দুঃসাহসী, স্বপ্নজয়ী মেয়েরা
একের পর এক ফ্ল্যাশলাইটের ঝলকানি, সারাদেশের মানুষের প্রশংসা-সমর্থন, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বাহবা, দেশে ফেরার পর ছাদখোলা বাসে উল্লাস...সাফ চ্যাম্পিয়ন জয়ের পর মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পাল্টে গেছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের জীবন!
কিন্তু রাতারাতি তারকা বনে গেলেও, মাসুরা, মারিয়া, রুপনা চাকমারা যে জীবন কাটিয়েছেন এতদিন, তার সাথে বর্তমানের আকাশচুম্বী খ্যাতির তুলনা হয় না। যে সংগ্রাম-ত্যাগের মধ্য দিয়ে তারা এতটা পথ এসেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন লাল-সবুজের পতাকাকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেওয়ার, সেই সংগ্রামের গল্পও দেশবাসীর না জানলেই নয়!
রূপনা চাকমা: দুঃখের আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনা!
এখনো ঘুমঘোরে দূর অতীতে ফিরে যান কালাসোনা চাকমা। বাবাহীন সংসারের হাল ধরতে পড়াশোনায় এগোতে না পারা দুই ছেলে জুম চাষেই খুঁজে নিয়েছিলো জীবনের নির্ভরতা। নুন আনতে পান্তা ফুরনো সংসারে অভাব অনটনই ছিলো নিত্যসঙ্গী। অথচ ছোট্ট মেয়ে রূপনা আর দশটা মেয়ের মত হলোনা! সে সারাদিন মেতে থাকে ফুটবলের কি এক আজব নেশায়।
প্রাইমারি স্কুলে পড়তেই নিজ স্কুলের হয়ে খেলতে যায় বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবলে, রাঙামাটি স্টেডিয়ামে! সেখানেই নজরে আসে ফুটবলপাগল এক শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ানের। প্রাইমারির গন্ডি পেরোতেই চন্দ্রা তাকে নিয়ে যান তার স্কুলে, বাড়ি থেকে অনেক দূরের ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানেই এক শিক্ষকের বাসায় থেকে পড়াশুনা আর খেলাধুলা রূপনার। এখনো ওই স্কুলের দশম শ্রেণীর মানবিক বিভাগে ছাত্রী সে। ঘাগড়া স্কুলের হয়ে ২০১৬ সালে গ্রীষ্মকালীন ফুটবলে মাধ্যমিকে কলসিন্দুর হাই স্কুলকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন ঘাগড়া স্কুল টীমের সদস্য রূপনা। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
জাতীয় দলে প্রায় নিয়মিতই খেলে আসছে গোলরক্ষক পজিশনে খেলা রূপনা। আজ সেই রূপনা চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের গর্বিত সদস্য। প্রতিপক্ষের একের পর এক আক্রমণ সাহসের সাথে রুখে দিয়ে হয়েছেন আসরে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ নারী ফুটবল গোলরক্ষক! মেয়ের কারণেই আজ ভাঙ্গা কুড়েঘরটি পাকা দালান করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। সাথে মিলেছে বাড়ি যাওয়ার পথের ভাঙ্গা সেতুটিও পাকা করার আশ্বাস। বাড়িতে বড় বড় অফিসাররা আসছেন,সারাক্ষক সংবাদকর্মীদের আনাগোনা, যেন প্রায় বিচ্ছিন্ন জীবনে হঠাৎই আলোর রেখা!
কিন্তু কি ভাবছেন কালাসোনা চাকমা!
খুব ভালো করে বাংলা বলতে পারেন না ষাটোর্ধ্ব এই নারী! অনর্গল চাকমা ভাষায় বলে যাচ্ছেন নিজের কথা,যার বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়-'বৃষ্টি এলেই পানিতে ভেসে যায় ঘর,চালের ফাঁক দিয়ে পানি পড়ে। টাকা পয়সাতো নাই নাই,ঠিক করার এসব। মেয়ে যা আয় করে তা দিয়েই তো চলে সংসার। মাত্র কিছুদিন আগে বসতের এই জায়গাটা কিনেছি। এটা এখন আমাদের নিজেদের জায়গা। স্বপ্নতো ছিলই একদিন বাড়ি হবে,কিন্তু কিভাবে হবে জানতাম নাহ। মেয়েই তো সব করে সংসারের। গতকাল(মঙ্গলবার) ডিসি স্যার বলে গেলেন, বাড়ি করে দিবেন। আজ (বুধবার) জানলাম প্রধানমন্ত্রী বাড়ি করে দিতে বলেছেন। আজকেই দেখি ইউএনও স্যার, ইঞ্জিনিয়ার স্যার আসলেন, মাপজোক নিলেন। এখন মনে হচ্ছে সত্যিই বাড়ি হচ্ছে আমাদের ! কিভাবে যে বলি, কি যে খুশি লাগছে। সবই আমার মেয়ের অবদান। তার জন্যই আমাদের কপাল ফিরেছে। এই লক্ষ্মী মেয়েটাই আমাদের সব।'
কথা বলতে বলতে কালাসোনা চাকমার চোখ ভিজে আসছে। না, বেদনায় নয়, আনন্দাশ্রুতে আপ্লুত এক মায়ের বুকের ভেতর থেকে বয়ে আসা ভালোবাসা তখন মুগ্ধতা হয়ে ঝরছে চারপাশে! এমন অর্জনের তৃপ্তি হয়ত মায়েরাই সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করতে পারেন!
পাহাড়ে যদি কোনদিন নারী ফুটবলের ইতিহাস লিখতে হয়, তবে তিনজন মানুষকে বাদ দিলে সেই ইতিহাস অসমাপ্তই থাকবে। এরা তিনজন হলেন শিক্ষক বীরসেন চাকমা, কোচ শান্তিমনি চাকমা ও শিক্ষক-অভিভাবক চন্দ্রা দেওয়ান। চন্দ্রা দেওয়ান রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। চ্যাম্পিয়ন জাতীয় ফুটবল দলের চার খেলোয়ার আনাই মগিনী, আনুচিং মগিনী, রূপনা চাকমা, মনিকা চাকমা চারজনই তার স্কুলের ছাত্রী। ঋতুপর্ণাও তারই স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থী। ২০১৬ সালে এই স্কুলটিই কলসিন্দুর উচ্চ বিদ্যালয়কে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়।
নিজের ছাত্রী রূপনা চাকমার কথা জিজ্ঞেস করতেই আপ্লুত চন্দ্রা দেওয়ান বলেন, "এখনো চোখে ভাসে সেদিনের ছোট্ট রূপনা। বঙ্গমাতা ফুটবল প্রতিযোগিতায় তার স্কুল থেকে খেলতে আসে। তার খেলা দেখেই তাকে পছন্দ করে ফেলি আমি। তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে ষষ্ঠ শ্রেণীতেই তাকে ভর্তি করাই আমার স্কুলে, ফ্রিতে পড়াশুনার সুযোগ দিয়ে। তার পরিবারের অবস্থা নিতান্তই খারাপ,বাবা নেই। তাই তাকে আমাদেরই এক শিক্ষক নলিনী কুমার চাকমার বাসায় রেখে পড়াশুনা করাই আমরা। ২০১৬ সাল থেকেই সে অনেকটা নিয়মিত জাতীয় দলে।"
পুরনো স্মৃতি মনে করে চন্দ্রা দেওয়ান জানালেন, ফুটবল খেলার শুরু থেকেই গোলকিপার পজিশনেই খেলে রূপনা। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ জেদী সে। গোল আটকাতে না পারলে রাগ
নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না সে। জেদ চেপে বসতো ভালো করার, নিজেকে শাণিত করার। যে কঠিন পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে সে, সেটা সবার পক্ষে সম্ভব না। ফুটবলের প্রতি তার অবিশ্বাস্যরকম ভালোবাসা!
আবেগে উচ্ছ্বসিত চন্দ্রা দেওয়ান বলতে থাকেন, 'এই মেয়েগুলোর এতদূর আসার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। এদেরকে স্কুলের একটি রুমে থাকতে দিয়ে,খাবার যোগাড় করার জন্য কত জায়গায় যে গেছি, কতজনের কাছে যে হাত পেতেছি, শুধু তারাই জানেন। এরা আমার ছাত্রী না, আমার সন্তান। এদের অর্জনে মনে হয়, আমার সন্তানই যেনো অর্জন করল । এরা এখন আমার জীবনেরই অংশ। এদের জীবনের দু:খ-বেদনা, আনন্দের ভাগীদার আমিও। আমার মেয়েরা আরো অনেকদূর যাবে। কারণ এদের আমি শিখিয়েছি, সবার আগে দেশ, তারপর অন্যসব পরিচয়।' প্রাথমিকের শিক্ষক ও ফুটবল অন্তপ্রাণ বীরসেন চাকমা আর কোচ শান্তিমনি চাকমার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভোলেননি আপাদমস্তক ফুটবলপ্রেমি এই নারী।
মারিয়া মান্দা: দিনমজুর থেকে জাতীয় তারকা!
ময়মনসিংহের ধোবাউরা উপজেলার গামারীতলা ইউনিয়নের একটি গ্রাম কলসিন্দুর। অজপাড়াগা বলতে যা বোঝায় তার থেকেও পিছিয়ে পড়া একটি জনপদ এটি। তবে সাফ শিরোপাজয়ী না্রী ফুটবল দলের আট সদস্যের বাড়ি এই কলসিন্দুরেই। তাদের কল্যাণেই কলসিন্দুর এখন দেশব্যাপী পরিচিত। কলসিন্দুর গ্রামে বসবাস ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি গারো পরিবারের মেয়ে মারিয়া মান্দার।
বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত "নেতাই" নদীর পারে থাকে মারিয়া মান্দার পরিবার। ফুটবলের কল্যাণে মারিয়াকে এখন সবাই চেনে। কিন্তু না, রাতারাতি কোনো আলাদিনের চেরাগ পেয়ে মারিয়া সফল হয়নি। তার এই সফলতার পেছনের গল্প হার মানাবে যেকোনো নাটক সিনেমা্র গল্পকেও!
নেতাই নদী পার হয়ে দেড় কিলোমিটার পায়ে হেটে যাওয়ার পর মন্দির কোনা পাড়ায় মারিয়ার মায়ের টিনের ভাঙ্গাচোরা বাড়ি। একটু জোরে দমকা হাওয়া এলেই বাড়িসুদ্ধ লুটিয়ে পরতে পারে মাটিতে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবার হওয়ায় মারিয়ার মা এনোতা মান্দা বীরেন্দ্র মারাককে বিয়ে করে নিজ বাড়িতে এনেছিলেন। মারিয়ার বয়স যখন তিন বছর তখন তার বাবা মারা যায়।
ঘরে তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে জীবন সংগ্রামে নামেন মারিয়ার মা এনোতা মান্দা। বন্ধ হয়ে যায় বড় মেয়ে হাসি মান্দার স্কুলে যাওয়া। মেঝো মেয়ে পাপিয়া মান্দা কোনদিনই স্কুলে যেতে পারেনি। সংসার চালাতে ঢাকায় গৃহপরিচারিকার কাজে দেয়া হয় হাসি মান্দা ও পাপিয়া মান্দাকে। ছোট ভাই ডানিয়াল মান্দা তখন মায়ের কোলে। নিজেদের কোনো জমিজমা নেই। কিছু খাস জমি চাষাবাদ ও অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করে সংসার চানিয়েছেন এনোতা মান্দা।
চরম অভাব অনটনের সাথে লড়াই করেই বড় হতে থাকে মারিয়া মান্দা। মা ও বড়বোন মিলে তাকে ভর্তি করেদেয় কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তখন থেকেই খেলাধুলার দিকে ঝোঁক তার। 'দৌড়' খেলায় বিশেষ পারদর্শী ছিল মারিয়া। বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের জন্য যখন কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী ফুটবল টিম গঠনের কাজ শুরু করেন প্রধান শিক্ষক। তখন ডাক পড়ে দৌড়ে পারদর্শী মারিয়া মান্দার। এখান থেকেই শুরু নতুন যাত্রার।
কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল বলেন, "মারিয়াকে যখন দলে নেয়া হয় তখন সে মাত্র তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে। তার বাড়ি একেবারেই প্রত্যন্ত এলাকায় হওয়ায় স্কুল ও খেলার অনুশীলনে যাওয়া-আসার সমস্যাটা ছিলো বড়। তার বাবা নেই, ঘরে অভাব অনটন... এ অবস্থায় খেলায় নেয়ার জন্য মারিয়ার মাকে অনেক বোঝাতে হয়েছে। মেয়ের আগ্রহ আর মায়ের পরিশ্রমে আজকের মারিয়া মান্দা। যার পরিচয় সে আমার ছাত্রী নয়, বরং আমি তার শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি। আজ প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলসিন্দুর স্কুলকে দেশের মানুষ মারিয়া, সানজিদাদের জন্য চেনে।"
২০১৩ সালে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। তখন কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে ছিলেন মো: মফিজউদ্দিন। নারী ফুটবলারদের খেলা শেখানো ও প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এই টুর্নামেন্টটি খালি পায়ে খেলার সুযোগ ছিলো।
শিক্ষক মো: মফিজউদ্দিন বলেন, যখন দেখলাম খালি পায়ে খেললে সামনে আরো বড় টুর্নামেন্ট খেলা সম্ভব হবেনা তখন বুট পরে খেলা শেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন চতুর্থ শ্রেনীতে পড়া মারিয়ার ফুটবল খেলার বুট ছিলোনা। আমার কাছ থেকে দুই দিনের ছুটি নেয় সে। সেই দুই দিন অন্যের কৃষি জমিতে ধান রোপণের জন্য দিনমজুরের কাজ নেয় সে। কাজ করে তিনশ টাকা মজুরি পেয়ে সেই টাকা দিয়ে কেনে বুট জুতা। নতুন জুতা আমাকে যখন দেখাতে আনে, তার মুখের আনন্দের হাসিটি এখনো আমার মনে আছে।"
মো. মফিজউদ্দিন আরও বলেন, "পরে যখন জানতে পেরেছি ফুটবলের বুট জুতা কেনার জন্য অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করেছে চতুর্থ শ্রেনীর এই ছোট্ট মেয়ে, তখন খারাপ লেগেছে। খেলার জন্য প্রয়োজন শক্তি, সেজন্য দরকার পুষ্টসমৃদ্ধ খাবার। তখন প্রয়োজন ছিলো মারিয়ার জন্য উন্নত খাবার। কিন্তু তখন কেউ এগিয়ে আসেনি, খালি পেটে বা অর্ধ খালি পেটে খেলতে হয়েছে মারিয়াকে।"
যে জনপদে ছিলো ধর্মীয় গোড়ামি ও বাল্য বিয়ের প্রচলন সেখানে মারিয়ার ফুটবল খেলার পথ মোটেই সহজ ছিলোনা। মারিয়ার বোন পাপিয়া মান্দা বলেন, "যখন দেখলাম গ্রামে থেকে কাজ করেও সংসার চলছে না, তখন আমিও ঢাকায় মানুষের বাসায় কাজ করতে চলে যাই। বছরে একবার বড়দিনের সময় আসতাম বাড়িতে। মারিয়া আর আট দশটা মেয়ের মতো বড় হতে পারেনি। এখন এত অল্প বয়েসে সংসারের হাল ধরেছে সে।"
মারিয়ার বড় বোন হাসি মান্দা বলেন, "প্রতিবেশিরা অনেকে অনেক কিছু বলেছে। এলাকায় মেয়েদের ফুটবল খেলার প্রচলন নেই দেখে মারিয়াকে অন্যচোখে দেখতো তারা। মেয়ে মানুষ ফুটবল খেলে কি হবে এইসব বলতো। তখন আমি মারিয়াকে বলতাম, মানুষের কথায় কান দিও না, তুমি খেলা চালিয়ে যাও। শুরুতে প্রতিবেশিরা যারা মারিয়াকে টিটকারি টিপ্পনি দিত, এখন তারাই উৎসাহ দেয়, মারিয়া ভালো খেললে উল্লাস করে। এটা দেখে ভালো লেগেছে।"
মারিয়ার মামা জেফ সাংমা বলেন, মারিয়ারা আগে একটি কুড়ে ঘরে থাকতো। তাদের অসহায় অবস্থা দেখে ২০০৮ সালে কারিতাস নামক এক্টি এনজিও একটি টিনের ঘর করে। বর্ষায় যখন নদীতে পানি বেশি হয়ে যেত, তখন অনেক সময় সাঁতরে নদী পার হয়ে স্কুল মাঠে গেছে মারিয়া। খেলা তার জীবনের সব। তিনি জানান সম্প্রতি দুই কাঠা জমির মালিক হয়েছে মারিয়ার মা। আর কিছু খাস জমিতে নিজেই ধান চাষ করে চলছে সংসার।
জেলা পর্যায়ের ডিএফএ টুর্নামেন্টের সময় বাফুফে কর্মকর্তাদের নজরে আসে মারিয়া। ডাক পড়ে অনুর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলার জন্য। মারিয়া পাড়ি জমায় ঢাকায়। ২০১৪ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে মারিয়া মান্দা বেশ ভালো পারফরমেন্স দেখায়। পরের বছরই তাজিকিস্তানে অনুর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টে অংশ নেয় মারিয়া। সেখানেও সেরা পারফরমেন্স, এবারও চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। মারিয়া সেখানে সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এএ্ফসি অনুর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টের বাছাই পর্বের খেলায়ও ছিলো মারিয়ার আধিপত্য। অনুর্দ্ধ-১৫ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের অধিনায়কের দায়িত্ব পায় মারিয়া। অত্যন্ত দক্ষতা আর নিজের নিখুঁত ফুটবল খেলা দিয়ে মারিয়া বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব। এরপরের গল্পের সাক্ষী তো বাংলাদেশের সবাই!
নিজের ভাগ্য নিজেই গড়লো মাসুরা
মাসুরা পারভীনের ডাক নাম মুক্তা। সাফ জয়ী নারী ফুটবল দলের ডিফেন্ডার হয়ে খেলেছেন। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে বেড়ে ওঠা তার। অভাবের তাড়নায় ভ্যানচালক বাবা রজব আলী পূরণ করতে পারেননি সব আবদার। খেয়ে না খেয়ে, অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা মাসুরা এখন দেশের পরিচিত মুখ।
সাতক্ষীরা শহরের বিভিন্ন স্থানে ভাড়া বাসায় থাকতেন মাসুরার বাবা রজব আলী। সাত মাস আগে সরকার সদর উপজেলার বিনেরপোতা এলাকায় রাস্তার পাশে আট শতক জমি দেয় রজব আলীকে। জমিটিও পেয়েছেন মাসুরার ভালো ফুটবল খেলার উপহার হিসেবেই।মাসুরার ভালো পারফরমেন্সের কারণে ২০১৬ সালে তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী সাতক্ষীরা সার্কিট হাউজে সংবর্ধনা দেন মাসুরা পারভীন মুক্তাকে।
পরিবারটির করুণ চিত্র মন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মোহাম্মদ মহিউদ্দীন। মন্ত্রীকে জানান পরিবারটির নিজস্ব কোন জমি ও ঘরবাড়ি নেই। সে সময় জেলা প্রশাসককে দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিবারটিকে জমি ও ঘর দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেন মন্ত্রী। এরপর থেকেই জমি ও ঘরের আশায় থাকেন রজব আলী। অবশেষে ২০২০ সালে শহরের অদূরে বিনেরপোতা এলাকায় রাস্তার পাশে ৮ শতক জমি দেন জেলা প্রশাসক মোস্তফা কামাল। তবে বাড়ি নির্মাণ করে দেয়নি প্রশাসন। সরকারের দেওয়া সেই জমিতে টিনের ছাউনী দিয়ে ছোট একটি বাড়ি করেছেন রজব আলী। ঘর বানানোর পর ভাড়াবাসা ছেড়ে ১১ মাস আগে থেকে এখানেই বসবাস করছে মাসুরার পরিবার।
মাসুরার বয়স এখন ২২ বছর। সাতক্ষীরা শহরের পিএন স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে স্কুল শেষে পাশে থাকা খেলার মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতো মাসুরা। মাঝেমধ্যে বল কুড়িয়ে দিত বর্তমান নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনাকে। এভাবেই একটু একটু করে তীব্র হচ্ছিলো তার খেলার প্রতি আগ্রহ।
ভ্যানচালক বাবার রোজগারে চলতো না সংসার। বাড়ির খাবার ফুরিয়ে গেলে নিরুপায় হয়ে মা ফাতেমা বেগম বাবার বাড়ি থেকে চাল-ডাল এনে সংসার চালাতেন। বাবা রজব আলীর ভ্যানটি ভেঙে গেছে। এই ভ্যানে করে ফল বিক্রি করতেন তিনি। ভ্যানটি পড়ে রয়েছে এখন বাড়ির আঙ্গিনায়। রজব আলী বলেন, "আমি এখন অসুস্থ হয়ে গেছি। ওষুধপত্র খেতে হয়। ভ্যানটি ভেঙে চালানোর অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পায়ের ভ্যান চালানোর মত শারীরিক পরিস্থিতিও নেই। মাসুরা বলেছে এবার বাড়ি এসে আমাকে একটা মোটরভ্যান কিনে দেবে। যেন আমার কষ্ট দূর হয়।"
মাসুরার সম্পর্কে তিনি বলেন, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে যখন শুধু খেলাধুলা করতে চাইতো আমি বাধা দিতাম। মনে করতাম, মেয়ে মানুষ খেলাধুলা করলে খারাপ দেখায়, মানুষ খারাপ বলবে। কিন্তু মাসুরা ছিল নাছোড়বান্দা। এক পর্যায়ে অনুমতি দিলাম। মাছুরার এমন আগ্রহ নজরে পড়ে কোচ আকবর আলীর। এরপর থেকে আকবর আলী মাছুরাকে খেলা শেখাতো। দুই ,আস আগে সেই কোচ আকবর আলী মারা গেছেন। মাছুরার সাফ জয়ের কৃতি দেখে যেতে পারলেন না বলে আক্ষেপ করেন রজব আলী।
২০১৪ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে যোগ দেয় মাসুরা। এর আগে খুলনার বিজেএমসি ক্লাবের হয়ে খেলাধুলা করতো। এখন রাজধানীর বসুন্ধরার ফুটবল ক্লাবেও খেলছে। খেলাধূলা করতে গিয়ে টিমের হয়ে জার্সিগুলো পেতো মাসুরা। টিমের দেওয়া পায়ের বুট ছিঁড়ে গেলে কিনতে হতো। সেই বুটও ধারদেনা করে কিনে দিয়েছেন তার বাবা।
মেয়ের জয় নিয়ে রজব আলী বলেন, "আমি খুব খুশি। এই জয় দেশের মানুষের জয়। আগে রাস্তায় গেলে অনেক মানুষ বলতো এই লোকের মেয়ে ফুটবল খেলে, কটূ কথা শোনাতো, বিদ্রুপ করতো। আর এখন সবাই বলছে, তোমার মেয়ে জিতে গেছে, বাংলাদেশ দল জিতেছে। অনেক প্রশংসা করছে। গর্বে আমার বুক ভরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার টাকা নেই তাতে কি আমার মুক্তা রয়েছে।"
মাসুরা পারভীনের মা ফাতেমা বেগম বলেন, "মেয়ের এমন জয়ে আমি খুব খুশি। জয়ী হওয়ার পর নেপাল থেকে ফোন দিয়েছিল। আমার জন্য, দুই বোন-বাবার জন্য কেনাকাটা করে নিয়ে আসবে বলেছে। এছাড়াও বাবাকে সংসারের খরচের টাকা দেয়। সেটাতেই এখন সংসার চলছে।"
এদিকে বিজয়ী মাসুরা বলেন, "আগে অনেক মেয়েরা খেলাধুলা জানতো না। আমরা যে জয়টা করেছি এটা পুরো বাংলাদেশ দেখেছে। মেয়েরাও দেখছে। এখন আমাদের বলা লাগবে না এখন তারা নিজেরাই আসবে। খেলাধুলা লেখাপড়া এক সাথে থাকা ভালো দিক। আজ যদি আমি খেলাধুলা না করতাম তবে কোথায় থাকতাম আমি নিজেও জানি না। এই পর্যন্ত আসা সম্ভব ছিল না।"