ফিরে দেখা বিস্মৃত, হারানো সেই সব রেলপথ- দেশভাগের আগে যা দুই বাংলার সেতুবন্ধন হয়েছিল
সাতচল্লিশের দেশভাগের চার দশক পরে জন্ম ফটোগ্রাফার সরকার প্রতীকের। ৩৬ বছর বয়সী প্রতীক অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের টিকে থাকা বিভিন্ন নিদর্শন তার ক্যামেরায় ধরে রাখার নিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এ সম্প্রতি তার বাংলাদেশে থেকে যাওয়া ব্রিটিশদের তৈরি রেলব্যবস্থার ছবিগুলো নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পরিত্যক্ত রেলগাড়ি, স্টেশন, এসবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোই প্রতীকের ছবিগুলোর বিষয়।
প্রতীকের ছবিতে মানুষের চেয়ে বেশি মুখ্য শতবছরের অবহেলায় জরাজীর্ণ রেলপথ, ও এই পথসংলগ্ন এলাকায় গড়ে ওঠা ব্যবসায়, আবাস, নির্মাণ ও বিনোদনের চিহ্নগুলোই। ছবিগুলোতে মাঝেমধ্যে দু'একটা মানুষ চোখে পড়ে- কিন্তু তারা যেন মনের বেখেয়ালে শেষ ট্রেনটিও ধরতে না পেরে এখানেই রয়ে গেছেন।
সাতচল্লিশের দেশভাগ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জটিল। অনেকে মনে করেন দেশভাগের সময় বাংলাদেশকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। ধর্মের ভিত্তিতে দুই বাংলা ভাগ হয়। দেশভাগের গল্পে যে বাংলাদেশ জড়িয়ে, তার সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের প্রায়ই মিল নেই।
দেশভাগের বাংলা 'হারানো', 'পরিত্যক্ত' বাংলার গল্প বলে। এ বাংলা ছিল অতীতের গ্রামবাংলা, হালের ঘিঞ্জি বাংলাদেশ নয়।
ব্রিটিশদের ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে এখন বাংলাদেশের জাতীয় রেলওয়ে। পূর্ববঙ্গ সবসময় উর্বর ছিল, ব্রিটিশ ভারতের কৃষির প্রাণকেন্দ্র ছিল এটি।
কিন্তু নদীমাতৃক অঞ্চল হওয়ায় ব্রিটিশ প্রশাসনের রাজধানী কলকাতা ও ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাংলার শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না।
ইংল্যান্ডে ১৮২৫ সালে প্রথমবারের মতো রেলব্যবস্থা চালু হয়। এর ৪০ বছরের মধ্যে ভারতবর্ষে রেললাইন বসায় ব্রিটিশেরা।
এ রেললাইন যেমন তাদের সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদকে তুমুল লাভজনক করে তুলেছিল, এই পরিবহন অবকাঠামো একই সঙ্গে এখানকার মানুষকে কাছাকাছি আনা, একটি ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত ও বণিক শ্রেণী তৈরি করা এবং এ অঞ্চলে রাজনৈতিক সংগঠনের উত্থানে সহায়তা করেছিল।
যে রেললাইন ব্রিটিশ উপনিবেশকে সমৃদ্ধির চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল, সেটিই আবার ব্রিটিশদের ভারতবর্ষ ত্যাগের পথ তৈরি করে দিলো।
সাতচল্লিশের পরে ব্রিটিশদের তৈরি করা এ রেললাইনগুলো এক দেশে শুরু হয়ে অন্য দেশে গিয়ে থামলো। বাংলার ট্রেনে চড়ে শরণার্থীরা ভারতের ভেতর ও বাইরে যাতায়াত করেছিলেন। সাতচল্লিশের পর দু'দশক এসব ট্রেনে যাত্রীসংখ্যা ভালো ছিল। কিন্তু পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের পর আন্তঃসীমান্ত রেল ব্যবস্থায় কড়াকড়ি বেড়ে যায়।
বাংলার এ রেলের বিবর্তন ঘটতে ঘটতে আজ তা বাংলাদেশ রেলওয়েতে এসে থেমেছে- যা রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির আখড়াতে পরিণত হয়েছে।