বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট: আমাদের যা বলা হচ্ছে পরিস্থিতি তার চেয়েও করুণ
জীবাশ্ম জ্বালানি শেষের পথে, কিন্তু কোনো রাজনীতিবিদ বিষয়টি নিয়ে আমাদের সত্যটুকু বলতে চান না। আসল ঘটনা হলো, আমরা ইতোমধ্যে তেল, কয়লা, ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সমাপ্তির দিকে এগোচ্ছি। কারণ অবশ্য মজুত ফুরিয়ে যাওয়া নয়, বরং এগুলো মাটির নিচ থেকে উত্তোলনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ দিন দিন এমনভাবে বাড়ছে, যা এগুলি থেকে পাওয়া লাভের তুলনায় ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
অর্থাৎ, ফুরিয়ে আসছে কম খরচে উত্তোলনযোগ্য মজুত। অন্যদিকে সৌরশক্তি বা অন্য যেকোনো 'ক্লিন এনার্জি'র পক্ষেও তাদের বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতায় জীবাশ্ম জ্বালানিগুলোর প্রতিস্থাপক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত নেই।
জ্বালানির এ সমস্যাটা মূলত পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যা। বিশ্বের সব অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য মাথাপিছু জ্বালানি ব্যবহার বা আদতে মাথাপিছু সম্পদ পর্যাপ্ত পরিমাণে বেশি থাকতে হয়। এর বিপরীত হলেই, সভ্যতা হয়ে ওঠে পতনোন্মুখ। ইতিহাসও তা-ই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
রাজনীতিবিদেরা তাই সরাসরি বলতে পারবেন না যে বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতি ধ্বংসের পথে যাচ্ছে। বরং তারা সাধারণের সামনে নিজেদের কর্তৃত্ব নিয়ে একটি বিভ্রম তৈরি করে রাখেন।
বিশ্ব মন্দার দিকে যাচ্ছে, বুঝতে পারছে সবাই
বিশ্বের নাগরিকদের চলমান অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে মনোভাব ভীষণ নিচু। মিশিগান বিশ্বিবদ্যালয়ের বৈশ্বিক ভোক্তাদের ওপর করা এক জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০০৮-২০০৯ সালে বৈশ্বিক মন্দার সময়ের চেয়েও মানুষের এখনকার মনোভাব অনেক নিম্নস্তরে অবস্থান করছে। ৪৮ শতাংশ মানুষ তাদের জীবনমান কমে যাওয়ার পেছনে মূল্যস্ফীতিকে দায়ী করছেন।
ইউরোপের পরিস্থিতি করুণ। এ শীতে 'অন্ধকারে জমে যাওয়া'র আশঙ্কায় আছেন এখানকার অনেক নাগরিক। ডলার আর ইউরোর দাম কাছাকাছি হয়ে যাওয়ায় এখানে তেলের দাম ইউরোতে ২০০৮ ও ২০১২ সালের মতো হয়ে গেছে। রাশিয়া থেকেও প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ আগের চেয়ে কমে গেছে।
আর্জেন্টিনা, ভারত, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, তুরস্ক, জাপান, ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অনেক দেশের মুদ্রার মান ডলারের সাপেক্ষে কমে গেছে। চীনের কন্ডোমিনিমাম বাসস্থান প্রকল্পও সংকটের মুখে পড়েছে। এই সংকট সরাসরি আঘাত করতে পারে দেশটির ব্যাংকিং শিল্পে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ও ইউরোজোনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এতসব সমস্যার মাঝেও সুদহারের লক্ষ্যমাত্রা বাড়াচ্ছে। পণ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে এভাবে ইন্টারেস্ট রেটও বাড়লে ভোক্তাকে খরচ আরও কমিয়ে দিতে হবে, যার ফলে তৈরি হবে মন্দা'র পরিস্থিতি।
এনার্জির অপর্যাপ্ত সরবরাহের কারণে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সমস্যা বিষয়ে কিছু বলবেন না রাজনীতিবিদেরা
রাজনীতিবিদেরা চান বারবার ক্ষমতায় আসতে। সেজন্য তাদের লক্ষ্য হয়, নাগরিকদের বোঝানো সবকিছু ঠিক আছে। জ্বালানির সমস্যা থাকলেও সেটাকে সাময়িক বলে চালিয়ে দিতে চান। ইউক্রেনের যুদ্ধ এ সুযোগটা করে দিয়েছে। যেকোনো নতুন সমস্যাকেই তারা আইন করে বা ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেন।
ব্যবসায়ীরাও চান, সমস্যা যেন ন্যূনতম হিসেবে প্রকাশ পায়। তারা চান, তাদের ব্যবসায় চালু রাখতে; মিডিয়া যেন অর্থনৈতিক সমস্যাকে বড় করে না দেখায়, সে ব্যবস্থা করতে।
সমস্যাটি পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গেও সম্পর্কিত
এনার্জির 'খরচে'র মাধ্যমে অর্থনীতি বড় হয়। খাবার হজম হয়ে দেহে শক্তি উৎপাদন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, বিদ্যুৎ ব্যবহার করে আলো জ্বালানো; সবই এই খরচ প্রক্রিয়ার অংশ। তাই এনার্জির ব্যবহার ও বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি একে-অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর এনার্জির ব্যবহার কমে গেলে সংকুচিত হবে বৈশ্বিক অর্থনীতিও।
পদার্থবিজ্ঞানের দিক থেকে দেখতে গেলে, এই খরচ ব্যবস্থাটির একটি সীমিত আয়ু রয়েছে। তবে এ তথ্যটি এখনো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। একারণে অর্থনীতির একজন গবেষকের পক্ষে পদার্থবিজ্ঞান বোঝা বা এটি অর্থনীতিতে কীভাবে ব্যবহার করা যায়- তা জানা সম্ভব নয়।
অর্থনীতি যে একটি খরচ-কাঠামো, তা ১৯৯৬ সালের আগে কেউ বুঝতেও পারেননি। জ্ঞানের একাধিক বিভাগকে এভাবে একত্রিত করে কোনো সমস্যাকে বিশ্লেষণ করতে যথেষ্ট সময়েরও প্রয়োজন হয়।
অর্থনীতি কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা নেই অনেকের মাঝে
ক) অর্থনীতির প্রমিত মডেলের ধারণা অনুযায়ী, এনার্জির সরবরাহ না বাড়লেও অর্থনীতির ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি হতে পারে। কারণ, যখন অর্থনীতির মডেলে কেবল শ্রম আর পুঁজিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তখন এনার্জির সরবরাহের কোনো প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নেওয়া হয় না।
খ) মানুষ এটা বুঝতে পারে যে, আইন করে বাড়িভাড়া নির্দিষ্ট করে দিলে নতুন বাড়ি তৈরি বন্ধ হবে। কিন্তু, জীবাশ্ম জ্বালানির দাম কমিয়ে রাখার জন্য নেওয়া ব্যবস্থাগুলোর ক্ষেত্রে তারা একই সংযোগ খুঁজে পায় না।
জীবাশ্ম জ্বালানির দাম কমানোর চেষ্টা করা হলে আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, এতে জ্বালানি উত্তোলনের খরচ বেড়ে যাবে। বর্তমানে দাম তুলনামূলক বেশি হলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেলকূপের মালিকেরা উত্তোলনের জন্য এখন আর অর্থ বিনিয়োগ করছেন না। কারণ এর জন্য তাদেরকে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আর নতুন করে বিনিয়োগের যে খরচ, তা তেল বিক্রি থেকে উঠে আসবে না।
গ) বিশ্বে এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির ভূগর্ভস্থ মজুতের পরিমাণ কম নয়। কিন্তু সেগুলো উত্তোলন করার যে খরচ তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উত্তোলন খরচ বেড়ে গেলে জীবাশ্ম জ্বালানি ও এটি থেকে তৈরি পণ্যের দামও বাড়াতে হবে। কিন্তু দাম বাড়লে আবার চাহিদা কমে যাবে।
ঘ) 'চাহিদা' কীভাবে কাজ করে তা নিয়েও মানুষের মধ্যে পরিষ্কার ধারণা নেই। প্রায় গবেষক ও সাধারণ মানুষ মনে করেন, জ্বালানি পণ্যের চাহিদা সবসময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঁচুতে থাকবে।
বিশ্বে এখনো কয়েকশ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের মাঝে জীবনযাপন করেন। তারা যদি ন্যূনতম মৌলিক চাহিদাগুলোর বাইরে আর কিছু ক্রয় করতে না পারেন– অর্থাৎ তাদের দিক থেকে যদি চাহিদা কমে যায়– তাহলে পণ্যের দামও এত কমে যাবে যে, কেউ আর নতুন করে বিনিয়োগের আস্থা পাবে না।
যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে নাইট্রোজেন সার তৈরি করা হয়। সারের দাম বাড়লে, কৃষক সারের ব্যবহার কমিয়ে দেন। ফলে ফসলের পরিমাণও কমে যায়। এতে করে, পরোক্ষভাবে পুরো খাদ্যপণ্য খাতের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। আর এ আন্তঃসংযোগটি অর্থনীতিবিদেরা তাদের অর্থনীতির মডেলগুলোতে বিবেচনা করেন না।
ঙ) এক ধরনের এনার্জিকে অন্য ধরন দিয়ে সহজে প্রতিস্থাপন করা যায় না। 'এনার্জি রিটার্ন অন এনার্জি ইনভেস্টেড' এ জনপ্রিয় অনুমানটি সত্য নয়। যেমন প্রচলিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে বায়ুবিদ্যুৎ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যাবে না। কারণ বায়ুবিদ্যুৎ একটি অনিশ্চিত ব্যবস্থা।
শীতকালে যখন সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা যাবে না বা কম উৎপাদিত হবে, তখন সেই ঘাটতিটুকু জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে মেটানোর কথা অনেকে বলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হলো জীবাশ্ম জ্বালানিকে তখন সারাবছরব্যাপী চলমান থাকতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে- দক্ষ জনবল, পাইপলাইন, ও জ্বালানি স্টোরেজ। অর্থাৎ, তখন বিদ্যুতের জন্য একক ব্যবস্থার বদলে দুইটি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি ও বৈশ্বিক রাজনীতিবিদেরা জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য বায়ু ও সৌরশক্তি ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি বেশি ব্যবহারের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমে গেলে অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে চিন্তিত; দুপক্ষই প্রস্তাবটির অনুমোদন দিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।
ধনী ও শক্তিশালী পক্ষগুলো এ পরিবর্তনকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে, যদি তারা এটি থেকে লাভবান হতে পারে। পর্যাপ্ত জ্বালানি না থাকলে, পারিশ্রমিক ও সম্পদের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে যাবে। এছাড়া রাজনীতিবিদেরা মনে করেন, যদি তারা নাগরিকদের কম জ্বালানি খরচ করেও পরিচালনা করতে পারেন, তাহলে জনগণের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও বেড়ে যাবে।
এনার্জির ব্যবহার কমানোর একটি উপায় হলো- কোনো এলাকা বন্ধ করে দেওয়া, যেমনটা কোভিড-১৯ ছড়ানো বন্ধ করতে চীন করছে। এ ধরনের শাটডাউনকে যেমন রোগ না ছড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়, তেমনিভাবে এগুলো ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক ব্ল্যাকআউট হওয়ার মতো সমস্যাও প্রতিরোধ করা যায়।
আমরা বাস করছি অস্বাভাবিক এক সময়ে, জ্বালানি সংকট বিষয়ে ধুলো দেওয়া হচ্ছে আমাদের চোখে
বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট যে কতটা খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে, সে নিয়ে কিছু বলতে পারছেন না রাজনীতিবিদেরা। তবে বেশিরভাগ উচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদ বিষয়টি নিয়ে ঠিকই অবগত।
বিশ্বের সামরিক বাহিনীগুলোও ঠিকই জানে জ্বালানি পরিস্থিতির আসল রূপ। এর মানে হচ্ছে, বিশ্ব একে-অপরের সঙ্গে কে কত বেশি এনার্জি সংগ্রহ করতে পারে তা নিয়ে ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতায় নামবে। এ ধরনের যুদ্ধসম পরিবেশে যদি তথ্যপ্রবাহও নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাতেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। বিভিন্ন দেশের সরকার আর প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই ঠিক করে দেবেন সাধারণ নাগরিকেরা কী ধরনের তথ্য, দর্শন, ও আদর্শ নিয়ে জানতে পারবে।
- সূত্র: অয়েলপ্রাইস ডটকম থেকে সংক্ষেপে অনূদিত