আমেরিকা কেন কখনো মোল্লা ওমরকে ধরতে পারেনি! কীভাবে চোখে ধুলো দিয়েছেন...
তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা ও আধ্যাত্মিক নেতা মোল্লা ওমর ছিলেন আমেরিকার 'মোস্ট ওয়ান্টেড' তালিকার অন্যতম একজন। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আক্রমণ চালানোর পরও মোল্লা ওমরকে খুঁজে পায়নি দেশটি। ওমরের মাথার দাম ছিল ১০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু অত অর্থের লোভেও কেউ তাকে ধরিয়ে দেয়নি। এমনকি ২০১৩ সালে ওমরের স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ার পরও তালেবান সে তথ্য গোপন রেখেছিল।
আগে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা ছিল পাকিস্তানে পালিয়ে বাস করেছিলেন মোল্লা ওমর। তালেবানের হাতে ক্ষমতা হারানো সাবেক আফগান সরকারও তা-ই জানিয়েছিল। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর ওমরের পরিবার, তাকে আশ্রয় দেওয়া ও পালাতে সহায়তা করা আফগানেরা এখন বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলতে রাজি হয়েছেন।
২০০৪ সালে মোহাম্মদ আসরারের বয়স ছিল চার বছর। মোল্লা ওমর ওর তার বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন তখন। আসরার এখন একজন জিরা চাষী। বাড়ির একটি লুকানো দরজার পেছনে বাস করা মোল্লা ওমরের কথা এখনো তিনি মনে করতে পারেন। বাথরুমের তাকের নকশায় ওই নকল দরজাটি বানানো হয়েছিল। এমনকি ওই তাক-দরজায় শ্যাম্পুর বোতলও রাখত আসরারের পরিবার যাতে বাইরে থেকে কিছু বোঝা না যায়। তবে সেই ঘর এখন আর নেই, দরজাটাও খোলে না। ওই জায়গায় শুকনো জিরা রাখেন আসরার।
আসরার জানান, মার্কিনীরা বাড়িতে এসেছিল দুই কি তিনবার। কিন্তু ওই ঘরের কথা কখনো টের পায়নি। গোপন ওই কক্ষটি বানিয়েছিলেন তার বড় ভাই আবদুল সামাদ। পেশায় তিনি একজন ট্যাক্সি চালক। একটা লম্বা সময় পর্যন্ত ওই ঘরের অস্তিত্ব বাড়ির লোকেরাও জানত না। ২০০৪ সালের শেষে জাবুলের আরেক গ্রাম ওমারজোতে চলে যান মোল্লা ওমর। তার নতুন ওই ঠিকানা স্থানীয় মার্কিন ঘাঁটি থেকে গাড়ির দূরত্বে অল্প কয়েক মিনিট দূরে ছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফলভাবে ওসামা বিন লাদেন ও অতি সম্প্রতি আয়মান আল-জাওয়াহিরিকে হত্যা করতে পারলেও মোল্লা ওমরের নাগাল পায়নি। এটি এ অঞ্চলে তাদের বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতাগুলোর একটি বলে মানা হয়। আর এ কারণে ওমর হয়ে ওঠেন এক রহস্যময় চরিত্র, তালেবান সদস্যদের কাছে তার সম্মান বেড়ে যায় অনেকগুণ।
আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর মোল্লা ওমর দেশটিতে আবারও জাতীয় নেতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। বর্তমান তালেবান ১৯৯০-এর দশকে তার শাসনামলকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করছে। এসবের মধ্যে আছে ওমরের সৃষ্টি করা সরকারি দপ্তর নতুন করে চালু করা, নারীর কাজ ও পড়ালেখার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ ইত্যাদি।
তালেবানের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুদ্ধের বেশিরভাগ সময় তাদের নেতারা পাকিস্তানে ছিলেন। কিন্তু ওমর তাদের সঙ্গে যাননি। বেট ডাম নামক একজন ডাচ লেখক মোল্লা ওমরের গবেষণাধর্মী জীবনী লিখেছেন। ২০১৯ সালে ওই বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, মোল্লা ওমর তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আফগানিস্তানে বাস করেছিলেন। কিন্তু মার্কিন কর্তৃপক্ষ ও তৎকালীন আফগান সরকার এ দাবি উড়িয়ে দেয়।
আফগানিস্তানে মোল্লা ওমরের সন্ধান করেছিলেন সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা ফিলিপ র্যাভেলিং। তারও মতে ওমর আফগানিস্তানে এক দশকের বেশি ছিলেন। তিনি জানান, সব তথ্য নির্দেশ করেছিল, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কমপক্ষে ২০১২ সাল পর্যন্ত ওমর পাকিস্তানে ছিলেন।
১৯৮০'র দশকে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন মোল্লা ওমর। সে সময় জাবুলের গ্রাম হাজি ইব্রাহিমে পরিবার নিয়ে থাকতেন তিনি। এই গ্রামেই ১৯৯৪ সালে তালেবান আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। আমেরিকানরা আফগানিস্তানে আসার পর এ গ্রামে নিয়মিত মার্কিন ও আফগান সেনাদের পা পড়ত। গ্রামবাসীদের একই প্রশ্ন দিয়ে নিয়মিত মোল্লা ওমর বিষয়ে জেরা করত তারা।
মোল্লা ওমরের বড় ছেলে মোল্লা ইয়াকুব এখনকার তালেবান সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তালেবানের অন্যতম প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় নেতা তিনি। ২০০১ সালে আট বছর বয়সে শেষবারের মতো বাবাকে দেখেছিলেন বলে জানান তিনি। কান্দাহারে মার্কিন বিমান হামলায় অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়ার পর থেকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবনযাপন করতে থাকেন মোল্লা ওমর। ইয়াকুব দাবি করেছেন, জাবুলের দুটি গ্রামে ১৩ বছর গোপনে বাস করেছিলেন মোল্লা ওমর।
মোল্লা ইয়াকুব, এবং মোল্লা ওমরের কাছের মানুষেরা জানিয়েছেন, ২০০১ সালের ডিসেম্বরে গাড়িযোগে কান্দাহার ত্যাগ করেন ওমর। তার সঙ্গে ছিলেন জাবুলের স্থানীয় বাসিন্দা ও মধ্য পর্যায়ের তালেবান সদস্য আবদুল জব্বার ওমারি। এ ওমারিই মোহাম্মদ আসরারের বড় ভাই সামাদের সঙ্গে ওমরের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। তবে পরে ওমরের সঙ্গে তার মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন ওমারি।
ওমারির ওমারজো গ্রামের বাড়িতে যখন মোল্লা ওমর বাস করছিলেন, তখন কার্যত তার দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করেছেন ওমারি। তিনি জানিয়েছেন, তার বাড়িতে পরিবারের সদস্যের মতোই ছিলেন ওমর। এমনকি তার সন্তানদের নামও রেখেছেন মোল্লা ওমর। কেবল নিজের স্ত্রীকে তালেবান নেতার পরিচয় জানিয়েছিলেন ওমারি। মোল্লা ওমর সাড়ে আট বছর ওমারির বাড়িতে ছিলেন।
অনেকবারই মার্কিন সেনা ও আফগান সরকার ওই বাড়িতে অনুসন্ধানে এসেছিল। প্রতিবারই তাদের চোখে ধুলো দিতে পেরেছেন ওমর ও ওমারি। ওমারির সন্তানদের চোখ থাকতো তক্কে তক্কে। গ্রামের দিকে কোনো বিদেশি সেনাদল আসতে দেখলেই তারা সতর্ক করে দিত বাড়িতে। স্থানীয় মার্কিন ঘাঁটি উলভেরাইনে তখন কাজ করেছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল বার্টন শিল্ডস। তিনি জানিয়েছের, স্থানীয় আফগানরা বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখালেও কখনো তালেবান বিষয়ে মার্কিনীদের কোনো তথ্য দেয়নি।
নিজেদের প্রতিষ্ঠাতাকে সম্মান জানাতে মোল্লা ওমরের বাড়িকে একটি জাতীয় স্মৃতিস্মারকে পরিণত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বর্তমান তালেবান সরকার। ওমারির স্ত্রী, ডামের গবেষণা, ও তালেবান কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী জাবুল প্রদেশে মারা যান মোল্লা ওমর। তাকে কবর দেওয়া হয় ওমারজো'র কাছে। তৎকালীন আফগান সরকার জানিয়েছিল, পাকিস্তানের করাচির একটি হাসপাতালে মারা গিয়েছিলেন ওমর।
মোল্লা ওমরকে পাকিস্তানে কয়েকবার দেখা যাওয়ার কথা জানা যায়। ২০০৯ সালে এক নরওয়েজিয়ান ডিপ্লোম্যাট দাবি করেছিলেন তিনি মোল্লা ওমরকে পাকিস্তানে দেখেছেন। তবে অনেকে মনে করেন, কোনো প্রয়োজনে কয়েকবার পাকিস্তানে যেতেই পারেন মোল্লা ওমর। লেখক ডাম মনে করেন, পাকিস্তানের চেয়ে জাবুলে বেশি নিরাপদ বোধ করেছিলেন মোল্লা ওমর। এছাড়া জাবুল ছিল তালেবানদের শক্ত ঘাঁটি। এর ফলে তালেবান নেতা ও ওমরের মধ্যে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়েছিল।
তবে পরিবারের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ করতে পারেননি মোল্লা ওমর। তার ছোট ভাই মোল্লা আবদুল মানান জানিয়েছেন, তিনি সর্বশেষ ২০০১ সালে কান্দাহারে ভাইকে দেখেছিলেন। মৃত্যুর পর ওমরকে কবর দিতে জাবুল গিয়েছিলেন মানান।
মোল্লা মানান এখন তালেবান সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। এক বছর আগে তালেবানের বিজয় সম্পর্কে তিনি বলেন, 'এটা ছিল অপ্রত্যাশিত। আমাদের ও পুরো বিশ্বের জন্য।'
সূত্র: দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল