বাংলাদেশের নারী ও ফুটবল এগোচ্ছে আর এগোচ্ছেই...
ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের তৃতীয় গোলের পর নেপালের ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, "বাংলাদেশের সোনার মেয়েরা খেলার সোনালী যুগের প্রতিনিধিত্ব করছে।"
কঠোর পরিশ্রম, জাতীয় কর্তব্যবোধ এবং দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ দলকে হারানোর সংকল্প নিয়ে সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের মেয়েরা আদতেই সোনালী যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছে। গ্রুপের শেষ ম্যাচে ভারতকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়েছে তারা। এটি এক অবিশ্বাস্য ঐতিহাসিক জয়। ভারত এর আগে কখনো সাফ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে পরাজিত হয়নি।
এ খেলায় বাংলাদেশ মোট ১০ বার ভারতের মুখোমুখি হয়েছে। এরমধ্যে ৯ বারই তারা হেরেছে, ড্র হয়েছে মাত্র একবার। কিন্তু এই ১৩ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার, বাংলাদেশ ভারতকে শুধু ব্যাপকভাবে হারায়নি বরং ৯ পয়েন্ট নিয়ে তালিকার শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছে যায়। ১-০ এর স্কোর যদিও বাংলাদেশ দলের জন্য বেশ ভালো একটি বিষয়, কিন্তু তালিকায় দুই দলের মধ্যকার ব্যবধান বাংলাদেশি নারী ফুটবল দলের ক্রমবর্ধমান শক্তির ইঙ্গিত দেয়।
অপ্রত্যাশিত জয়?
ভারতীয় দল সম্ভবত বাংলাদেশ দলের থেকে পাল্টা লড়াইয়ের আশা করেছিল, কিন্তু নিজেদের পরাজয়ের আশা তারা করেনি। ভারতীয় দলের ম্যানেজার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তাদের পরিকল্পনা ছিল তালিকার শীর্ষে যাওয়ার। তাছাড়া, পূর্বের রেকর্ডও একই দিকে ইঙ্গিত করছিলো। বাংলাদেশকে ভারত প্রতিবারই হারাতে পেরেছে, তাহলে আর একবার কেন নয়?
ভারতীয় ক্রীড়া ওয়েবসাইট খেলনাও ডটকম আসন্ন ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ সম্পর্কে বলেছে: 'ভারতীয় দল চলমান সাফ ২০২২ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে আধিপত্য বিস্তার করছে। ভারত ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন। দেশটি টুর্নামেন্টের আগের পাঁচটি এডিশনই জিতেছে। শুরুর দুটি ম্যাচ এবং সেগুলোর ফলাফল বিচার করলে যেকোন প্রতিপক্ষের পক্ষেই ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলকে আটকানো কঠিন হবে।'
'বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আসন্ন ম্যাচটি হবে গ্রুপ এ-এর শেষ ম্যাচ, যেটি ভারত সহজেই জিতে গ্রুপ লিডার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে বলে আশা করছে।'
এবারের চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ মালদ্বীপকে ৩-০ এবং পাকিস্তানকে ৬-০ গোলে হারিয়েছে এবং ভারত মালদ্বীপকে ৯-০ ও পাকিস্তানকে ৩-০ ব্যবধানে পরাজিত করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ভারত উভয়ই শীর্ষস্থানীয় দুটি দল। কিন্তু খেলা শুরু হওয়ার পর ভারতকে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিমান মনে হতে থাকে।
দ্বিতীয় গোল হওয়ার পর একটি ভারতীয় লাইভ ব্লগে বলা উদ্ধৃতি দেওয়া হলো: ভারত ০-২ 'বাংলাদেশ, ২৫ মিনিট: বাংলাদেশের এই দুই গোলের লিড প্রাপ্য। তাদের খেলা দেখে আপনি বলবেন না যে তারা ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১৪৭তম স্থানে রয়েছে, ভারতের থেকে ৮৯ স্থান নিচে। এই ম্যাচে আশালতা দেবী অ্যান্ড কোং (ভারতীয় দল)কে হতবাক দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের চাপ প্রতিরোধ করতে পারছে না তারা' (দ্য ওয়্যার)।
আর বাংলাদেশ?
ম্যাচ-পূর্ব সাক্ষাৎকারে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছিলেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। "আমরা জানি ভারত অনেক শক্তিশালী এবং পেশাদার দল, যাদের অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। র্যাংকিং এ তারা আমাদের উপরে। কিন্তু আমরা আমাদের উপরে থাকা মালয়েশিয়াকে হারিয়েছি। আমরা আমাদের সেরাটা দেব," এই শান্ত আত্মবিশ্বাসই তাদেরকে জিতিয়েছে।
সেমিফাইনালে ভুটানের বিপক্ষে বাংলাদেশের হোঁচট খাওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এখন দেশের যে ফর্ম রয়েছে তাতে এ সম্ভাবনার আশঙ্কাও কম। তবে কেউ আসলে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারবে না কারণ ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়টাও ছিল অপ্রত্যাশিত। তবুও অনেকে ভাবছে বাংলাদেশ এই ম্যাচেও জয় পাবে।
বাংলাদেশ দল নিশ্চিতভাবেই আরও পরিপক্কতা দেখাচ্ছে বলে মিডিয়াকে জানিয়েছেন দলের ম্যানেজমেন্ট ও খেলোয়াড়েরা।
ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের হয়ে দুইবার গোল করা সিরাত জাহান স্বপ্না বলেন, "সমস্ত উদযাপন মাঠেই শেষ হয়ে গেছে। একবার হোটেলে ফেরার পর আমরা আহতদের চিকিৎসা করি, পেশীতে, ব্যথায় বরফ দেই। আমরা জানি সেমিফাইনাল কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পুরো মনোযোগ সেমিফাইনালে। ভুটানকে হালকাভাবে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তারা তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে সেমিফাইনালে পৌঁছেছে এবং আমরা তাদের যোগ্যতার প্রাপ্য সম্মান দিয়েই ম্যাচে নামবো।"
বাংলাদেশের ওভাররেটেড ক্রিকেট দল থেকে এই ফুটবল দলটি আসলেই বেশ ভিন্ন। অর্থসম্পদে পরিপূর্ণ ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়রা বেশিরভাগ সময়ই খেলার বাইরের বিষয়ের জন্য আলোচনায় থাকে। প্রেস কনফারেন্সের সর্বদাই তাদের মধ্যে অহংকার দেখা যায়, হোক সেটা পাপন কিংবা দলের নতুন কোনো খেলোয়াড়ের কনফারেন্স।
দুঃখের বিষয়, তারা তাদের পারফরম্যান্সের সাথে এই অহংকারের যোগসাজশ রাখতে পারেনি। অনেকের কাছে তারা ওভাররেটেড এবং অতিরিক্ত সুবিধাভোগী; যেখানে নারী ফুটবল বা ক্রিকেট দল বরাবরই অবহেলিত।
সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়েছে যে খ্যাতি
পাকিস্তানের সাবেক সিনিয়র পুরুষ দলের সহকারী কোচ এবং মাশা ইউনাইটেড মহিলা দলের কোচ নাসির ইসমাইল নাসির 'দ্য নিউজ'কে বলেছেন, তিনি জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে মাশা ইউনাইটেডের জন্য বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের সহায়তা নেবেন। "ইনশাআল্লাহ আমরা জাতীয় ইভেন্টের জন্য সাবিনার শরণাপন্ন হব। আমরা একটি শক্তিশালী দল গঠন করছি।"
বাংলাদেশের মেয়েদের এই জয়ে চাপে পড়েছে পুরুষ দল। টুর্নামেন্টে বিদেশ সফরের সময় ছোটন উল্লেখ করেন, নারী দলের পারফরম্যান্সের কারণে দর্শকদের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে।
তবে টুর্নামেন্টের আসল খেলা হবে ফাইনালেই। বাংলাদেশ ফাইনালে উঠলে প্রতিশোধ নিতে উঠেপড়ে লাগবে ভারত। কিন্তু আপাতত জয়ের খরা কেটেছে। বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দল বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। পরেরবার উভয় দল (বাংলাদেশ-ভারত) মুখোমুখি হলে বাংলাদেশকে গুরুত্ব সহকারে নেবে তার প্রতিপক্ষ।