মা-বাবা’র স্মৃতিভ্রংশ: আপনি যখন তাদের পিতা-মাতা হয়ে যান!
ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগে ব্যক্তির স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে পারেন না, তার মধ্যে বিহ্বলতা সৃষ্টি হয়, এবং বারবার মানসিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম বিবিসি এক লেখায় মা-বাবা'র স্মৃতিভ্রংশে সন্তানদের ওপর কী প্রভাব পড়ে তা তুলে ধরেছে।
স্মৃতিভ্রংশ হলে ব্যক্তি পরিচিত প্রিয়মুখগুলোকে সহজেই ভুলে যান। প্রতিদিনের সহজ কাজগুলোও তার কাছে জটিল ধাঁধার মতো মনে হয়।
পরিবারের কারও স্মৃতিভ্রংশ হলে ব্যক্তি একা ভোগেন না, ওই পরিবারের সদস্যদেরও একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একটি গবেষণায়তো স্মৃতিভ্রংশ রোগীর পরিবারের সদস্যদের 'অদৃশ্য দ্বিতীয় রোগী' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আর স্মৃতিভ্রংশ রোগী যদি আপনার মা বা বাবা হন, তাহলে পারিবারিক জীবনের অনেক হিসাবনিকাশই উলট-পালট হয়ে যায়।
আমার জীবন এরকম এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল ২০১৯ সালের ক্রিসমাসের দিন। সেদিন খাবার টেবিলে পরিবারের সবাই উপস্থিত ছিল। চিরায়ত ক্রিসমাস ডিনার, স্বামী-সন্তান, আর বাবা; সবকিছু আগের মতোই ছিল। কেবল বাসার বদলে আমরা ক্রিসমাস পালন করেছিলাম লন্ডনের উত্তরে অবস্থিত লিস্টার হাসপাতালে।
ওই হাসপাতালে তার ২৪ ঘণ্টা আগে আমার ৮৭ বছর বয়সী বাবাকে অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি করা হয়। হঠাৎ করে তিনি বিহ্বল হয়ে পড়েন, বমির সমস্যাও দেখা যায়। পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর জানা গেল অতিরিক্ত পেইনকিলার খাওয়ার কারণে তার এ সমস্যা হয়েছিল। আমাকে অবাক করে দিয়ে ডাক্তার প্রশ্ন করলেন, 'আপনার বাবা কতদিন ধরে স্মৃতিভ্রংশ রোগে ভুগছেন?'
'আমি যদ্দূর জানি, উনার ডিমেনশিয়া নেই,' আমি উত্তর দিলাম।
বিশ্বে প্রায় পাঁচ কোটি ৭০ লাখ মানুষ স্মৃতিভ্রংশে ভোগেন। ২০৫০ সালে এ সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে ১৫ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। স্মৃতিভ্রংশ রোগে পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি ভোগেন। আর এটিকে রোগ হিসেবে মনে করা হলেও এটি আদতে কোনো রোগ নয়।
মানুষের মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করা কিছু প্রগ্রেসিভ কন্ডিশনের সাধারণ নাম হচ্ছে স্মৃতিভ্রংশ। বিভিন্ন কারণে মস্তিষ্কে এ ধরনের পরিবর্তনগুলো ঘটে থাকে। স্মৃতিভ্রংশের প্রায় ২০০টি ধরন আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কয়েকটি হচ্ছে আলঝেইমার রোগ, ভাসকুলার ডিমেনশিয়া, লিউই বডি ডিমেনশিয়া, ফ্রন্টোটেম্পোরাল ডিমেনশিয়া, ও মিক্সড ডিমেনশিয়া।
স্মৃতিভ্রংশের প্রাথমকি লক্ষণটি হলো আক্রান্ত ব্যক্তির স্মৃতিনাশ। ব্রেইন ড্যামেজেন কারণে এটি হয়। কারণ আমাদের মস্তুিষ্কের কোষগুলো ঠিকমতো কাজ করা বন্ধ করে দিলে তা আমাদের চিন্তা, স্মৃতি ও যোগাযোগের ক্ষমতাকে আক্রান্ত করে।
কারও একবার স্মৃতিভ্রংশ দেখা দিলে ডাক্তারদের আর তখন কিছু করার থাকে না। ঔষধ খেলে লক্ষণগুলো স্রেফ সাময়িকভাবে দূরে থাকে। তাই এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা। সবচেয়ে ভালো হলো, স্মৃতিভ্রংশে আক্রান্ত না হওয়ার জন্য আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া।
আমার বাবার পেইনকিলার ওভারডোজের কারণ বুঝতে পারলাম। তিনি ঔষধ খাওয়ার পর ভুলে যেতেন। এভাবে অতিরিক্ত পেইনকিলার খেয়ে ফেলেন। তার ব্যাগ থেকে এর প্রমাণও পাওয়া গেল। প্রায় ১০টির বেশি খালি পেইনকিলারের প্যাকেট খুঁজে পেলাম ব্যাগে।
বেশি বয়সে স্মৃতিভ্রংশ হলে পরিবারের সদস্যরা মনে করেন সেগুলো বুঝি বয়সের ফল। এর ফলে তারা ভুলে যাওয়া, অমনোযোগ ইত্যাদি বিষয়কে আমলে নেন না। আমার বাবার ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে, তিনি স্থানীয় দোকানে থেকে বেরিয়ে বাসায় ফেরার সময় পথ হারিয়ে ঘণ্টা তিনেক পরে ঘরে ফিরেছিলেন। কিন্তু সেটাকে তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, আমরাও ও নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাইনি।
স্মৃতিভ্রংশের এ ধরনের প্রাথমকি লক্ষণগুলো এড়িয়ে যাওয়া একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সালের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, স্মৃতিভ্রংশের পরীক্ষা না করার হার বিশ্বব্যাপী ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ কেবল ৩৮ শতাংশ স্মৃতিভ্রংশ রোগের চিকিৎসা হয় বিশ্বে। উন্নত দেশের তুলনায় দরিদ্র দেশগুলোতে স্মৃতিভ্রংশের পরীক্ষা ও চিকিৎসার হার আরও কম।
ব্যক্তি স্মৃতিভ্রংশে আক্রান্ত হলে তার পরিবার সেটাকে স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা করেন যাকে 'বাবল অভ নর্মালাইজেশন' বলা হয়। এক্ষেত্রে তারা এ সমস্যায় ভোগা তাদের প্রিয়জনের ভিন্ন আচরণগুলোকে মেনে নেন। কারণ তারা মনে করেন এগুলোর প্রতি বিরুদ্ধাচারণ করলে তা ব্যক্তিকে মানসিক বেদনা দেবে।
তবে বিভিন্ন প্রমাণ বলছে, স্মৃতিভ্রংশের ক্ষেত্রে আগে থেকে পরীক্ষানিরীক্ষা করাটাই শ্রেয়তর ব্যবস্থা। এর ফলে পরিবার আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে রাখতে পারেন। তাদের শারীরিক ও মানসিক যত্ন কীভাবে নেবেন, আর্থিক বিষয় ইত্যাদি নিয়ে হুট করে পরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না।
আমার বাবার ক্ষেত্রেও অনেকগুলো সতর্কতামূলক চিহ্ন প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি প্রায়ই মনে করতেন তার কোনো আত্মীয় তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছে। তাকে ব্যাংকের হিসাব দেখানো, এমনকি ব্যাংকে নিয়ে যাওয়ার পরও তিনি বিশ্বাস করেননি। তার মনে হতো ইস্ত্রি বুঝি লাইনে লাগানো আছে, গ্যাসের চুলা বুঝি বন্ধ করা হয়নি।
একদিন ট্রেনে চড়ে তার আমাদের বাড়ি আসার কথা ছিল। পথে রেললাইনে গন্ডগোল হওয়ার কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। বাবা শেষ পর্যন্ত নিজের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। কিন্তু তাকে যখন আমি ফোন করি, তখন তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন এ বলে যে আমাদের বাড়িতে তার সময়টা খুব ভালো কেটেছে।
সেদিনই আমি একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। কিন্তু তাও নিজেকে বোঝাতে লাগলাম, এটা মারাত্মক কিছু নয়। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমি ছিলাম সবার বড়। তাই বাবার দায়িত্বটা নিজের ওপরই নিয়ে নিলাম। নিয়মিত তার খোঁজখবর নেওয়া, তাকে তার কাজগুলো করার কথা মনে করিয়ে দেওয়া ইত্যাদি আমার নিত্যকার রুটিন হয়ে গেল।
অনেকগুলো গবেষণায় দেখা গেছে, পারিবারিক সম্পর্ক স্মৃতিভ্রংশের রোগীদের যত্নআত্তিতে প্রভাব রাখে। দীর্ঘদিন ধরে চেনা কারওর আচরণ বদলে যেতে দেখলে সেটা নিজের ওপরই চাপে পরিণত হয়। কিন্তু ওই পরিবর্তিত আচরণের পেছনের কারণগুলো বুঝতে পারলে ওই ব্যক্তি কীভাবে যোগাযোগ করতে চাচ্ছেন বা তার কী প্রয়োজন সেটা জানা যায়।
পেইনকিলার ওভারডোজের পর আমি বাবার পুরোনো ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি জানান, ২০১৭ সালে বাবার আলঝেইমার ধরা পড়েছিল। কিন্তু তিনি এত বছর খবরটা আমাদের কাছ থেকে গোপন রেখেছিলেন।
কিন্তু আমরা সেটা আর তার সঙ্গে কখনো আলোচনা করিনি। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, স্মৃতিভ্রংশ পরীক্ষা নিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করলে সেটা গ্রহণ করা তার জন্য কঠিন হতে পারে। সৌভাগ্যবশত, আইনি বিষয়গুলো দেখভাল করার ক্ষমতা বাবা আমাকে আগেই দিয়েছিলেন। এরপর ক্রমেই আমি তার অভিভাবক আর তিনি আমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন।
এভাবে ধীরে ধীরে আমি আমার বাবা'র মায়ের চরিত্রে প্রবেশ করলাম।
বাবা আমাকে সবসময় অনুরোধ করেছিলেন তাকে যেন কোনো কেয়ার হোমে না পাঠাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সে অনুরোধ আমি রক্ষা করতে পারিনি। সেটা ভাবলে এখনো আমি কষ্টে ভেঙে পড়ি।
২০২০ সালের মার্চে তাকে কেয়ার হোমে নেওয়া হয়। সেখানে কেবল দু'সপ্তাহে থাকার কথা হলেও করোনাভাইরাস মহামারি ও লকডাউনের কারণে বাবাকে ছয় মাস থাকতে হয়। ২০০ মাইল গাড়ি চালিয়ে তাকে দেখতে গেলে সময় পেতাম মাত্র আধাঘণ্টা। তাও আমাদের মাঝখানে কাচের দেওয়ালের বাধা থাকত।
স্মৃতিভ্রংশ রোগীদের জন্য সামাজিক বিচ্ছিন্নতা একটি রিস্ক ফ্যাক্টর। কারণ মানুষের সামাজিকভাবে সক্রিয় থাকা, একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা তার মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও সামাজিক দক্ষতার জন্য উপকারী।
চীনে পরিচালিত নতুন একটি পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণায় ঘরের কাজকর্ম করা, ব্যায়াম, ও সামাজিক ভ্রমণের সঙ্গে স্মৃতিভ্রংশের ঝুঁকি কমে যাওয়ার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে। এছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন স্মৃতিভ্রংশ তৈরির ঝুঁকি কমিয়ে দেয় বলেও ধারণা করা হয়।
আমার বাবা এ সময় পর্যন্ত আমাকে চিনতে পারেন। যদিও চিন্তাভাবনার সূত্র ঠিক রাখতে তাকে এখনি অনেক বেগ পেতে হয়।
কিন্তু আমি জানি, একদিন বাবার চোখে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন মানুষ হয়ে যাব।
বিবিসি থেকে সংক্ষেপে অনূদিত