অরণ্যের মধ্যে এক ঘণ্টা হাঁটলে কমবে মানসিক চাপ, বলছে গবেষণা
শহুরে ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, শহুরে এলাকায় বসবাসরত মানুষেরা মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন বেশি। ২০১২ সালের একটি মেটা-বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শহুরে নাগরিকদের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি।
এছাড়াও, ২০১১ সালে ন্যাচার জার্নালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের যে অংশ ভয় ও দুশ্চিন্তার মতো আবেগগুলো নিয়ন্ত্রণ করে (অ্যামিগডালা), শহুরে নাগরিকদের মস্তিষ্কের সেই অংশটি বেশি সক্রিয়ভাবে কাজ করে। কিন্তু এর কারণটা কী? সম্প্রতি জার্মানির ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট-এ লিসে মিটনার গ্রুপ ফর এনভার্নমেন্টাল নিউরোসায়েন্সের একদল গবেষক তাদের নতুন গবেষণায় প্রকৃতির সাথে মানুষের সংযোগ এবং এর উপকারিতা নিয়ে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন।
শহুরে অঞ্চলের মানুষেরা প্রকৃতির সংস্পর্শে কম থাকেন বলেই তাদের মানসিক অসুস্থতা বেশি, নাকি বিভিন্ন স্বভাবের মানুষ বিভিন্ন পরিবেশে বাস করতে আগ্রহী, সেসব বিষয় তারা গবেষণার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করেছেন।
যেভাবে গবেষণাটি পরিচালিত হলো
গবেষণার হাইপোথিসিস নির্ধারণের জন্য গবেষকরা ৬৩ জন সুস্থ-সবল অংশগ্রহণকারীকে বেছে নেন। তাদেরকে বলা হয় ১ ঘন্টা বনের মধ্যে হাঁটতে কিংবা কোলাহলপূর্ণ রাস্তায় এক ঘন্টা শপিং করতে। এই দুটি কাজের আগে একবার ও পরে একবার ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রিজোন্যান্স ইমেজিং (এফএমএরআই) এর মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ পরীক্ষা করা হয়।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৮ থেকে ৪৭ বছর বয়সী ২৯ জন মহিলা এবং ৩৪ জন পুরুষ ছিল। তাদের গড় বয়স ছিল ২৭ বছর। প্রতিটি অংশগ্রহণকারীকে একটি এফএমআরআই স্ক্যান করা হয়েছিল। স্ক্যানের সময় তাদেরকে বেশ কয়েকটি টাস্ক দেওয়া হয়। এর মধ্যে দুটি টাস্কের কথা গবেষণায় আলোচনা করা হয়েছে।
প্রথম টাস্কের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীদের ১৫ জন পুরুষ এবং ১৫ জন নারীর ভীত ও স্বাভাবিক অভিব্যক্তির ছবি দেখানো হয়েছিল। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, অংশগ্রহণকারীদের একটি গাণিতিক টাস্ক দেওয়া হয়েছিল। সেটি সমাধানের জন্য যে সময় দেওয়া হয়েছিল, তা আসলে অংশগ্রহণকারীর সক্ষমতার বাইরে ছিল।
স্ক্যানিং শেষ করার পর ৩১ জনকে পাঠানো হয় বার্লিনের ব্যস্ততম রাস্তায় হাঁটতে এবং ৩২ জনকে পাঠানো হয় শহরের মধ্যেই অবস্থিত একটি বনে হাঁটতে। ২০১৯ সালের কোনো এক দিনে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টার মধ্যে এই হাঁটা-পর্ব সম্পন্ন করেন অংশগ্রহণকারীরা। বলে রাখা ভালো, দুটি দলেই নারী-পুরুষের সংখ্যা সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়।
অংশগ্রহণকারীদের সাথে ফোন দেওয়া হয়েছিল যাতে তারা সঠিক দিকনির্দেশনা বজায় রাখতে পারেন। একটি করে রিস্টব্যান্ড দেওয়া হয়েছিল তাদের ইলেক্ট্রোডার্মাল অ্যাক্টিভিটি (ইডিএ), হার্ট ভ্যারিয়েবিলিটি রেট ও হার্ট রেট পর্যবেক্ষণে রাখতে। হাঁটতে হাঁটতে ক্ষুধা পেলে খাওয়ার জন্য খাবারও প্যাকেট করে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ৩০ মিনিট পর অ্যালার্ম দেওয়া হয়েছিল যেন তারা আবার ফেরার পথে ঘুরে রওনা দিতে পারেন।
অংশগ্রহণকারীরা ফিরে আসার পর গবেষকরা তাদেরকে সেই একই টাস্ক করাতে থাকেন এবং সেই সময় আরেকটি এফএমআরআই স্ক্যান করেন।
গবেষণার ফলাফল
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, মাত্র এক ঘণ্টা বনের মধ্যে হাঁটার ফলেই অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা অংশের ক্রিয়া কমে গিয়েছে। কিন্তু শহুরে রাস্তায় হাঁটার সময় মস্তিষ্কের ঐ অংশটি সক্রিয়ই ছিল, সেখানে দুশ্চিন্তার মাত্রা কমেনি বা বাড়েনি। এ থেকে বোঝা যায় যে, শহুরে পরিবেশ মানুষের মধ্যে বাড়তি দুশ্চিন্তার জন্ম দেয়।
বাস্তব জীবনে প্রয়োগ
ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের গবেষণাটির প্রধান লেখক সনজা সুডিম্যাক জানান, এ গবেষণার সূত্রে ধরে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছেন যে প্রকৃতি-বনায়নের মধ্যে সময় কাটালে মানসিক অসুস্থতা থেকে দূরে থাকা যায়। ঠিক তেমনই, যত বেশি শহুরে জীবনে জড়িয়ে পড়বেন, মানসিক স্বাস্থ্যের উপর তত বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সুডিম্যাক আশাবাদী যে এ ধরনের গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়ে শহরের মধ্যে সবুজ বনায়নের পরিবেশ তৈরি করা হবে। তিনি বলেন, "যেহেতু বৈশ্বিক জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশিই শহরে থাকে এবং নগরায়ন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই শহুরে বাসিন্দাদের জন্য এমন কিছু পার্ক বা বন থাকা জরুরি, যেখানে ঘুরেফিরে-হাঁটাহাঁটি করে তারা মানসিক চাপ কমাতে পারবেন।"
এক ঘণ্টার কম সময় হাঁটা কী উপকারী?
যেহেতু গবেষণার কাজে অংশগ্রহণকারীদের এক ঘণ্টা হাঁটতে বলা হয়েছিল, তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে, এর চাইতে কম সময় হাঁটাও কার্যকরী কিনা?
তবে সুডিম্যাক জানিয়েছেন, তারা এক ঘন্টা সময়ই বেঁধে দিয়েছিলেন কারণ এর চেয়ে বেশি হাঁটলে কেউ কেউ ক্লান্ত হয়ে যেতে পারতো। তিনি বলেন, "প্রকৃতির মধ্যে ১৫ মিনিট হাঁটলেও স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল কমে যায়। তাই এক ঘন্টার কম সময় হাটলেও অ্যামিগডালার ক্রিয়া কমে যায় কিনা তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারলে দারুণ হবে।"
তবে অ্যালাবামার একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, কারেন স্টুয়ার্ট এ গবেষণার সাথে শতভাগ একমত হতে নারাজ। তিনি মনে করেছেন, মস্তিষ্কে দুশ্চিন্তা-চাপ কমানোর কাজটি প্রকৃতির সংস্পর্শ ছাড়াও, অন্যকিছুর সাথেও যুক্ত থাকতে পারে।
তার ভাষ্যে, হাঁটার ফলে যে শারীরিক ব্যায়াম হচ্ছে, তার কারণেও মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা অংশের ক্রিয়া কমে যেতে পারে।
সকল শ্রেণীর মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা
ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের গবেষকরা স্বীকার করেছেন যে তাদের নমুনার মধ্যে কিছুটা সমস্যা আছে। অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই ছিলেন শিক্ষিত, আধুনিক ব্যক্তি। কিন্তু ভবিষ্যতে তারা এ গবেষণায় বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী ও ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকে উঠে আসা মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে চান। সাংস্কৃতিক পরিবর্তন কিভাবে প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রেও পার্থক্য এনে দেয়, তা বুঝতে চান গবেষকরা।
এর পাশাপাশি, মস্তিষ্কের ওপর বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ, যেমন: নদ-নদী, বোটানিক্যাল গার্ডেন, পাহাড় কী কী প্রভাব ফেলে তা নিয়েও গবেষণা করতে চান তারা। এছাড়া, প্রকৃতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, নির্দিষ্ট কোনো গন্ধ, শব্দ, রঙ মানুষের মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা অংশে আলাদা আলাদা কী প্রভাব ফেলে সেটি নিয়েও কাজ করতে চান গবেষকরা।
সূত্র: মেডিকেল নিউজ টুডে