রাজধানী ঢাকা জলবায়ু শরণার্থীদের শেষ আশ্রয়, কিন্তু তারা কেমন আছে
জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন অঞ্চলগুলির একটিতে অবস্থান বাংলাদেশের। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এখানে বিশাল উপকূলীয় এলাকাকে ভাঙ্গন ও তলিয়ে যাওয়ার বিপদে ফেলছে।
দক্ষিণাঞ্চলে সাইক্লোনের তীব্রতা বেড়েই চলেছে ফিবছর। মাঝেমধ্যেই শক্তিশালী সামুদ্রিক ঝড়ে লাখ লাখ মানুষ হারাচ্ছে তাদের জীবিকার শেষ সম্বল। অন্যদিকে, বাদবাকি বাংলাদেশে আবহাওয়া হারিয়েছে তার চিরায়ত বৈশিষ্ট্য।
অথচ এ দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
বন্যার পূর্বাভাস বাংলাদেশে চিরকালই অপরিসীম গুরুত্বের। বন্যা কতোটা শক্তিশালী বা কতদিন স্থায়ী হবে– আগে কিছুটা হলেও জানাতে পারতেন আবহাওয়াবিদেরা। কিন্তু, এখন অনিয়মিত আবহাওয়ার কারণে ঠিকঠিকানা নেই মৌসুমি বৃষ্টি বা বন্যার, কখন হবে অনুমান করাও মুশকিল।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পেছনে সিংহভাগ দায় উন্নত দেশগুলির। স্বাধীনতার পর বেশিরভাগ সময় শিল্পোন্নয়নে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের সে দায় যৎসামান্যই। সেই হিসাবে, এ দেশের প্রান্তিক মানুষকে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যায্য ভুক্তভোগী বলাই যায়। যেমন- বাংলাদেশে মাথাপিছু কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ বছরে শূন্য দশমিক ৫ টন। পশ্চিম ইউরোপে তা ১৫ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২০ টন।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের অন্যতম অনুঘটক। জীবিকা হারানো মানুষ নতুন আয়ের সন্ধানে পাড়ি জমায় রাজধানী ঢাকায়। নতুন জীবন সংগ্রাম শুরু হয়- পোশাক শিল্পে বা নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে। আরও দুর্ভাগাদের দিন গুজরান হয় আবর্জনা সংগ্রহ করে। কেউবা চালায় রিক্সা আর ভ্যান।
সরকারি তথ্যে দাবি করা হয়, প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার মানুষ বসবাসের জন্য পা রাখে এ শহরে। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক জনশুমারিতে এক কোটি ২ লাখ বলা বলেও, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ঢাকার অধিবাসী দেড় কোটির বেশি। তার সাথে, নতুন আগতদের ভিড় দিন দিন যেন উপচে পড়ছে মহানগরীর বুকে।
ঢাকার মিরপুর রোডে একটি মসজিদে জুম্মার নামাজে জামাতের সারি চলে আসে সড়ক পর্যন্ত। অবশ্য শুধু এই সড়কেই নয়, ঢাকার অনেক মসজিদেই জুম্মাবারে দেখা মেলে এ দৃশ্যের। মাঝদুপুরেই সড়কগুলোতে যান চলাচলের উপায় থাকে না তখন।
ভোরবেলা আজানের সাথে সাথে ঢাকার আরেকদল মানুষ ব্যস্ত দিনের প্রস্তুতি শুরু করে। বিশেষ করে, সেইসব ভাসমান মানুষ, বস্তিতেও যাদের ঠাঁই হয়নি। রাতের আঁধারে তারা ঘুমায় ফ্লাইওভারের নিচে, ফুটওভারব্রিজে বা ফুটপাথে। কিন্তু, দিনের আলোয় থাকার জায়গা নেই তাদের। এসব ভাসমান মানুষের সম্বলও যৎসামান্য: হয়তো দুই-একটি থালাবাসন আর কাঁথা। সুর্যের আলো উঁকি দেওয়ার সাথে সাথেই তারা বেড়িয়ে পরে দিনমজুরির সন্ধানে।
ঠিকানাহীন এই মানুষের মধ্যে নবাগতদের সংখ্যা অনেক। ঢাকার দক্ষিণে যেখানে বস্তির সংখ্যা বেশি– সেখানে তারা এখনও জায়গা পায়নি। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে এই বস্তিগুলো। এ যেন মহানগরীর বুকেই অন্য এক জগত, অন্য এক মহাদেশ–তাই হয়তো স্থানীয়রা এগুলোর নাম দিয়েছেন 'এশিয়া'।
বস্তিতে জীবন:
ঢাকার মোহাম্মদপুরে বুড়িগঙ্গা পাড়ের এমনই এক বস্তিবাসী জাহাঙ্গীর আলম। নদীর কাছে যত যাওয়া যায় ততোই তীব্র হয় কালো পচা পানির দুর্গন্ধ। আশেপাশের বাড়িঘরে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট হতে থাকে। একাধিক বস্তি নিয়ে গড়ে ওঠা এ এলাকার নাম বসিলা। স্ত্রী ফরিদাকে নিয়ে এখানে থাকেন জাহাঙ্গীর। তাদের মতো আরও ৫০০ পরিবার রয়েছে এখানে।
বসিলায় একটি অংশে অবশ্য সম্পন্নরাও থাকেন। তাদের নিবাস বহুতল, যাতে রয়েছে সুপরিসর আন্ডারগ্রাইন্ড পার্কিংসহ এলিভেটরের সুব্যবস্থা। বস্তিবাসীদের কাছে ধনীদের এই এলাকার নাম 'ইউরোপ'।
বাস্তুচ্যুত যেসব মানুষ ঢাকায় প্রথম প্রথম এসে ফুটপাথে রাত কাটায়, তাদের চেয়ে কিছুটা ভালো অবস্থায় থাকেন জাহাঙ্গীর ও ফরিদা। তবু হয়তো তাকে নিরুদ্রপের নীড় বলা যায় না। আসলে বসিলার অধিকাংশ বস্তি বন্যা ঠেকানোর বেড়িবাঁধ কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। জাহাঙ্গীর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন সেই সুরক্ষা নেই এমন অংশে; ছয় বর্গমিটারের এক প্লাস্টিকের ছাউনি দেয়া ঘরে। তাদের সম্বল বলতে, কিছু ছেঁড়া কাথা ও কম্বল, দুটি প্লাস্টিকের বালতি, একটি ঝুড়ি আর কয়েকটি ধাতব পাত্র।
বাড়িটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এই দম্পতি তাদের ১২ বছরের মেয়েকে ঢাকার অদূরে গাজীপুরে বিয়ে দিয়েছেন। অনটনের সংসারে ছোট দুই ছেলেকে তারা কাজে দিয়েছেন। তাদের একজন ফেরিতে সহকারীর, আরেকজন গাজীপুরে এক মুদির দোকানে চাকরি নিয়েছে। ছেলে দুটি বেতন না পেলেও, দুবেলা খাবার ও থাকার জায়গা পায়।
তিন মাসে, চার মাসে একবার সন্তানদের দেখার সুযোগ পান ফরিদা ও জাহাঙ্গীর। পরিবারটির আদি নিবাস ছিল ভোলায়, সেখানে বাচ্চারা বাবা-মার সাথেই থাকতো, স্কুলেও যেত তারা।
জাহাঙ্গীর তার দুর্ভাগ্যের বর্ণনা করেন, 'আমি জেলে ছিলাম। নদীভাঙ্গনে বাড়ি, সামান্য জমিজিরেত সব হারাই। নতুন বাড়ি তুলেছিলাম সঞ্চয় ভেঙে, সেটিও বছর তিনেক পর তলিয়ে যায়'।
এরপর ঢাকায় এসে রিক্সা চালাতে শুরু করেন জাহাঙ্গীর। আজো সে কাজই করছেন।
ধুলা, ধোঁয়া আর অসহনীয় গরম:
রাজধানীতে রিক্সা চালানো খুবই কঠিন কাজ। সড়কে যানবাহনের ভিড় ঠেলে এগোতে আসুরিক পরিশ্রম করতে হয় জাহাঙ্গীরকে। তাছাড়া, ঢাকার অনেক মূল সড়কে এখন রিক্সা চলাচল করতে দেওয়া হয় না। ফলে তার আয়ের সুযোগও কমেছে অনেকগুণ। ভোলায় মাছ ধরে যে আয় করতেন, ঢাকায় তার চেয়ে দৈনিক আয় কিছুটা বেশি হয়। কিন্তু, এ শহরে বসবাস অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই দিনশেষে হাতে তেমন কিছুই থাকে না।
স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'ঢাকায় পানিও কিনে খেতে হয়, কোনো কিছুই এখানে টাকা ছাড়া মেলে না। ভোলায় পানির জন্য, বসবাসের জন্য কাউকে টাকা দিতে হতো না। অনেককিছুই বিনামূল্যে পেতাম'।
ঢাকার এই জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে না পারার যন্ত্রণা এভাবেই ব্যক্ত করেন জাহাঙ্গীর। শহরের প্রচণ্ড গরম আর ধুলো ওড়া সড়কে রিক্সা চালানোতেও অস্বস্তি হয় তার। সাথে মোটরযানের ধোঁয়ার উৎপাত তো আছেই। পরিশ্রান্ত দেহে যা একেক সময় দম বন্ধ করার উপক্রম করে।
'মাঝেমধ্যে যাত্রীদের গন্তব্যে নিয়ে যেতে দুই ঘণ্টা লেগে যায়। গরমকালে সড়কে যেন আগুন জ্বলে। শরীর ক্লান্ত হয়ে ওঠে মুহূর্তেই। এখানে ভোলার মতো শরীর জুড়ানো সাগরের বাতাস নেই। চারদিক থেকে উত্তাপ ছড়ায়- যানবাহন আর মানুষের ভিড়। তখন রিক্সা চালাতে গিয়ে দর দর করে ঘামতে থাকি'- বলছিলেন জাহাঙ্গীর।
বস্তি জীবনে ব্যক্তিগত একান্ততার কোনো বালাই নেই। গণবাথরুমটিও আধা কিলোমিটার দূরে। 'দিনের বেলায় আমার স্ত্রী এনিয়ে বেশ অসুবিধার মধ্যে থাকে। প্রায়ই সে বাথরুমে যাওয়ার জন্য রাতপর্যন্ত অপেক্ষা করে'।
বসিলায় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও, এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ যায় দূরের মধ্যবিত্তদের বাসাবাড়িগুলোয়।
অন্যদিকে, বস্তির বেশিভাগ ফ্যান বা লাইট চলে ব্যাটারিতে। কেউ কেউ ভাড়ায় চালিত জেনারেটর থেকেও বিদ্যুৎ কেনে। মাসে যে টাকা আয় করেন, তার এক-তৃতীয়াংশ ঘর ভাড়ায় ব্যয় করেন জাহাঙ্গীর।
কিন্তু, এই ঘরও এখন হুমকির মুখে। জাহাঙ্গীর বলেন, 'জমির মালিক এখানে বিল্ডিং করতে চায়। আমাদের সবার ঝুপড়ি ঘর সরিয়ে ফেলবে'।
সড়কে মোটরযানেরই রাজত্ব
তার মতে, ঢাকায় দিনে দিনে বাস ও কারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আলমের ভাষায়, এসব গাড়ির চালকেরা নিজেদের 'রাস্তার রাজা' ভাবে। 'যদি তাদের মনে হয়, আমরা রাস্তায় ভুলভাবে চলছি তাহলে গালিগালাজ করে। অনেক সময় গাড়ি থামিয়ে আমাদের মারধোরও করে'। এক সময় মোটরকারের ভিড়ে ঢাকায় রিক্সাই উঠে যাবে বলে আশঙ্কা করেন জাহাঙ্গীর। তার এ ভয় অমূলকও নয়।
৯০ এর দশকের পর থেকে বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীরা ঢাকার ট্র্যাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়তা দিচ্ছে। এই ব্যবস্থা গড়েই উঠেছে মোটরযান চলাচল মাথায় রেখে, সেখানে স্থান পায়নি রিক্সার ভাবনা। যদিও শহরের ৮০ শতাংশ অধিবাসী বাসে, পায়ে হেঁটে বা রিক্সায় যাতায়াত করেন।
পরিবেশ-বান্ধব হওয়ার পরও তাই ঢাকার বিশেষ কিছু রাস্তায় রিক্সা চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
ফলস্বরূপ জাহাঙ্গীরের মতো রিক্সাচালকের আয় ৩০ শতাংশের বেশি কমেছে। অন্যদিকে, গাড়ির ধোঁয়ায় বেড়েছে কার্বন নিঃসরণ।
এই বাস্তবতায় 'জ্বালানিমুক্ত এবং বহু কর্মসংস্থান: টেকসই পরিবহন' প্রতিপাদ্য নিয়ে কাজ করছে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। কিন্তু, কার-মালিকদের সম্পন্ন লবি এবং মোটরযান শিল্পের কোম্পানিগুলোর প্রভাব-প্রতিপত্তির মুখে তাদের প্রচেষ্টা নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সাড়া ফেলবে এমন আশা ক্ষীণ।
জাহাঙ্গীর আলম বাড়ি ফিরতে চান। তিনি লেখাপড়া না জানলেও এনজিও কর্মীদের কাছ থেকে জেনেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কথা। এখন বোঝেন, তার দুর্ভাগ্যের জন্য আসলে এটাই দায়ী।
তার ভাষায়- 'দুনিয়া গরম হইতাছে, কারখানা আর গাড়ির লাইগ্যা। এই লাইগ্যা স্রোত বাড়ছে। আমাগো দেশ ডুবতেছে'।
জাহাঙ্গীর আলমের মতো লাখো জলবায়ু শরনার্থীর জন্য আশ্রয়ের শেষ ঠিকানা এই ঢাকা। কিন্তু, সেখানে তাদের জীবন নতুন পরীক্ষায় ফেলে প্রতিমুহূর্তে। তারা জানেন না, এখানেও টিকতে না পারলে, এরপর তারা কোথায় যাবেন!
- সূত্র: কান্তার ডটকম