বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবন: আ জার্নি টু রিমেম্বার
জীবনে অনেক রাস্তা ধরেই হেঁটেছেন সাবিনা, কৃষ্ণা, স্বপ্নারা; গাড়িতে চড়ে পাড়ি দিয়েছেন চেনা-অচেনা কতো না পথ। বাংলাদেশের মেয়েরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় খেলার পাশাপাশি বিদেশ সফরে গিয়েছেন বেশ কয়েকবার। সফরকালে কতোই তো অভিজ্ঞতা হয়েছে বাংলার অদম্য এই মেয়েদের। কিন্তু হযরত শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবনে যাওয়ার এই ৪ ঘণ্টা তাদের কাছে কেমন?
মেয়েদের কাছ থেকে এই প্রশ্নের উত্তর না নিলেও চলছে। তাদের চোখেমুখে ফুটে ওঠা উচ্ছ্বাস ও উদযাপনই সব বলে দিয়েছে। স্বপ্নের মতো এই দিনটা, বিশেষ করে ছাদখোলা বাসে করে আনন্দ ভ্রমণের চার ঘণ্টা তাদের জীবনের সেরা মুহূর্ত। সাবিনা, মারিয়া মান্ডারা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলেছেন; 'দিনটা কখনও ভুলবার নয়।' রাজসীক অভ্যর্থনায় প্রকাশ করেছেন কৃতজ্ঞতা।
মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ, এটা কয়েক দিনের পুরনো খবর। হাজার, লক্ষ, কোটিবার লেখা হয়েছে এ নিয়ে। ছাদখোলা বাসে ট্রফি প্যারেডও এখন এক দিনের পুরনো। কিন্তু এতে যে ঘটনার জন্ম হয়েছে, তা পুরোপুরি নতুন আর তরতাজা। ইতিহাস গড়ে দেশে ফেরা মেয়েদের হাত ধরেই জন্ম নিয়েছে আরেক ইতিহাস।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে ছাদখোলা বাসে চেপে এভাবে উদযাপন করার মুহূর্ত আগে কখনও আসেনি। ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতা বাংলাদেশ যুবাদেরকে চ্যাম্পিয়ন্স স্টিকার সমৃদ্ধ মিনি বাসে করে বিসিবিতে নেওয়া হয়েছিল। বিসিবিতে হয়েছিল কয়েক মুহূর্তের উদযাপন।
এ ছাড়া ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম আনন্দ উদযাপনের উপলক্ষ আইসিসি ট্রফি জয়ের পর উল্লাসে মেতেছিল পুরো দেশ। শিরোপা জয়ের একদিন পর বিমান পাঠানো হয় ক্রিকেটারদের নিয়ে আসতে। চার্টার্ড ফ্লাইটে ক্রিকেটাররা মালয়েশিয়া থেকে ঢাকায় আসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরো দলকে সংবর্ধনা দেন সংসদ ভবনের খোলা জায়গায়। তবে ছাদখোলা বাস বা পুরো শহর ঘুরে এমন উদযাপন এবারই প্রথম হলো। দিনটা তাই সাবিনাদের মনের মতো বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গেনের ইতিহাসেও অমর-অক্ষয় অক্ষরে লেখা হয়ে গেল।
ফাইনালের আগে ম্যাচ জেতার তাড়নার পাশাপাশি কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই সানজিদা আক্তার তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, 'ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই।' সানজিদার এমন পোস্ট দেখে পরের দিনই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বিআরটিসির বাসটি প্রস্তুত করে ফেলে।
মেয়েদের আসার খবরে হযরত শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে ওঠে উৎসবের মঞ্চ। চ্যাম্পিয়ন দলটিকে বহন করা বিমান পৌঁছার অনেক আগেই ভক্ত-সমর্থক, ফুটবলপ্রেমীরা গিয়ে হাজির হন বিমান বন্দরে। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) এক ঝাঁক দুরন্ত কিশোরী ব্যানার হাতে দাঁড়ান অগ্রজদের অভ্যর্থনা জানাতে। ততোক্ষণে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমও গিয়ে হাজির সেখানে। ভক্ত, সমর্থকদের শুভেচ্ছা বার্তা প্রকাশ করে সময় কাটছিল সংবাদকর্মীদের।
মূল উদযাপনের শুরু ১টা ৪৫ মিনিটে। ঢাকায় পা রেখেছেন মেয়েরা, এটা শুনতেই বাইরে উল্লাসে ফেটে পড়ে মেয়েদের বরণ করে নিতে বিমানবন্দরে ভিড় জমানো জনতা, চলতে থাকে স্লোগান। বিমান থেকে নামার পর ফুলের মালা দিয়ে বাংলাদেশ দলকে বরণ করে নেওয়া হয়, কাটা হয় কেক। বিমানবন্দরের ভিআউপি লাউঞ্জের সামনে তখন শত শত ক্যামেরা, মোবাইল তাক করা।
মেয়েরা বেরিয়ে আসতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সংবাদকর্মী, সাধারণ মানুষের ভীড় ঠেলে সামনে এগোনোই দায় হয়ে পড়ে মেয়েদের। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে সংবাদ সম্মেলন বাতিল করার ঘোষণা দেয় বাফুফে। যদিও ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে অল্প সময় নিয়ে হয় সংবাদ সম্মেলন। কথা বলেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুন, কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল।
স্বপ্নের ভ্রমণের শুরু হয় বেলা সাড়ে তিনটায়। ফুলেল শুভেচ্ছা, মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া বাংলাদেশের মেয়েরা ও দলের বাকি সদস্যরা চড়েন ছাদখোলা বাসে। সামনে পেছনে দুটি পুলিশের গাড়ি, দুটি কভার ভ্যানে ব্যান্ড পার্টি নিয়ে শুরু হয় যাত্রা। পেছনে ছুটছিল সংবাদমাধ্যমের গাড়িগুলো। সঙ্গে ভক্ত সমর্থকদের মোটর সাইকেলের বহর। ছাদখোলা বাসে চড়েই উল্লাসে ফেটে পড়া মেয়েরা জনতার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে, শিরোপা উঁচিয়ে, ছবি তুলে, লাইভ করে উদযাপন শুরু করেন। আর গাড়িতে বেজে যাচ্ছিল গর্জে ওঠো বাংলাদেশ, লাল সবুজের বিজয়ের নিশান, জয় বাংলা, বাংলার জয়, চ্যাম্পিয়ন গানগুলো।
ছাদখোলা বাসটি বিমানবন্দর থেকে বনানী, মহাখালী, জাহাঙ্গীর গেট, বিজয় সরণী হয়ে তেজগাঁওয়ে প্রবেশ করে। এরপর সাতরাস্তা, মগবাজার, কাকরাইল, আরামবাগ, মতিঝিল শাপলা চত্বর হয়ে গিয়ে পৌঁছায় বাফুফে ভবনে। মেয়েদের সব সময়ের ঠিকানা এই ভবনে পৌঁছাতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টা। এ সময়ে পুরোটা পথ রাস্তার দুই পাশে শতশত মানুষ দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা জানান সাবিনাদের। রাস্তার মাঝে নেমেও গাড়ির পেছনে পেছনেও অনেকে দৌড়াতে থাকেন।
সাফের রানিদের ৪ ঘণ্টার এই স্বপ্নের ভ্রমণে ছিল বিপত্তিও। ছাদখোলা বাসে উদযাপন করতে গিয়ে আহত হন ঋতুপর্ণা চাকমা। রাস্তার পাশের বিলবোর্ডে লেগে মাথার কিছুটা অংশ কেটে যায় বাংলাদেশের এই মিডফিল্ডারের। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেলাই পড়ে তিনটি। যদিও এতে উৎসবে ভাটা পড়েনি। চোট গুরুতর না হওয়ায় বিজয় উল্লাস করতে করতে এগোতে থাকে ট্রফি প্যারেড। চিকিৎসা নিয়ে পরে ঋতুপর্ণা যোগ দেন বাফুফে ভবনে।
ঢাকাকে অনেকেই জাদুর শহর বলেন, অনেকে আবার বলেন যানজটের শহর। যে নামেই ডাকা হোক, বুধবার ঢাকা হয়ে উঠেছিল উৎসবের শহর। ট্রফি প্যারেডে স্বাভাবিকভাবেই ঢাকায় যানজটের সীমা ছিল না। গন্তব্যে পৌঁছাতে রাস্তায় থাকা অনেকেই আটকে গেছেন ছাদখোলা বাসের পেছনে। কিন্তু এই আটকে পড়া বা যানজটে কারও মাঝে অস্বস্তি দেখা যায়নি, ছিলো না কোনো অভিযোগও। দীর্ঘ সময় যানজটে বসে থেকেও সাবিনাদের সাথে সুর মিলিয়ে উল্লাস করে গেছেন সবাই। দেশের ইতিহাসে যে দিনটা আগে কখনও আসেনি, সেই দিনের স্বাক্ষী হওয়াতেই সব আনন্দ খুঁজে নিয়েছেন তারা।