কোভিড স্থবিরতা কাটিয়ে বিশ্ববাজারে পা রাখতে চায় বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্প
বিশ্ববাজারে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে চায় বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্প। সংশ্লিষ্ট শিল্প নেতারা বলছেন, খাতটি ইতোমধ্যেই মহামারির ধাক্কা থেকে ফিরে আসতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্পের আর্থিকমূল্য ৫৫ হাজার কোটি টাকা (৬২ মিলিয়ন ডলার), যা বিশ্বব্যাপী দেশটিকে স্ক্র্যাপ জাহাজের দ্বিতীয় বৃহত্তম গন্তব্য এবং প্রায় ৪,০০০,০০০ টন আমদানি নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তাদের মধ্যে একটি হিসেবে জায়গা করে দিয়েছে। মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ইস্পাত ও কাঁচামাল সম্মেলনে বক্তারা জানান, দেশের ইস্পাত গলানোর ক্ষমতা ২০২৫ সালের মধ্যে ১৩,০০০,০০০ টনে গিয়ে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিএসআরএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির আলিহুসেন বলেন, করোনভাইরাস মহামারির কারণে ইস্পাত শিল্প খুব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে; এর ফলে ফ্রেইট চার্জ, কাঁচামাল এবং পরিবহনসহ সামগ্রিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপরে এসেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ; এর ফলে জ্বালানি শক্তির দামও বেড়েছে।
"জনবহুল দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ, চীন বা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সবসময়ই জমজমাট থাকে। তবুও খাদ্য ও নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে মানুষের জীবন প্রভাবিত হয়। সবকিছুর দাম বৃদ্ধির কারণে এই মুহূর্তে ইস্পাতের চাহিদা কিছুটা কমেছে," বলেন তিনি।
"আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে চাই এবং বিশ্ববাজার দখল করতে চাই। সেই লক্ষ্যেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি," যোগ করেন আলিহুসেন।
মূল বক্তৃতায়, সিঙ্গাপুরের ডুফার্কো এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শুভেন্দু বোস বলেন, ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এইচআরসি'র দাম এশিয়ায় ৪০০ থেকে ৬০০ ডলারের মধ্যে ছিল। এ সময় এইএমএস'র দাম ছিল ২৩০ থেকে ৪০০ ডলারের মধ্যে। স্থিতিশীল বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি এবং খরচের মাধ্যমেই এই দাম নির্ধারিত হয়েছিল।
"২০২১ সালে বৈশ্বিক ইস্পাত ঘাটতির সময় পুরানো এই মূল্যসীমা ভেঙ্গে যায়। কোভিড-পরবর্তী চাহিদা পুনরুদ্ধাররে ক্ষেত্রে ইস্পাতের উৎপাদন বজায় রাখা ছিল কঠিন। ২০২২ সালে আমরা এর নতুন দৃষ্টান্ত দেখেছি, কারণ এ সময়ে বেশিরভাগ উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে চাহিদা হ্রাস পেয়েছে; মূলধন এবং জ্বালানি শক্তির উচ্চ খরচসহ অন্যান্য আরও কারণে এমনটি ঘটেছে," যোগ করেন তিনি।
সম্মেলনে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি এবং দেশ-বিদেশে ব্যবহৃত লোহা ও ইস্পাত পণ্যের সম্ভাবনা, ইস্পাতের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, সংকট ও সার্বিক পরিস্থিতি, গুণমান, বর্তমান টেকসই প্রযুক্তি, জাহাজ ভাঙা, আধুনিক বাজার নীতি ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন সেশনে বক্তব্য দেন।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সুফি মুহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, "ইস্পাত হচ্ছে আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি। ইস্পাত শিল্পের মান, মূল্য সৃষ্টি এবং বাজার সম্প্রসারণে এই সম্মেলন ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আমাদের সবাইকে এই শিল্পের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।"
বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলী হুসাইন আকবরআলী বলেন, "এই সম্মেলন দেশের ইস্পাত খাতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইস্পাত পণ্য রপ্তানিকারকরা সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত উৎপাদনকারী কোম্পানি রয়েছে। সব পক্ষের মধ্যে এটি একটি সহজ সংযোগ তৈরি করেছে। সারা বিশ্বের এতগুলো সংস্থার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা দেশের অনেক সংস্থার জন্যই ব্যয়বহুল এবং কঠিন হতো।"
ইস্পাত শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কয়েক দিন পরেই ইস্পাত বাজারে এই অঞ্চল থেকে ইস্পাত রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ইউক্রেনে সামরিক পদক্ষেপ এবং রাশিয়া ও বেলারুশের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে এই রপ্তানি হ্রাস ঘটেছে।
বিশ্বব্যাপী উৎপাদন হ্রাসের কারণে ইস্পাত শিল্পের অবস্থা খারাপ হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে বিশ্বের প্রধান বাজারগুলোতে ইস্পাতের দাম স্থিতিশীল রয়েছে।
"ইস্পাতের ব্যবহার ধীরে ধীরে কমছেই, তার ওপর উৎপাদনও এতটাই কমছে যে, আগামী সপ্তাহগুলোর জন্য বাজারের গতিবিধির পূর্বাভাস দেওয়াও খুব কঠিন। পরিবর্তনগুলো খুব দ্রুত ঘটছে এবং বর্তমান সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য একেবারেই পরিষ্কার নয়," বলেন শুভেন্দু বোস।
দেশের ইস্পাত উৎপাদন এবং চাহিদা পরিস্থিতি, বৈশ্বিক বাণিজ্য ধারায় পরিবর্তন, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতি, জাহাজের পুনর্ব্যবহারযোগ্যতা, উদীয়মান বিভিন্ন খাত, দামের প্রবণতা এবং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় সম্মেলনে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, অস্ট্রিয়া, তাইওয়ান, চীন এবং জাপানসহ ২৯টি দেশের শিল্প নেতারা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।