ডলার কেনায় খরচ কমেছে ব্যাংকগুলোর
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নানা পদক্ষেপে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানেই ডলারের দাম কমতে শুরু করেছে ইন্টারব্যাংকে ডলার কেনাবেচায় ও ব্যাংকগুলোর ডলার কেনার গড় দামে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রোববার ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে ডলার কেনাবেচা করছে সর্বোচ্চ ১০৫ টাকা ৫০ পয়সায়। আগের দিনের ১০৬ টাকা ৭৫ পয়সা রেটের তুলনায় দাম কমেছে ১ টাকা ২৫ পয়সা।
ব্যাংকারদের মতে, ডলারের বাজারে আগের তুলনায় সংকট অনেক কমেছে। তবে, বাজারের স্থিতিশীলতা নিয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য করতে আরো কয়েক মাস অবজার্ভের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
ব্যাংকারদের সভায় এক্সপোর্ট প্রসিডে ৯৯ টাকা ও রেমিট্যান্সের ডলার ১০৮ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত হয় গত ১১ সেপ্টেম্বর। পরদিন থেকে ব্যাংকগুলো সেটি বাস্তবায়ন শুরু করে।
এছাড়া, ডলার কেনার দর নির্ধারণেও নতুন একটি সূত্রের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় ব্যাংকগুলোকে। এই সূত্র অনুযায়ী, ৫ দিনের ডলার কেনার দরের ওয়েটেড এভারেজ নিয়ে ডলার কেনার দর নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর আগে ব্যাংকগুলো প্রতিদিনের ডলার কেনার দর ওইদিনের কেনা ডলারের দাম থেকেই ঠিক করা হতো।
বাংলাদেশ ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও এবিবির বেশ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহে তাদের প্রথম অর্জন ইন্টারব্যাংক ডলার লেনদেন চালু হওয়া।
ডলারের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের একটি দাম নির্ধারণ করে দিতো। সে দামেই ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে ডলার লেনদেন করতো। তবে অস্থিতিশীল সময়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি খুব বেশি সংস্কার করেনি। ফলে প্রায় ৫ মাসের মতো ইন্টারব্যাংক লেনদেন বন্ধ ছিল।
এই রেট নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নমনীয়তার কারণেই ফের ইন্টারব্যাংক লেনদেন চালু করা গেছে। গত কিছুদিন আগেও ডলারের সংস্থানে রেমিট্যান্সের কোন বিকল্প ছিল না। ইন্টারব্যাংক লেনদেন চালু হওয়ায় রেমিট্যান্সের ডলারে চাপ কিছুটা হলেও কমেছে।
ইন্টারব্যাংক লেনদেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের দর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ডলারের দরে নিম্নমুখী প্রবণতা রয়েছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমবারের মতো বাফেদা ও এবিবি থেকে পাওয়া রেটটিকে 'ইন্টারব্যাংক এক্সচেঞ্জ রেট অব টাকা' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ওয়েবসাইটে পাবলিশ করছে। ওইদিন ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা দরে ১৬ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বলে জানা গেছে।
পরদিন দর কিছুটা বেড়ে ১০৬ টাকা ৯০ পয়সা হয়, সেদিন লেনদেন হয় ৩৫ মিলিয়ন। তবে গত দুই কার্যদিবস ধরে ইন্টারব্যাংক লেনদেনে ডলারের দাম কমেছে। সর্বশেষ গত ১৮ সেপ্টেম্বর দাম আগের দিনের তুলনায় ১ টাকা ২৫ পয়সা কমে ১০৫ টাকা ৫০ পয়সা বিক্রি হয়েছে।
ইন্টারব্যাংকে ডলারের দর কমে আসার প্রবণতা বাজারের স্থিতিশীলতার একটা ইঙ্গিত বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। এছাড়া এই বাজারে ডলার লেনদেনের পরিমাণও প্রতিদিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, "এক্সপোর্ট প্রসিডে ডলারের রেট কম দেওয়া এবং এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে রেমিট্যান্স কেনায় রেট বেশি দেওয়া ব্যাংকগুলোর ভুল সিদ্ধান্ত। বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে ডলার একটা নির্দিষ্ট দামে কেনাবেচা হয়। আর আমাদের দেশে ডলারের দাম ভিন্ন ভিন্ন। এটা দীর্ঘ সময়ে হতে পারে না। আমাদের একটা নির্দিষ্ট দামে ফিরে আসতে হবে।"
"এর একটা উপায় হতে পারে ইন্টারব্যাংক এক্সচেঞ্জ রেটকে ফলো করা। এর চেয়ে বেশি দামে রেমিট্যান্স কেনা উচিত হবে না। এক্সপোর্টাররা এই রেটের চেয়ে ১ টাকা কমে পেতে পারে। এতে দেশের রপ্তানিকারকেরা উৎসাহিত হবে। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মনিটরিং বাড়াতে হবে," যোগ করেন তিনি।
এছাড়া, বিভিন্ন ব্যাংকের মধ্যে ডলার কেনার দরের যে পার্থক্য ছিল সেটি ধীরে ধীরে কমে আসছে। এটিকে রেট নির্ধারণের দ্বিতীয় অর্জন বলে দেখছে ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকগুলোর ডলার কেনার গড় দামের যে তথ্য দিয়েছে বাফেদা, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত ১২ তারিখে ব্যাংকগুলোতে ডলারের গড় দাম ছিল ১০৩ টাকা ৪৩ পয়সা। এদিন ব্যাংকভেদে ডলার কেনার সর্বনিম্ন দাম ৯৮ টাকা ও সর্বোচ্চ দাম ১১০ টাকা ১৮ পয়সা ছিল। অর্থাৎ, এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের সর্বোচ্চ ব্যবধান ১২ টাকার বেশি।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে সোমবার ব্যাংকগুলোর গড় নির্ধারণ হয়েছে ১০২ টাকা ৫৬ পয়সা। ব্যাংকভেদে ডলার কেনার সর্বনিম্ন দাম ৯৮ টাকা ৬৫ পয়সা ও সর্বোচ্চ দাম ১০৭ টাকা ৯২ পয়সা ছিল। ব্যবধান নেমে এসেছে ৯ টাকায়।
এত কম সময়ে ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা নিয়ে মন্তব্য করা যায় না উল্লেখ করে এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হুসেইন বলেন, দাম বাড়া বা কমা মানেই স্ট্যাবিলিটি না।
তিনি বলেন, "আমদানি বাড়লে ডলারের দাম বাড়বে, আবার আমদানি কমলে ডলারের দামও কমে আসবে। এক্সপোর্ট ও ইনওয়োর্ড রেমিট্যান্স যত বাড়াতে পারবো, ডলারের দাম কমবে। ডলারের দাম একটু কম থাকা মানে আমাদের ট্রেড ডেফিসিটটা কমে যাচ্ছে।"
বাজার স্থিতিশীল হতে সময় লাগবে বলে জানান তিনি।