রাজধানীতে পানির সংকট, ওয়াসা বলছে কারণ লোডশেডিং
রাজধানীর মাতুয়াইলের ডগাইর এলাকার মাজার রোডের বাসিন্দা শমসের আলী। গত কয়েকদিন ধরে এ এলাকায় ওয়াসার পানি সরবরাহ নেই। ওয়াসার লাইনের পাইপ ফেটে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে বলে জানান তিনি। তাই বাধ্য হয়ে পানি কিনে এবং যেসব স্থানে গভীর নলকূপ বসানো আছে সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করে তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ সারছেন।
শমসের আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল ওয়াসার লাইনের পানি নেই। এ এলাকার মানুষ বেঁচে আছে কিনা সে বিষয়েও ওয়াসার কর্তাব্যক্তিদের কোনো খোঁজ নেই। এ বিষয়ে অভিযোগ জানালেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। লাইনের পাইপ ফাটাকে অযুহাত দেখাচ্ছে।'
মাতুয়াইল এলাকার এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমাদের এ এলাকায় বরাবরই ওয়াসার পানিতে সমস্যা। নির্দিষ্ট সময়ে পানি ধরে রাখতে হয় আবার মাঝে মাঝে ২/১ দিন থাকেই না। পানির গন্ধ তো আছেই। তাই আমরা কয়েকজন বাড়িওয়ালা মিলে গভীর নলকূপ বসিয়ে নিয়েছি। অনুমোদন নেই বলে চুরি করে চালাতে হয়।'
'পানির এতো সমস্যা থাকলে মানুষ তো একটা না একটা পন্থা বের করে নিবেই। সেটার অনুমোদন আছে কি নেই সেটা ভাবার থেকে সমস্যা সমাধান জরুরি' বলেন তিনি।
শুধু মাতুয়াইল এলাকায়ই নয় বেশ কয়েকদিন ধরে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় ওয়াসার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বাসিন্দারা বলছেন, দিনে কেবল দু-একবার পানি আসে, সারাদিন আর পানি থাকে না।
রাজধানীর মাতুয়াইল, জুরাইন, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, উত্তর বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, কুড়িল, ভাটারা, রূপনগর, কালাচাঁদপুর, মিরপুর, আগারগাঁও, রায়েরবাজারসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশ কয়েকদিন ধরেই এসব এলাকায় পানির সংকট রয়েছে। কিছু এলাকার পানিতে দুর্গন্ধও পাচ্ছেন এলাকাবাসী।
ঢাকা ওয়াসা বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে দিনে দুই-তিনবার লোডশেডিং এর কারণে পাম্প থেকে পানি উত্তোলন ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায়, কিছু কিছু এলাকায় পানির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তবে ওয়াসার দাবি কোথাও পানির লাইনে সমস্যা নেই। পানির উৎপাদনে ঘাটতির কারণেই কিছু কিছু এলাকায় পানির সংকট দেখা দিচ্ছে বলে দাবি ওয়াসার।
রাজধানীর বাড্ডার কুমিল্লা পাড়া এলাকায় গত ৩/৪ দিন ধরে পানির সংকট। তাই বাধ্য হয়ে অনেকেই ওয়াসার গাড়ির পানি কিনে ব্যবহার করছেন। এ এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা সুরুজ আলী টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের এলাকায় দিনে ২/১ বার করে পানি আসে। তা দিয়েই সব কাজ করতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে পানি কিনে খেতে হচ্ছে।'
শাহজাদপুরের খিলবাড়ির টেক এলাকার বাসিন্দা সাবিনা হক টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের এলাকায় গত এক বছর ধরেই পানির সমস্যা। নির্দিষ্ট সময়ে পানি ধরে রাখতে হয়। তবে ইদানিং এ সমস্যা আরও বেড়ে গিয়েছে। দিনে একবার কোনোভাবে পানি আসে, সেটা সংরক্ষণ করে রেখেই কাজ সারতে হয়। মাঝে মাঝে গোসল না করেই থাকতে হয়।'
ভাটারা এলাকার বাসিন্দা শিপন শেখ টিবিএসকে বলেন, 'পানির সংকটের বিষয়ে বারবার ওয়াসার আঞ্চলিক কার্যালয়ে অভিযোগ জানিয়েও এর প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। পানির সংকটের কারণে এ এলাকার প্রতিটি বাড়িতে মানুষ খুব কষ্টে আছে।'
ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, পানির সমস্যা সমাধানে ঢাকায় প্রায় ৯২০টি পাম্পের মধ্যে ১০০টির বেশি পাম্পে বোরিং করাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ওয়াসা বলছে, বোরিং কাজ শেষ হলে পানির সমস্যার সমাধান হবে অনেকটাই। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গন্ধবপুর পানি শোধনাগার চালু হলে ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরতা অনেকাংশে কমে আসবে।
ভাটারা এলাকার ওয়াসার আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, 'পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে আমরা বোরিং করে পাম্পগুলোতে আরও পাইপ বসাচ্ছি। এ কাজ শেষ হলে আশা করা যায়, পানির সংকট আর থাকবে না।'
এছাড়াও রায়েরবাজারের সুলতানগঞ্জ এলাকায় ছয়টি গলিতে বেশিরভাগ ভবনেই নেই পানি সরবরাহ এবং তাদের এ সমস্যা কোরবানির ঈদের আগে থেকে। মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকায় ১৪ নম্বর সড়কেও একই অবস্থা। এখানেও বেশিরভাগ বাড়িতে রয়েছে পানির সংকট।
ওয়াসার তথ্যমতে, ঢাকা ওয়াসার দৈনিক প্রায় ২৭০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করার সক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে পানি উৎপাদন করা হয় ৯১ কোটি লিটার, আর বাকি ১৭৯ কোটি লিটার গভীর নলকূপ থেকে উৎপাদন করা হয়। আর রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা দৈনিক ২১০ থেকে ২৪০ কোটি লিটার। তবে লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে জানায় তারা।
ওয়াসা বলছে, ঢাকায় পানির চাহিদা বাড়ার কারণে ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নামছে। আগে যেখানে পাম্প থেকে প্রায় ৩ হাজার লিটার পানি পাওয়া যেত সেখানে এখন এক থেকে দেড় হাজার লিটার পানিও উত্তোলন করা যাচ্ছে না। ওয়াসার প্রায় ৯২০টি পানির পাম্পের মধ্যে ১০০টিরও বেশি পাম্প বিকল হয়ে পড়েছে।
ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির ৬৪ শতাংশ আসে ভূগর্ভস্থ থেকে। পানির স্তর বেশ নিচে চলে যাওয়ায় প্রায় এক হাজার ফুট নিচ থেকে পানি তুলতে হচ্ছে ঢাকা ওয়াসাকে। রূপগঞ্জের গন্ধবপুর পানি শোধনাগার চালু হলে ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরতা প্রায় ৩০ শতাংশ কমে আসবে বলে জানায় ওয়াসা।
ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (টেকনিক্যাল) এ কে এম শহীদ উদ্দিন বলেন, 'আমাদের বর্তমানে পানির সংকট রয়েছে। লোডশেডিংয়ের কারণে কিছু কিছু স্থানে পানি সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। তবে কোথাও লাইনের সমস্যা নেই। আমাদের চাহিদা অনুযায়ী কিছু কিছু স্থানে ১০ ঘণ্টা পাম্প চালালেই পানির চাহিদা মেটানো যেত কিন্তু এখন লোডশেডিংয়ের কারণে সেগুলোও ২০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চালাতে হচ্ছে।'
তিনি বলেন, এক ঘণ্টা পানির পাম্প বন্ধ থাকলে সেই সময়ের পানির ব্যাকআপ দিতে আরও ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা পাম্প চালাতে হচ্ছে। পানির চাপ না থাকলে লাইনে পানি পৌঁছাবে না। এজন্য মাঝে মাঝে সংকট দেখা দেয়।
ডিজেলচালিত একটি পাম্প চলতে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লিটার তেল লাগে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন পানি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে বলেও জানান তিনি।