকে ধউর, কামারপাড়ায় ৫০০০ বর্গফুট জায়গায় গারবেজম্যানের নতুন ওয়্যারহাউজে হচ্ছে তাদের সবধরনের কাজ।
কয়েকমাস যাবত পচনশীল বর্জ্য সংগ্রহ বন্ধ রেখেছেন তারা। বিশাল পরিসরে এসব বর্জ্য থেকে ভার্মিকম্পোস্ট বানাতে যে জায়গা ও জনবল দরকার আপাতত তা জোগাড় করতে পারছে না গারবেজম্যান।
কাজ করেছেন ইউএনডিপি, ডব্লিউএফপি-র মতো সংস্থার সাথে
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী (ইউএনডিপি) ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী (ডব্লিউএফপি)-র সহযোগী হয়ে গারবেজম্যান কাজ করেছে কক্সবাজার ও উখিয়ায়। সেখানকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সাপ্লাই চেইন নির্মাণ করতে ইউএনডিপির সহযোগী হয়েছে গারবেজম্যান। ডব্লিউএফপি-র সহযোগী হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ফুড প্যাকেজিং-এর বর্জ্য সংগ্রহ করে সেগুলো রিসাইকেল করার ব্যবস্থা করেছে তারা।
ফাহিম বলেন, "ফুড প্যাকেজিংয়ের অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল পেপারগুলো সংগ্রহ করে আমরা সেগুলো দিয়ে নতুন জিনিস বানানোর ব্যবস্থা করেছি। কমার্শিয়াল আর কমিউনিটি বেজড- দুইভাবে এই কাজটা হত। কমার্শিয়ালভাবে এই ফয়েল পেপার দিয়ে মানিব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, স্কুল ব্যাগ ইত্যাদি তৈরি করা শিখিয়েছি আমরা রোহিঙ্গাদের। আর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন অনুসারে তাদের জন্যও নানা সামগ্রী বানানোর ট্রেনিং দিয়েছি এগুলো দিয়ে।"
সচেতনতা কার্যক্রম
পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত ঢাকা গড়ে তুলতে প্রতিনিয়ত সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে চাচ্ছেন গারবেজম্যানের সদস্যরা। ফাহিম বিশ্বাস করেন শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঠিক করে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলতে এখানকার বাসিন্দাদের সচেতনতার বিকল্প নেই। অনলাইন ও অফলাইনে কিছুদিন পরপরই সাধারণ মানুষের সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন আয়োজন করেন তারা।
গত ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির সাথে টিএসসিতে আয়োজন করেছেন সচেতনা তৈরির প্রোগামের। যেখানে বিভিন্ন গেম, কুইজ ও পরিষ্কার কার্যক্রমের মাধ্যমের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জানানোর চেষ্টা করে গারবেজম্যান।
করোনায় বর্জ্য সংগ্রাহকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পিপিই-র ব্যবস্থা করাসহ স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে তাদের সচেতন রাখতে কাজ করেছে গারবেজম্যান।
ছিল পরিবারের অমত
আর্কিটেকচারের মতো সম্ভাবনাময় বিষয়ে পড়াশোনা শেষে নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে ক্যারিয়ারে নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়া, তাও আবার কাজ করবেন আবর্জনা নিয়ে! ফাহিম উদ্দিন শুভর এই সিদ্ধান্তে তার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব কারো সম্মতি ছিল না শুরু থেকে। তবু নিজের পরিকল্পনার উপর আস্থা রেখে নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন তিনি। এখনো বন্ধুবান্ধব অনেকের মতো কর্মক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ হয়নি, কিন্তু নিজের কার্যক্রমে সন্তুষ্ট তিনি। নিজের প্যাশনকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য পরিশ্রম করে যেতে চান ভবিষ্যতেও।
দেশে তারাই একমাত্র নন
দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পুনঃব্যবহারের মতো কাজে গারবেজম্যান ছাড়াও আছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ফাহিম জানান, গারবেজম্যানের অনেক আগেই ২০০৮ সালে বাংলাদেশে কাজ শুরু করে "ওয়েস্টেক"। এছাড়াও দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় "ওয়েস্ট কনসার্ন", "বিডি রিসাইকেল" এর কাজ অন্যতম। তবে ফাহিমের ভাষ্যে, "গারবেজম্যানের মতো বড় ক্যাপাসিটিতে দেশে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করছে না এখনো। এই সেক্টরে কাজ করার বিশাল সুযোগ আছে। আমাদের মতো আরো নতুন পাঁচটা প্রতিষ্ঠান এই কাজ শুরু করলেও তা আমাদের জন্য কম্পিটিশনের ব্যাপার হবে না।"
৫ মাসে ৫০০ টন বর্জ্য সংগ্রহ করার লক্ষ্য
বর্তমানে গারবেজম্যানের ওয়্যারহাউজে দিনে ৫০০ কেজির মতো বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। তবে এবছর আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৫০০ টন বর্জ্য সংগ্রহ করে রিসাইকেলের জন্য প্রক্রিয়াজাত করতে চান ফাহিম উদ্দিন শুভ।
গারবেজম্যানের পরিচালনার দায়িত্বে ফাহিমসহ এখন কাজ করেন মোট ৮ জন। এছাড়াও সার্বক্ষণিক ১০ জন শ্রমিক বর্জ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতের কাজ করেন।
সাধারণ মানুষ যেন শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে এগিয়ে আসে, নিজেদের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয় তা-ই চাওয়া ফাহিমের। কোনো বর্জ্যই ফেলনা না- এই ধারণা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চায় গারবেজম্যানের দল।