মুর্তজা কুরেইরিস
‘মানুষকে ধ্বংস করা গেলেও তাকে পরাজিত করা যায় না (A man can be destroyed but not defeated)’- আর্নেস্ট হেমিংওয়ের এই কথাটির যথার্থতা যুগে যুগে প্রমাণিত হয়েছে নির্যাতিত মানুষের অদম্য প্রাণশক্তির মাধ্যমে। একবিংশ্ব শতাব্দিতে এসে আরো একবার এ কথার সত্যতা প্রমাণ করল আরবের এক ছোট্ট কিশোর, মুর্তজা কুরেইরিস। তাকে নিয়েই আজকের লেখা।
সময়টা ২০১১ সাল। আরব বসন্তে উত্তাল কয়েকটি দেশ। সৌদি রাজতন্ত্রের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের দাবিতে ওই সময় দেশজুড়ে বিক্ষোভে ফেটে পরে জনতা।বিভিন্ন জায়গায় চলে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্লোগান। শিয়া অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলও তার ব্যাতিক্রম ছিল না। সেখানেও চলমান বিক্ষোভে অংশ নেয় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। ১০ বছরের কোমল প্রান মুর্তজা কুরেইরিস, যার বাড়ি ওখানেই, সাত-পাঁচ না ভেবে নেমে আসে রাস্তায়। সাথে আরো ৩০ জন বন্ধু। মর্তুজার নেতৃত্বে র্যালিতে অংশ নেয় ওরা। রাজপথে সে চিৎকার করে বলছে, ‘সৌদিতে সবাই মানবাধিকার পরিস্থিতি সমুন্নত দেখতে চায়।’
অবাধ তথ্য-প্রযুক্তির পৃথিবীতে খবর ছড়িয়ে পরা সময়ের ব্যাপার মাত্র। ফলে সেই সাইকেল শোভাযাত্রার ছবিও হয়ে যায় ভাইরাল।
সেই ছবি সৌদি শাসকের চোখ এড়ায়নি। মুর্তাজা কুরেইরিসের দুঃসাহস যেন শাসকের অহঙ্কারে ঘা মেরে যায়। তাইতো প্রশাসন অল্প বয়সী বালকদের জড়ো হওয়ার এ বিষয়টি নিবিড়ভাবে ‘পর্যবেক্ষণ’ করে। সেই পর্যবেক্ষণ কতটা নিষ্ঠুর আর নির্মম হতে পারে, তার কোন পূর্ব ধারণা সেই বালকের ছিল না।
যেহেতু নাগরিকদের বিক্ষোভকে দমন করারই শাসকের কাজ। যুগে যুগে ধরে এই ধারাই অব্যাহত। আবার শাসকের শোষণ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন ছোট ছোট প্রতিবাদের ঘটনাও তার ভীতকে নাড়িয়ে দেয়। তাই বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে তিন বছর পর মুর্তাজা বাহরাইন সীমান্তে গ্রেপ্তার হয়।
মুর্তাজা কুরেইরিসের বিরুদ্ধে সৌদি প্রশাসনের অভিযোগগুলি মারাত্মক!কি সেই অভিযোগ? চলুন জেনে নেয়া যাক-
২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় সৌদিতে গণতন্ত্রের দাবিতে বন্ধুবান্ধব জড়ো করে বিক্ষোভে নামে মুর্তাজা।সেই বিক্ষোভ খোদ সৌদি সরকারের বিরুদ্ধেই! আরো অভিযোগ সে নাকি ‘সন্ত্রাসী গ্রুপ’ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই অপরাধের শাস্তি শিরশ্ছেদ বা ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড।
এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মুর্তাজার ভাই আলী কুরেইরিস মোটরসাইকেলেযোগে সৌদির পূর্বাঞ্চলীয় শহর আওয়ামিয়ার এক থানায় পেট্রলবোমা ছুড়ে মারেন। সে সময় তার সঙ্গে মুর্তাজাও ছিল। এ ছাড়া বিক্ষোভের সময় সহিংসতা, নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর পেট্রলবোমা হামলায় সহযোগিতা, মৃত ভাইয়ের জানাজার সময় পদযাত্রা বের করার অভিযোগও আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
উল্লেখ্য, সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় মুর্তাজা কুরেইরিসের বড় ভাই আলী কুরেইরিসকে ২০১২ সালে হত্যা করে সৌদি আরবের পুলিশ। তবে প্রহসন হল জোর করে কুরেইরিসের কাছ থেকে অপরাধের স্বীকারোক্তি সৌদি সরকার আদায় করে ছেড়েছে।
অভিযোগের পাহাড় কাধে নিয়ে ১৩ বছরের এক কিশোর তখন থেকে ৫ বছর ধরে কারাগারে বন্দী। তাকে শুধু আটকে রাখাই হয়নি, হয়েছে শারীরিক নির্যাতনও। উপরন্তু ফাঁসিরও আদেশ দেয় সৌদি শাসক। আর ফাঁসি হলেই সেই মৃত্যু হয়ে যাবে ঐতিহাসিক! কেননা ফাঁসি কার্যকর হলে সৌদি আরবের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী কারও মৃতুদণ্ড দেওয়া হবে। আরব বসন্তের ঘটনায় এ পর্যন্ত সৌদি কর্তৃপক্ষ তিন জন কিশোরকে ফাঁসি দিয়েও ফেলেছে, যাদের বয়স ১৯–এর ঘরে।
কিন্তু এত সব মর্তুজাকে দমাতে পারেনি। পারেনি পরাজিত করতেও। তুর্কি প্রশাসন যেভাবে পারেনি তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতকে দমাতে। জেলখানায় বসেই তাই নাজিম লিখেছিল তার বিখ্যাত ‘জেলখানার চিঠি’র সেই লাইনগুলি-
‘জল্লাদের লোমশ হাত
যদি আমার গলায়
ফাঁসির দড়ি পরায়
নাজিমের নীল চোখে
ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে
ভয়।
............
বিচার সবে মাত্র শুরু হয়েছে
আর মানুষের মুন্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয় যে
ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে’।
মর্তুজার মনের মধ্যেও হয়তো এই ভাবনাগুলি খেলে যাচ্ছিল। তাইতো সে হাল ছাড়েনি। পরাজয়কে স্বীকার করেনি। মাথানত করেনি অন্যায়ের কাছে।
অবশেষে সেই শুভক্ষণ এলো! এবার মর্তুজার বিরুদ্ধে ফাঁসি কার্যকরে বাধা হয়ে এসেছে সৌদি সহ সারা পৃথিবীর মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তাদের বক্তব্য, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায় না।
মুর্তজা কুরেইরিসকে মৃত্যুদণ্ড না দিতে সৌদি আরবের প্রতি আবেদন জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও। কয়েকটি দেশের সরকারও মৃত্যুদণ্ড না দিতে সৌদির প্রতি অনুরোধ জানায়। সৌদি কর্তৃপক্ষ এই কিশোরের শিরোচ্ছেদ করতে চায় বলে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর আসার সাথে সাথেই বিশ্বজুড়ে সমালোচনা ঝড় বয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক চাপ ও মুর্তাজার প্রাণশক্তি এই দুইয়ের কাছে শেষমেশ সৌদি কর্তৃপক্ষ পরাজিত হয়ে এ বছরের চলতি মাসে মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করেছে। ২০২২ সালেই কারাগারের শৃঙ্খল ভেঙে বের হয়ে আসবে সময়ের আলোচিত এক কিশোর চরিত্র, যাকে দূঃশাসন ধ্বংস করতে চাইলেও, পরাজিত করতে পারেনি।
তথ্যসূত্রঃ সিএনএন, আল জাজিরা, দি গার্ডিয়ান