রেশনিং ব্যবস্থা: ট্যানারিতে উৎপাদন নেমে এসেছে অর্ধেকে
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইতিমধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে ফেলেছে নেতিবাচক প্রভাব, তার উপর অর্থনীতির চলমান এই অস্থিরতার মধ্যেই গত জুলাই থেকে দেশব্যাপী লোডশেডিং এবং জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের ট্যানারি খাতে।
সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারারের ওভারফ্লো ঠেকাতে সিইটিপির নিয়ন্ত্রক সংস্থ্যা তথা ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃক নতুন করে আরোপিত রেশনিং পদ্ধতিতে সপ্তাহে ৩ দিন উৎপাদন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে মারাত্মক বিপাকে পড়েছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
পরিবেশ দূষণ বন্ধ করার দাবিতে ১৫ আগস্ট থেকে রেশনিং ব্যবস্থা আরোপ করা হয়।
দেশের চামড়া খাতের চলমান এই মৌসুমে রেশনিং পদ্ধতিতে সপ্তাহে ৩ দিন করে উৎপাদন বন্ধ রাখার এই সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতি উল্লেখ করে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে অতি শিঘ্রই ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই রপ্তানি খাত।
ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোস্তাক আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পরিবেশ দূষণ বন্ধে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দসহ সকল অংশীজনের সাথে আলোচনা করেই এই রেশনিং এর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সোমবার (২৯ আগস্ট) সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর বিভিন্ন ট্যানারি কারখানা পরিদর্শন করে দেখা যায়, গত কোরবানীর ঈদে সংগ্রহকৃত চামড়ার একটি বড় অংশই এখনো ওয়েট-ব্লু পর্যন্ত প্রক্রিয়াজাত করতে পারেনি অধিকাংশ ট্যানারি। এছাড়াও সাভারের হেমায়েতপুরের আড়তগুলো ঘুরে দেখা গেছে কোরবানীর ঈদে সংগৃহীত পশুর চামড়ার একটি বড় অংশই এখনো পড়ে রয়েছে আড়তে।
ট্যানারি মালিকরা বলছেন, চলমান লোডশেডিং ও রেশনিং পদ্ধতিতে সপ্তাহে ৩ দিন করে কারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কারণে অন্যান্য বছরের মত আড়ত থেকে নিয়মিত চামড়া সংগ্রহ করতে পারছেন না তারা।
তারা বলছেন, প্রতি ৬ দিন অন্তর অন্তর ৩ দিন বন্ধ থাকার মানে হচ্ছে মাসে ৯ দিন বন্ধ, আবার সাপ্তাহিক ছুটি রয়েছে মাসে ৪দিন, অর্থাৎ এক মাসে উৎপাদন বন্ধ থাকছে অন্তত ১৩ দিন।
এর আগে গত ১০ আগস্ট মোস্তাক আহমেদ সাক্ষরিত এক চিঠিতে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর ৩টি ইফ্লুয়েন্ট পাম্পিং স্টেশনের (ইপিএস) মধ্যে ১টি করে ইপিএস পর্যায়ক্রমে ৩ দিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বন্ধের সময়কালে সে-সব ইপিএস এর আওতায় থাকা ট্যানারি কারখানাগুলোর উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এই রেশনিং পদ্ধতি ১৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
পরবর্তীতে গত ২২ আগস্ট একইভাবে আরেকটি চিঠি দিয়ে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই রেশনিং পদ্ধতিতে কারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সিইটিপির বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা আরও উন্নত ও সাসটেইনেবল করার জন্য প্রতি ১ টনে ৩০ ঘনমিটার ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মোট তরল বর্জ্য উৎপাদন প্রতিদিন ২৫ হাজার ঘনমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে শিল্প ইউনিটের মালিকদের বারবার তাগিদ দেওয়া হয়। তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তা কার্যকর না হওয়ায় নদী রক্ষা কমিশন এবং বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় থেকে আগত পরিদর্শন টিম অসন্তোষ প্রকাশ করার কারণে শিল্প ইউনিটসহ সিইটিপির কমপ্লায়েন্স অর্জন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একইসাথে এসব কারণে পরিবেশ ছাড়পত্র-ও পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এসব কারণ উল্লেখ করে চিঠিতে বর্জ্যের পরিমাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ কল্পে নির্ধারিত ইপিএসগুলোর আওতায় থাকা শিল্প ইউনিটগুলোকে পর্যায়ক্রমে উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি রেশনিং অনুযায়ী বন্ধের সিডিউল জানিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে বর্জ্যের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে চলমান এই মৌসুমে রেশনিং পদ্ধতির মাধ্যমে কারখানা বন্ধ রাখার এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে এ.বি.এস ট্যানারি লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমাম হোসাইন টিবিএসকে বলেন, "যেখানে সিজনের সময় আমাদের একদিন কারখানা বন্ধ রাখার সুযোগ নেই, সেখানে সপ্তাহে ৩ দিন হারে উৎপাদন বন্ধ রাখার এমন সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী ছাড়া কিছু নয়।"
তিনি জানান, ইতোমধ্যে ঠিক সময়ে লবণজাত চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে না পারায় তার বেশ কিছু চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে।
এসময় কারখানার স্তুপ করে রাখা লবণজাত চামড়া ও সল্ট ড্যামেজ চামড়া দেখিয়ে তিনি বলেন, "এ বছর বেশি চামড়া সংগ্রহ করেছি। আগে জানলে এত চামড়া সংগ্রহই করতাম না। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা, তার উপর বন্ড লাইসেন্স না থাকায় ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিয়ে কেমিক্যাল কিনতে হচ্ছে আমাদের। এখন আবার উৎপাদন বন্ধ, আমরা কোথায় যাবো?"
আর.কে লেদার কমপ্লেক্স এর মালিক নুরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "সাধারণত আমরা ঈদের পরবর্তী দ্ইু মাসেই লবণজাত চামড়া ওয়েট ব্লু সম্পন্ন করে থাকি, কিন্তু এ বছর এখনো অর্ধেক চামড়া আমরা প্রসেসিং এ দিতেই পারিনি।"
"ওয়েট ব্লু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ৭২ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয়। সুতরাং কারখানা বন্ধ রাখার কারণে উৎপাদনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যাচ্ছে না। আবার ৩ দিন বন্ধ এক হিসাবে আমার জন্য হয়ে যাচ্ছে ৫ দিন, কারণ বন্ধের আগের দুই দিন আমরা কোন চামড়া সকিং এ দিতে পারিনা। আবার সপ্তাহে রোববার ছুটি। প্রতি মাসে যদি এতদিন উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে ব্যবসা করবো কিভাবে?" বলেন তিনি।
এবছর কোরবানীর ঈদে মোট ১ লক্ষ ২০ হাজার পিস চামড়া সংগ্রহ করেছেন জানিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন, "৬০ শতাংশ চামড়া এখন পর্যন্ত প্রসেস করতে পেরেছি, বাকিগুলো পড়ে রয়েছে। তারমধ্যে লোডশেডিং আর সময়মত প্রক্রিয়াজাত করতে না পারায় ইতোমধ্যে বিপুল পরিমাণ চামড়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেমিক্যালস, শ্রমিক ব্যয়সহ এই যে প্রায় ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে, কে দেবে এটি আমাকে?"
চামড়া শিল্পের সাথে দীর্ঘ ৪১ বছর জড়িত জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, বর্তমাস সময়ের মত এতটা বাজে পরিস্থিতি কখনো দেখেনি এই শিল্প খাত।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির মালিক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ টিবিএসকে বলেন, "প্রতি ৬দিন অন্তর ৩ দিন বন্ধ মানে এমনিতেই তো রেশনিং এ মাসে ৯ দিন বন্ধ, আবার সাপ্তাহিক ছুটি রোববার। এসব কারণে প্রতিটি ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এভাবে একটা শিল্প কখনো চলতে পারেনা।"
রেশনিং পদ্ধতির বিষয়ে মোস্তাক আহমেদ বলেন, "বারবার সতর্ক করলেও কারখানাগুলো অতিরিক্ত পানির ব্যবহার হ্রাস করেনি। বাধ্য হয়েই পরিবেশ দূষণ রক্ষায় যাতে করে সিইটিপি থেকে বর্জ্য ওভারফ্লো না হয়, সেটি নিশ্চিত করতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।"
তিনি দাবি করেন, লবণজাত চামড়া ৬ মাস পর্যন্ত ভালো থাকে।
এদিকে সামিনা ট্যানারির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও টেকনিক্যাল এডভাইজার মোখলেসুর রহমান খান টিবিএসকে বলেন, "প্রথম দফায় রক্তমাখা কাঁচা চামড়া লবণজাত করার পর তা সর্বোচ্চ একমাস ভালো থাকে। এর মধ্যে তা প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যর্থ হলে পুনরায় চামড়া ধুয়ে রি-সল্টিং করতে হয়। এতে যেমন লবণের জন্য খরচ বৃদ্ধি পায়, একইসাথে লেবার কস্টসহ আরো খরচ যোগ হয়।"
তিনি বলেন, কারখানা পর্যায়ে ঠিকঠাক রি-সল্টিং করা গেলেও আড়তগুলোতে যদি রি-সল্টিং সঠিকভাবে না করা যায়, তাহলে চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে।
"সাধারণত আমরা ২ মাসেই এই মৌসুমের সব চামড়া অন্তত ওয়েট ব্লু শেষ করে থাকি। কিন্ত এবছর তো নানাবিধ সমস্যা তৈরি হয়েছে। এবার প্রায় সকলেই বিপাকে পড়েছেন," বলেন তিনি।
এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিসিকের ব্যর্থতা ও অব্যবস্থনার জন্য পুরো খাতটি আজ হুমকির মুখে। এই পরিস্থিতির জন্য সম্পূর্ণভাবে বিসিককে দুষছেন তারা।
তাদের দাবি, যেই দূষণের কারণে হাজারীবাগ থেকে ট্যানরি শিল্পকে সাভারে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেই সমস্যা সমাধান না করেই, তথা কার্যকর সিইটিপি না করেই ট্যানারিগুলোকে সাভারে স্থানান্তর করে এখন আবার সব দায় ট্যানারির উপরই চাপাতে চাইছে বিসিক।