সুন্দরবনের বাঘ আপনাকে সবসময় দেখছে
সুন্দরবনের পড়ন্ত বিকেল। আঁকাবাঁকা খাঁড়ির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের মোটরবোট। মাঝি রবি ১৫ বছর বয়সী ছেলের হাতে স্টিয়ারিং হুইলটা ধরিয়ে দিয়ে তখন সবে খেতে গিয়েছিল। আমার গাইড রামকৃষ্ণ মণ্ডল হঠাৎ রবি'র দিকে তাকিয়ে 'চল, চল, চল!' বলে হেঁকে উঠলো। লাফ দিয়ে উঠে এসে ছেলেকে সরিয়ে এঁটো হাতেই স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে নৌকা উল্টো দিকে ঘোরাল রবি। সুন্দরবনে হুট করে এমন উল্টোমুখী বাঁক নেওয়ার কারণ একটাই। সেটা হলো বাঘ! ততক্ষণে রবি'র বউ, নৌকার রাঁধুনি নীলিমাও ডেকের নিচ থেকে ওপরে উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের মোটরবোট এবার খোলা নদীতে এসে পড়লো। হুট করে চারদিকে কোন তট দেখতে পেলাম না। আমরা এখন আছি পঞ্চমুখানি মোহনায়। এখানে পাঁচটা বড়, প্রশস্ত নদী এসে মিলিত হয়ে পরে সবগুলো বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। একটুর জন্য বাঘের মুখে পড়া থেকে বেঁচে যাওয়ায় নৌকার ভেতরে সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠলো।
সুন্দরবন পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন যেখানে বেঙ্গল টাইগার বাস করে। কিন্তু এ বনে বাঘের দেখা মেলা অন্য যেকোনো বনের চেয়ে বেশ দুরূহ। বনটির ভারতের অংশে পড়েছে ৪০০০ বর্গকিলোমিটার। এ অংশে দ্বীপের সংখ্যা ১০২টি। যার ৫৪টিতে মানুষের আবাস, বাকি ৪৮টি সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের অংশ। এ রিজার্ভের আয়তন ২৫৮৫ বর্গকিলোমিটার। মোটামুটি শ'খানেকের কিছু বেশি বাঘ এ অংশে বাস করে। ভারতীয় অংশে ট্যুরিস্টদের জন্য বরাদ্দ ১৩৩০ বর্গকিলোমিটার। বাকি যা আছে সেটা বাফার জোন। বাফার জোনের ভেতরে ৩৬০ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে তৈরি করা হয়ছে সজনেখালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। আমাদের অবস্থান এখানেই।
এ অভয়ারণ্যে দিনে দুবার জোয়ার-ভাটা হয়। এখানে মোটরবোটে চড়ে বন দেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। অনেক খাঁড়ির মাথায় লাল পতাকা বসানো আছে। এগুলোতে কোনো না কোনো সময়ে জেলে, কাঁকড়াশিকারীরা বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন। সুন্দরবনে কেবল বাঘের ইচ্ছে হলেই মানুষ তাকে দেখতে পায়।
মণ্ডলের জন্ম এখানেই৷ এ বনের আনাচকানাচ তার নখদর্পণে। তার মতো এখানকার বাসিন্দাদের কাছে বাঘ হচ্ছে 'মামা'। সকালে বেরোনোর আগে বনবিবির কাছে প্রার্থনা করে বেরিয়েছিল মণ্ডল। রবি ইঞ্জিনের ওপর আরেকটু চাপ দিলো। মণ্ডল যা বললো তার অর্থ দাঁড়ায়, বাঘটাকে কোনদিকে পাওয়া যাবে সেটা সে অনুমান করতে পেরেছে। গলগল করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নৌকা সেদিকেই এগিয়ে চললো।
কয়েক মিনিট পরে একটা খাঁড়ির মুখে নৌকা দাঁড় করালো রবি৷ নীলিমা আবার নিচ থেকে উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। শেষ বিকেলের সূর্যের আলো ভেজা পাড়ের ওপর পড়ে ঠিকরে সোজা আমাদের চোখে এসে বিঁধছে। এদিকে বাঘের কোনো দেখা নেই। কিন্তু মণ্ডলের দৃঢ় বিশ্বাস বাঘটা এখানেই আছে। আর সেটাকে প্রমাণ করতেই যেন তখুনি ঘন জঙ্গল থেকে বাঘমামা বেরিয়ে এলেন।
নরম মাটিতে তার থাবা কয়েক ইঞ্চি ডুবে যাচ্ছে। গায়েগতরে দশাসই চেহারার মালিক। সাবধানে কেওড়ার শ্বাসমূল বাঁচিয়ে পাড়ের দিকে নেমে এল বাঘটা। 'নন্টু', ফ্যাকাসে মুখে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল মণ্ডল। 'মানুষখেকো, বেজায় চালাক। গত সপ্তাহে এক জেলের ওপর হামলা চালিয়েছিল। বেচারা ছুরি দিয়ে আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে নন্টুই তার দফারফা করে ফেলে,' বলে চলল মণ্ডল। আমি ঢোক গিললাম। একটু পরেই ঘন জঙ্গলের ভেতর হারিয়ে গেল নন্টু।
দিনের মধ্যে দুবার সুন্দরবন পানির নিচে ডুবে যায়। এখানকার বাঘদের তখন লবণাক্ত পানি পান ও আধা-জলজ জীবন যাপন করতে হয়। এ কারণে সুন্দরবনের বাঘ দক্ষ সাঁতারুও। এ বনের বাঘের লেজ শক্ত ও পেশিবহুল। সাঁতারের সময় পানিতে লেজ ঝাপটায় এটি। সুন্দরবনের বাঘ অন্য জায়গার বেঙ্গল টাইগারের মতো নয়। এর খাদ্যাভ্যাসও অন্যদের থেকে ভিন্ন। এ বনের বাঘেরা মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ, বড় গুইসাপ ইত্যাদিও শিকার করে। সুন্দরবনের বাঘের সাপ শিকার করারও নজির আছে। ২০০৯ সালে এক মৃত বাঘের ময়নাতদন্ত করে জানা যায়, সেটি শঙ্খচূড়সহ মোট দুটো বিষাক্ত সাপ খেয়েছিল।
আমাদের নৌকা খাঁড়ি ধরে চলল। মাঝেমধ্যেই জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে নন্টুর শরীর উঁকি দিচ্ছিল। একবার থেমে দাঁড়িয়ে সোজা আমাদের দিকে কিছুক্ষণ চাইল। সে দৃষ্টি দেখে আমার মেরুদণ্ডে একটা শিহরণ বয়ে গেল। আমি ক্যামেরার কথা ভুলে সেই রাজসিক মুখমণ্ডলের দিকে চেয়ে থাকলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক তার আর আমাদের এ লুকোচুরি খেলা চলার পর গভীর জঙ্গলে হারিয়ে গেল নন্টু। আমাদের শরীরে উত্তেজনার কাঁপুনি তখনো থামেনি।
পরের সপ্তাহে নন্টুকে নিয়ে অনেক গল্প শুনতে পেলাম। সে নাকি প্রতি মাসে মানুষ শিকার করে। তার হামলা এত চোরাগোপ্তা যে, কেবল কাউকে নন্টু তুলে নেওয়ার পরেই শিকারের সঙ্গীসাথীরা টের পায়। শিকারকে নিয়ে সাঁতরে খাঁড়ি পাড়ি দিয়ে তীরের ওপর নিশ্চুপে টেনে নিয়ে যায় সে। মণ্ডলের গ্রাম বালি'র আরেক বাসিন্দা জানালেন, নন্টু নিজের আস্তানার (টেরিটোরি) ধার ধারে না। সুন্দরবনের এ মাথা থেকে ও মাথায় তার দর্শন মেলে। শুনলাম, কয়দিন আগে নাকি একদল ট্যুরিস্টের ক্যামেরায় নন্টুর এক জেলেকে শিকার করে খেয়ে ফেলার ছবি ধরা পড়েছিল। সে ছবিগুলো মোছার জন্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছিল বনবিভাগ। নন্টুকে ধরার সব চেষ্টাই এখন অব্দি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। 'ফাঁদ এড়িয়ে টোপ হস্তগত (পড়ুন থাবাগত) করার কায়দা নন্টু বেশ ভালো করে জানে,' বললো মণ্ডল।
তবে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নন্টু হয়তো একাধিক বাঘ। তাকে ঘিরে অনেক গুজব ছড়িয়েছে। সুন্দরবনে বাঘের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে নামের কোনো ব্যবস্থা নেই। আর এখানকার বাঘগুলো নিজেদের টেরিটোরি'র ব্যাপারে উদাসীন। ভারতের সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট একটি প্রকল্পের পরিচালক রাতুল সাহা বলেন, 'এ বনে শিকার করা বেশ কঠিন। জেলে, কাঁকড়া শিকারী, মৌয়াল; এদের বেশিরভাগই বিনা অনুমতিতে ও কোনো প্রকার আত্মরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া বনে প্রবেশ করে। আর এরা বাঘের জন্য বেশ সহজ শিকার।' মানুষের মাংসের স্বাদ নিয়ে সুন্দরবনের বাঘের বিশেষ লোলুপতা নেই, নিদেনপক্ষে কোনো গবেষণায় সেটার প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। 'কেবল সহজে শিকার করা যায় বলেই মাঝেমধ্যে এ বাঘগুলো মানুষের ঘাড় মটকায়,' মন্তব্য করেন রাতুল।
কিন্তু গুজব আর মিথ ছাড়া সুন্দরবনকে চিন্তা করা যায় না। স্থানীয়দের কাছে বাঘ কেবল ভয়ানক শিকারী নয়, বরং তারা মনে করে বাঘ হচ্ছে তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের প্রেতাত্মা, যারা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আবারও ফিরে এসেছে। বাঘ অপদেবতা, তাকে পূজা করে সন্তুষ্ট করা প্রয়োজন; এমন বিশ্বাসও আছে এখানকার মানুষদের মনে। এ বনের দক্ষিণ রায় ও বনবিবি'র কিংবদন্তি বহুল প্রচলিত।
কিংবদন্তি অনুযায়ী লোভী, উদ্ধত ও অত্যাচারী দক্ষিণ রায় দুষ্ট এক বাঘে রূপান্তর হয়ে সুন্দরবনের অসহায় মানুষদের আক্রমণ করত। বনের অন্য বাঘেরা ছিল তার প্রজা। এ বাঘগুলো পুরো বনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। নিয়মিত মানুষ শিকার করে নিজেদেরর উদরপূর্তি করত শার্দূলবাহিনী। এরপর গ্রামবাসীরা এ থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রার্থনা করতে শুরু করল। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে সৃষ্টিকর্তা বনবিবিকে পাঠালেন।
বনবিবি'র সঙ্গে যুদ্ধে মুখোমুখি হয়ে দক্ষিণ রায় টের পেল তার পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। তখন কেঁদে ক্ষমাভিক্ষা চাইল সে। মহানুভব বনবিবি তাকে জীবনভিক্ষা দিলেন। কিন্তু তার ভক্তদের যেন দক্ষিণ রায় আর অত্যাচার না করে সে আদেশও দিলেন। সুন্দরবনে বনবিবি'র মন্দিরে বনবিবি'র পাশে শিষ্য দক্ষিণ রায়কে দেখা যায়। হিন্দু গ্রামগুলোতে বনবিবি হয়ে যান দুর্গার একটি রূপ। মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে বনবিবি'র মন্দিরগুলো তৈরি হয় মাজারের ঢংয়ে।
রাতে ভালো ঘুম হয়নি। সকালে জেটিতে মণ্ডলের সঙ্গে দেখা হলো। একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল, 'ঘুম হয়নি মনে হচ্ছে। বাঘের স্বপ্ন দেখলেন নাকি রাতে? ভয় পাবেন না। ও আমি প্রতি রাতে দেখি।' লুচি, ভাজি আর ব্ল্যাক কফি খেয়ে রবি, মণ্ডল, নীলিমা, আর আমি আবার বেড়িয়ে পড়ি নৌকা নিয়ে। খাঁড়ি থেকে খাঁড়িতে আমাদের নৌকা বয়ে চলে। এবারের যাত্রায় ভোঁদড় আর মেছোবাঘ সন্ধান করে বেড়ায় আমাদের চোখ। বাঘ এখন আমাদের লিস্ট থেকে বাদ পড়েছে।
সেদিন বিকেলে সুধন্যাখালি ওয়াচটাওয়ারে কাছে আবারও বাঘের সাক্ষাতের সৌভাগ্য হলো। এবারেরটা মাদি। শেষ বিকেলের সোনালী আলোতে অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে দেখতে পেলাম। আমি ততক্ষণে বুঝে গেছি সামনের রাতটাও নিদ্রাহীন কাটবে। সুন্দরবনের বাঘ কেবল জঙ্গলেই রাজত্ব করে না, এখানকার গল্প, মিথ, গুজব, মাজার আর স্বপ্নের ভেতরেও সমানে দাপিয়ে বেড়ায় তারা।
ভাষান্তর: সুজন সেন গুপ্ত