স্থূলতার সঙ্গে যেভাবে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, অর্থনৈতিক চাপ
পরিবর্তিত খাদ্যাভাস ও দৈনন্দিন কাজকর্মে শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়ায় গত ১৪ বছরে দেশে স্থূলতার প্রবণতা নারীদের মধ্যে তিন গুণ এবং পুরুষদের মধ্যে দেড় গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুসারে, উদ্বেগজনকহারে স্থূলতা বৃদ্ধির কারণে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়েবেটিস ও বিভিন্ন ক্যান্সারের মতো অসংক্রামক রোগব্যাধির ঝুঁকি বাড়ছে।
'আন্ডারওয়েট, ওভার-ওয়েট অর অবিসিটি, ডায়াবেটিস অ্যান্ড হাইপারটেনশন ইন বাংলাদেশ, ২০১৪ টু ২০১৮'- শীর্ষক এই গবেষণা অনুসারে, স্থূলতার ফলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় যেমন বাড়ছে তেমনই কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া, মৃত্যুহার, স্থায়ী অক্ষমতার কারণে ব্যক্তি ও পরিবারের ওপর বড় ধরনের অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাসের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দেন এবং তাদের স্বাস্থ্যকর ও সক্রিয় জীবনধারায় উত্সাহিত করেন।
পাবলিক লাইব্রেরি অফ সায়েন্স চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর প্লস ওয়ান জার্নালে পিয়ার-রিভিউড গবেষণাটি প্রকাশ করে। গবেষণায় বলা হয়েছে ২০০৪ সাল থেকে থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে নারীদের মধ্যে স্থূলতা ১৭ শতাংশ থেকে ৪৯ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে স্থূলতা ২১ শতাংশ থেকে ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে, উচ্চ রক্তচাপ মহিলাদের মধ্যে ৩১ শতাংশ থেকে ৪৪ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ১৯ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
এছাড়া ধীরে ধীরে ডায়াবেটিস বাড়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে ডায়াবেটিস এক শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টার, হ্যানয় ইউনিভার্সিটি অফ পাবলিক হেলথ, ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যারোলিনার আর্নল্ড স্কুল অফ পাবলিক হেলথ এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর একদল গবেষক এ গবেষণা করেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আলিয়া নাহিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, স্থূলতার হার বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগজনক। শস্য ও শস্যজাতীয় খাবারের পরির্তে চর্বি, চিনি, তেল ও প্রাণীজ খাবার খাওয়ার প্রবণতা বাড়ায় স্থূলতা বাড়ছে। স্থূল মানুষের সংখ্যা বাড়ায় উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অপেক্ষাকৃত বিত্তবান পরিবারগুলোতে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগী বেশি বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
স্থূলতার অর্থনৈতিক চাপ
স্থূলতা ব্যক্তি, পরিবার ও জাতির উপর একটি বড় অর্থনৈতিক বোঝা চাপিয়ে দেয়। ২০১৪ সালে, 'ইকোনমিক বারডেন অব অবিসিটি: আ সিস্টেমেটিক লিটারেচার রিভিউ' শীর্ষক পেপারে বিশ্বজুড়ে জিডিপিতে স্থূলতার অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়।
স্থূলতার কারণে বাংলাদেশকে কী পরিমাণ লোকসান গুনতে হচ্ছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ২০২০ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় বলা হয়, ২০১০ সালে বাংলাদেশে স্থূলতার কারণে ক্ষতির পরিমাণ ৩৮ থেকে ১৪৭ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ছিল।
এটি ২০১০ সালে বাংলাদেশের জিডিপির শূন্য থেকে ১৩ শতাংশ এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে মোট ব্যয়ের তিন থেকে ৬৯ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ নির্দেশ করে। সেনসিটিভিটি অ্যানালাইসিস অনুসারে মোট ক্ষতি সর্বনিম্ন ৭১ মিলিয়ন থেকে সর্বোচ্চ ৩৩৪ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর দুই-তৃতীয়াংশ বা আনুমানিক সাড়ে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ কার্ডিও-ভাসকুলার রোগ, ডায়াবেটিস, সিওপিডি, ক্যান্সার ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মতো বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কারণে মারা যায়।
স্থূলতার হার নিয়ন্ত্রণে কী করা উচিত
ডা. আলিয়া নাহিদ বলেন, 'অসংক্রামক রোগের চিকিৎসার ব্যয় অনেক বেশি যা আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তাই আমাদের পর্যাপ্ত প্রতিরোধ ও প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্তকরণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে'।
স্বাস্থ্যকর জীবনধারা উৎসাহিত করতে বিভিন্ন প্রচারাভিযান চালু করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। 'আমাদের বাড়িতে এবং স্কুলে শিশুদের কীভাবে তারা ফিট থাকতে পারে তা শেখাতে হবে,' বলেন তিনি।
নগরায়নের ফলে স্থূলতা ও পরবর্তীতে অসংক্রামক বিভিন্ন রোগ বাড়ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
একইসঙ্গে একটি দূষণমুক্ত, পর্যাপ্ত খোলা জায়গাসহ স্বাস্থ্যকর নগরেরও প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান ডা. আলিয়া।
তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত যারা অ-সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের স্বাস্থ্যকর ও সক্রিয় জীবনধারার আওতায় আনার জন্য কর্মসূচি চালু করা।
সরকারি উদ্যোগ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনডিসি শাখার লাইন ডিরেক্টর প্রফেসর মো. রোবেদ আমিন টিবিএসকে বলেন, অসংক্রামক রোগ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন তারা।
তিনি বলেন, ৫৪টি উপজেলার উচ্চ রক্তচাপের প্রায় এক লাখ রোগীকে বিনামূল্যে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়াও উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো এনডিসি আগতদের চিকিৎসা দিচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসা সেবা আরও সম্প্রসারিত করার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
স্বাস্থ্য সচিব ডা. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, বর্তমানে ৭০ শতাংশ রোগী অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তাই মৃত্যুহার কমাতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
স্থূলতা নিয়ে চিন্তিত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যও
স্থূলতা এখন যুক্তরাজ্যে মহামারির রূপ নিতে চলেছে বলে মন্তব্য করেছেন অবিসিটি বিশেষজ্ঞ ডা. চিন্নাদোরাই রাজেশ্বরন।
হেলথ বিজনেসের মতে, যুক্তরাজ্যে স্থূলতার প্রকোপ গত ২৫ বছরে দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। অনুমান করা হচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যের প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ শতাংশ স্থূলতার শিকার হবে।
চলতি বছরের মে মাসে ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে-র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৪০ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৪২ মিলিয়নেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক স্থূল হয়ে পড়বে এবং তাদের মধ্যে ১৩ ধরনের ক্যান্সারের যেকোনোটি হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে।
পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড স্থূলতার ঝুঁকি কমাতে নতুন একটি কর্মপরিকল্পনা চালু করেছে। এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যকর ও সক্রিয় জীবনযাপনে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন প্রচারাভিযান। বাইরে খাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অ্যাপ বা অনলাইন নির্দেশিকার মাধ্যমে সাহায্য করা ইত্যাদি।
এদিকে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত ২৮ সেপ্টেম্বর স্থূলতা এড়ানো ও ক্ষুধামুক্তির লক্ষ্যে ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে জাতীয় সম্মেলন ও প্রচারাভিযানের আয়োজন করে।
দেশটিতে বাড়তে থাকার স্থূলতাজনিত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে এই উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ৭৩ শতাংশের বেশি আমেরিকান বাড়তি ওজন বা স্থূলতায় ভুগছে।