বেগুনে ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি, রয়েছে ক্যান্সারের ঝুঁকি: গবেষণা
দেশে বেগুন উৎপাদনের বিখ্যাত এলাকা জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার কয়েকটি স্থানের বেগুনে লেড, নিকেল, ক্যাডমিয়ামসহ একাধিক ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। উপাদানগুলোর স্বাভাবিক যে পরিমাণে থাকার কথা তার থেকেও কয়েকগুণ উপস্থিতি রয়েছে। যা নিয়মিত গ্রহণের ফলে ক্যান্সারের মতো রোগ হতে পারে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের গবেষণায় সম্প্রতি এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন আনিকা বুশরা, এইচ এম জাকির, শায়লা শারমিন, কিউ এফ কাদির, এম এইচ রশিদ, এম এস রহমান ও সুপ্তি মল্লিক।
সায়েন্স জার্নাল 'নেচার পোর্টফোলিও' তে গত ২২ আগস্ট প্রকাশিত হয় এটি।
গবেষকরা বলছেন, ক্ষতিকর এসব উপাদানসহ এ সবজি দীর্ঘদিন গ্রহণ করলে মানবদেহে ক্যান্সারসহ নানা ধরনের রোগ বাড়তে পারে। এজন্য দেশব্যাপী বেগুনসহ অন্যান্য সবজির উপর হেভি মেটালের এ গবেষণা বৃহৎ আকারে চালানো দরকার।
খামারিদের ব্যবহার করা মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক কিংবা সারের মাধ্যমে জমিতে লেড, নিকেল, ক্যাডমিয়ামসহ ক্ষতিকর উপাদান সবজিতে প্রবেশ করতে পারে বলেও গবেষকরা মনে করছেন।
জামালপুরের স্থানীয় কৃষি অফিসাররা বলছেন, বেগুনের এসব ক্ষতিকর উপাদান আছে কিনা সে বিষয়ে তাদের গবেষণা নেই। যেহেতু বেগুন উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়ছে না তাই এসব বিষয় ভেবে দেখেননি তারা।
তবে কৃষকরা বেগুনের বাগানে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে এবং সেখান থেকে মাটি ও বেগুনে ক্ষতিকর উপাদানের পরিমাণ বাড়তে পারে বলে ধারণা তাদের।
এটোমিক এবসরপশন স্পেকট্রোফোটোমিটার (এএএস) ব্যবহার করে বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত বেগুন উৎপাদনকারী এলাকা থেকে ৬০টি টপ সয়েল (মাটির উপরের উর্বর অংশ) এবং ৮০টি বেগুনের নমুনায় ট্রেস মেটালের উপস্থিতি নির্ণয় করার জন্য গবেষণাটি করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ জাকির হোসেন বলেন, "আমরা জামালপুর জেলার ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার ২০ স্থানের ৮০টি বেগুনের স্যাম্পল এবং ৬০টি স্থানের মাটির স্যাম্পল নিয়ে কাজ করেছি। এতে আমরা অধিকাংশ স্যাম্পলেই লেড ও নিকেলের উপস্থিতি পেয়েছি যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। ঐ এলাকার মাটিতেও এ উপাদানের উপস্থিতি বেশি। সার কিংবা কীটনাশক থেকেও এ উপাদান মাটিতে ছড়াতে পারে।"
এ গবেষক বলেন, "আমরা যেসব উপাদানের উপস্থিতি পেয়েছি সেগুলোর মধ্যে লেড, নিকেল ও ক্যাডমিয়ামকে ক্ষতিকর হিসেবে নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করেছি। তবে অন্য উপাদানগুলোর উপস্থিতিও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে কিন্তু সেগুলো চেক করার ব্যবস্থা আমাদের নেই। আমরা এই তিনটি উপাদানকে ধরেই গবেষণাটি করেছি।"
তিনি বলেন, "এ এলাকা বাছাইয়ের কারণ এখানে বেগুন চাষ বেশি হয়। এতে প্রাথমিক উৎস হিসেবে মাটিকেই ধরা হয়েছে। তবে কিছু স্যাম্পলের মাটিতে এ উপাদানের উপস্থিতি কম থাকলেও বেগুনে আধিক্য পাওয়া গেছে। অধিকাংশ স্যাম্পলের মাটিতে হেভি মেটাল অতিরিক্ত পরিমাণে পেয়েছি।"
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও গবেষক দলের সদস্য আনিকা বুশরা টিবিএসকে বলেন, "আমরা যখন স্যাম্পলগুলো সংগ্রহ করেছি তখন মাঠের পরে মাঠ জুড়ে বেগুনের ক্ষেত ছিল এলাকাগুলোতে। আমরা বাগান থেকেই সরাসরি বেগুনগুলো সংগ্রহ করেছি। বেগুনগুলো সংগ্রহ করে সেগুলো ওভেনে শুকিয়ে ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়েছে।"
জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার কৃষি অফিসার এ. এল. এম. রেজুয়ান বলেন, "এ এলাকার বেগুন কিংবা মাটিতে ক্ষতিকর উপাদানের আধিক্য আছে কিনা সেটা আমাদের জানা নেই। তবে অধিকাংশ কৃষকই বেগুনে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করেন। যারা আমাদের থেকে পরামর্শ নেন তারা আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করেন।"
তিনি বলেন, "এ এলাকায় গত বছরের তুলনায় এ বছর বেগুন উৎপাদন আরও বেশি হয়েছে। যেহেতু বেগুন উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়ছে না সেহেতু আমরা তেমন কোনো গবেষণা করছি না এসব বিষয়ে। তবে এসব উপাদান যদি বেশি থাকে সেটার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হবে না কিন্তু নিয়মিত এ সবজি গ্রহণকারী নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে।"
জামালপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মুহাম্মদ হারুন অর রশীদ টিবিএসকে বলেন, "ক্ষতিকর এসব উপাদানের বিষয়ে আমাদের কোনো গবেষণা নেই, তবে এসব উপাদান থাকলে সেটা অবশ্যই মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার বিষয়টিও আমাদের জানা নেই। বিষয়টি এখন জানলাম, এ বিষয়ে কী করা যায় সেটা আলোচনা করে পদক্ষেপ নিবো।"
প্রসঙ্গত, বেগুন এ দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় সবজি; এ দেশের মানুষের খাদ্যতালিকায় সারা বছরই বেগুনের তরকারি থাকে (জনপ্রতি দিনে ৭.২৮ গ্রাম)। প্রাপ্তবয়স্ক একজন ব্যক্তির দৈনিক চাহিদার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভিটামিন, খনিজ এবং ফেনোলিক যৌগ সরবরাহ করে বেগুন।
যদিও দেশে এবং বিদেশে অনেক গবেষণায় এসেছে যে, আলু, বেগুন, কচু, আমলকি, মুলা, ঢেঁড়শ এবং ফুলকপির মতো সবজিতে ধাতব পদার্থ জমার ঝুঁকি রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, গ্রীষ্মকাল (মোট সবজি উৎপাদনের ৯.৬%) এবং শীতকাল (মোট সবজি উৎপাদনের ৪.৭%) উভয় মৌসুমেই বাংলাদেশে চাষ করা সবজিগুলোর মধ্যে বেগুন দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সবজি।
জামালপুর বাংলাদেশের শীর্ষ বেগুন উৎপাদনকারী জেলার একটি, যা দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৮.৫ শতাংশ উৎপাদন করে; আর ইসলামপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি পরিমাণে (মোট উৎপাদনের ৬০.৪ শতাংশ) বেগুন উৎপাদিত হয়।