জাতীয় দলের কলসিন্দুরের ৮, কোনো বাধাই যাদের দমাতে পারেনি
২০১১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ঘোষণা দেওয়া হয় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট আয়োজনের। খবরটি কানে আসে ময়মনসিংহ জেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী উপজেলা ধোবাউড়ার কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মফিজউদ্দিনের।
নিজের স্কুলের জন্য দল গঠনে লেগে যান তিনি। সানজিদা তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। সানজিদা যোগ দেয় স্কুলের টিমে। এরপর একে একে টিমে নাম লেখায় মারিয়া মান্দা, শিউলি আজিম। তাদের দেখে উৎসাহিত হয়ে যোগ দেয় মারজিয়া আক্তার, শামছুননাহার, তহুরা, সাজেদা, শামছুননাহার জুনিয়র। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে যাত্রা শুরু করা এই খেলোয়াড়েরা প্রত্যেকেই এখন জাতীয় দলে।
স্কুলে টিম গঠন হওয়ার পর কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মফিজউদ্দিন নিজেই শুরু করেন প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল নেন তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব। ২০১২ সালে জেলায় শুরু হয় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট। প্রথমবারের মতো অংশ নেয় কলসিন্দুর প্রাথামিক বিদ্যালয়। জাতীয় পর্যায়ে রানার্সআপ হয় সানজিদা, মারিয়া, তহুরারা। চ্যাম্পিয়ন না হতে পারার আক্ষেপ নিয়ে ফিরে আসে তারা। শুরু করে নতুন করে প্রস্তুতি।
কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মফিজউদ্দিনের মুখ থেকে জানা যায়, শুরুটা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল।
"গ্রামের অভিভাবকেরা রক্ষণশীল। মেয়েদের ফুটবল খেলতে দেওয়ার কথা শুনতেই পারতেন না। অভিভাবকদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করার ক্ষেত্রে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। এরপর মেয়েদের নিয়ে যখন মাঠে নেমেছি অনেকেই ঠাট্টা-মশকরা করেছে। প্র্যাক্টিসের সময় মাঠের আশপাশে থাকতো উৎসুক মানুষের ভিড়। অনেকেই আমাকে বিদ্রূপ করতো। তবে সাহায্য করতেও এগিয়ে এসেছেন অনেকে। লোকের তির্যক মন্তব্যের জবাব মুখে নয়, মাঠে দিতে চেয়েছিলাম। মেয়েরা পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুল ছুটির পর ও বন্ধের দিনে মাঠে প্র্যাকটিস করতে থাকে। একপর্যায়ে আসে সফলতা।"
শিক্ষক মফিজউদ্দিনের পরিশ্রম বৃথা যায়নি।
২০১৩ সালে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। এরপরই স্থানীয় প্রশাসন ও ক্রীড়ামোদী ব্যক্তিদের নজরে আসে সানজিদা, মারিয়ারা। অল্প করে হলেও মিলতে থাকে সুযোগ সুবিধা।
২০১৪ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে মারিয়া মান্দা, শামসুননাহার জুনিয়র। এমন সফলতা দেখে এগিয়ে আসে অন্য মেয়ে শিক্ষার্থীরা। দিনদিন বাড়তে থাকে কলসিন্দুর স্কুলটিমের সদস্য সংখ্যা।
কলসিন্দুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল জানান, "শুরুতে প্রধান সমস্যা ছিলো 'সংকোচ'- এটি সমাধানে সময় লেগেছে। কিন্তু আমরা পেরেছি লোকলজ্জার ভয় দূর করে খেলার পোশাকে মাঠে মেয়েদের নামাতে। এখন আমাদের গর্ব হয়। আমি একটি ইতিহাসের স্বাক্ষী।"
তিনি জানান, এখনো স্কুলে প্র্যাক্টিস হয়। ক্লাস থ্রি থেকে শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছে ফুটবলে।
সানজিদার বাবা লিয়াকত আলী বলেন, "মেয়ের আগ্রহ ও শিক্ষকদের কথার কারণে ফুটবল খেলতে দিয়েছি। গ্রামের লোকজন বিষয়টি প্রথমে ভালোভাবে নেয়নি। পরে যখন নামডাক ছড়িয়ে পড়ে তখন আর সমস্যা হয়নি।"
নারীদের ফুটবলে এগিয়ে যাওয়ার কারণে কলসিন্দুর গ্রামের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। গারো পাহাড়ের সীমান্তবর্তী অবহেলিত এই গ্রামে বিদ্যুৎ আসে ফুটবল কন্যাদের খ্যাতির কারণে। পাকা হয় রাস্তাঘাট। ফুটবল কন্যাদের বদৌলতে সরকারিকরণ হয়েছে কলসিন্দুর স্কুল এন্ড কলেজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মেয়েদের সংবর্ধনাসহ আর্থিক অনুদানও দিয়েছেন।
এই কিশোরীদের গল্প উচ্চ মাধ্যমিক শাখার একাদশ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। 'দ্য আনবিটেন গার্লস' (অপরাজিত মেয়েরা) শিরোনামে পাঠ্যবইয়ে একটি বিশেষ পাঠ রাখা হয়েছে। গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা কিশোরীদের সফলতার গল্প লেখা হয়েছে এই পাঠে। সানজিদা, মারিয়া, তহুরা, শামসুন্নাহার, শিউলি আজিম, নাজমা আক্তার, মারজিয়া আক্তারদের জীবনী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও অকালে মৃত্যুবরণ করা সাবিনা খাতুনকে নিয়ে লেখা হয়েছে। এদের মাঝে সানজিদা আক্তার পুরো এশিয়ায় সপ্তম স্থান অধিকার করা, মারিয়া মান্দা অনুর্ধ্ব-১৫ অধিনায়ক এবং তহুরা খাতুন আন্তর্জাতিক সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ায় তাদের নিয়ে সচিত্র পাঠ রয়েছে।
কলসিন্দুর সরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক মালা রাণী সরকার বলেন, "আমাদের মেয়েদের নাম জাতীয় পাঠ্যবইয়ে। আমরা খুবই আনন্দিত-গর্বিত।"