পারমাণবিক বিস্ফোরণ হলে লুকিয়ে বাঁচার উপায় নেই, বিস্ফোরণের পরে আসবে আরও অনেক ধাক্কা
ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য কিংডম অব দ্য ক্রিস্টাল স্কাল সিনেমায় ইন্ডিয়ানা জোন্সকে একটি রেফ্রিজারেটরের ভেতরে প্রবেশ করে পারমাণবিক বিস্ফোরণের শকওয়েভ থেকে বেঁচে ফিরতে দেখা যায়।
বলা বাহুল্য, আর যা-ই হোক, ফ্রিজে আশ্রয় নিয়ে পারমাণবিক বিস্ফোরণ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। ফ্রিজের চেয়ে শক্তিশালী কোনো বস্তুর কথা চিন্তা করছেন? তা-তেও লাভ নেই।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, এরকম কিছু ঘটলে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে। দ্য বুলেটিন অভ অ্যাটোমিক সায়েন্টিস্টস নামক একটি মার্কিন বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিনে পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়া হয়েছে।
যদি ভেবে থাকেন, সুদূর আমেরিকা বা ইউরোপে পারমাণবিক যুদ্ধ হলে তার আঁচ কি আর আমাদের এখানে এতদূরে পৌঁছাবে, তাহলে আপনি একটু ভুল করছেন। আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, পারমাণবিক বিস্ফোরণের হাত থেকে আপনার রক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশ অল্পই বলা চলে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক হামলা হলে ঘরের দরজা বন্ধ করে গণমাধ্যম ও সরকারি ঘোষণার দিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে। কিন্তু যাদের শহরে বা দেশে পারমাণবিক বোমা এসে পড়বে, তাদের আর তখন কোনো ঘরেরই অস্তিত্ব থাকবে না।
এমনকি ছোটখাটো পারমাণবিক যুদ্ধেও অনেকগুলো বড় বড় বিস্ফোরণ ঘটবে বিশ্বব্যাপী। তাই বিস্ফোরণের কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে আপনি যদি প্রথম 'ধাক্কাটা' কোনোভাবে সামলেও নেন, তারপরও বিস্ফোরণ-পরবর্তী বিভিন্ন প্রভাবে খুব শীঘ্রই আপনার পুরো জীবন ধ্বংসের মুখেই পড়বে।
কেবল একটি পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রভাব
যেকোনো পারমাণবিক বিস্ফোরণে তেজস্ক্রিয়তা, প্রচণ্ড তাপ, ও বিস্ফোরণ প্রভাব সৃষ্টি হয়, যার ফলে মুহূর্তের মধ্যে অসংখ্য প্রাণ ঝরে যায়।
তেজস্ক্রিয়তা
বিস্ফোরণের অব্যবহিত পরে যে তেজস্ক্রিয়তা শুরু হয়, প্রাথমিকভাবে তার প্রভাব সবচেয়ে বেশি হয়। গামা রশ্মি ও নিউট্রনরূপে এ তেজস্ক্রিয়তা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।
এক সেকেন্ডেরও কম সময় এ তেজস্ক্রিয়তা টিকে থাকে। কিন্তু চারদিকে কয়েক মাইল পর্যন্ত এর প্রাণঘাতী মাত্রা ছড়িয়ে পড়তে পারে।
পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার মাইক্রোসেকেন্ডের মধ্যে এর শক্তি রঞ্জন রশ্মি হিসেব নির্গত হয়। এটি পরিবেশের সংস্পর্শে এসে বিশাল অগ্নিগোলক সৃষ্টি করে। ওই অগ্নিগোলকের ভেতরে তাপমাত্রা ও চাপ এত বেশি থাকে যে, সব বস্তু প্লাজমা অবস্থায় রূপান্তরিত হয়ে যায়।
৩০০ কিলোটন ক্ষমতার একটি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটলে বিস্ফোরণস্থল (গ্রাউন্ড জিরো) থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ফার্স্ট-ডিগ্রি পোড়ার সম্মুখীন হয় মানুষ ও অন্য প্রাণী।
ব্লাস্ট ওয়েভ
পারমাণবিক বোমা'র বিস্ফোরণ শক্তির অর্ধেক থাকে ব্লাস্ট ওয়েভ বা শকওয়েভে। প্রথমে শব্দের গতির চেয়ে দ্রুত ছুটলেও ধীরে ধীরে ব্লাস্ট ওয়েভের দ্রুতি কমে যায়।
বিস্ফোরণের ফলে তীব্র তাপের কারণে অগ্নিগোলকের চারপাশের বাতাস দ্রুতবেগে চারদিকে ছড়িয়ে যায়। এর ফলে সৃষ্ট শকওয়েভের ধ্বংসক্ষমতাও হয় মারাত্মক।
তেজস্ক্রিয় বিপর্যয়
সরাসরি তেজস্ক্রিয়তা, তাপ, ও বিস্ফোরণের মাধ্যমে বেশিরভাগ শক্তি ছড়িয়ে দেয় পারমাণবিক বিস্ফোরণ। এরপর অগ্নিগোলক ঠাণ্ডা হতে থাকে ও আকাশের দিকে উঠতে শুরু করে।
তারপর তৈরি হয় পারমাণবিক বিস্ফোরণের পরিচিত মাশরুমের মেঘ। এর ভেতরে থাকা তেজস্ক্রিয়া উপাদানগুলো পরিবেশে পড়তে থাকে।
বিস্ফোরণের পর মানুষ কী ব্যবস্থা নেয়, তার ওপর নির্ভর করে তেজস্ক্রিয় বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতি। সাধারণত, তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা কমার জন্য পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর ৪৮ ঘণ্টা ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেয় কর্তৃপক্ষ।
৩০০ কিলোটন ক্ষমতার একটি পারমাণবিক অস্ত্র হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বিস্ফোরিত হওয়া বোমার চেয়ে ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী। নিউ ইয়র্ক শহরে এ ধরনের একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটলে প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ১০ লাখের বেশি মানুষ নিহত ও তার দ্বিগুণেরও বেশি মানুষ মারাত্মক আহত হবে।
পারমাণবিক যুদ্ধ
বৈশ্বিক পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হলে মিনিটের ব্যবধানে কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটবে সারা বিশ্বে।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধে দুই দেশের বিভিন্ন শহরে ১০০টি ১৫ কিলোটন ক্ষমতার পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হলে সরাসরি নিহত হবে দুই কোটি ৭০ লাখ মানুষ।
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ১০০ কিলোটন ক্ষমতাসম্পন্ন চার হাজারের বেশি পারমাণবিক অস্ত্রের বৈশ্বিক যুদ্ধে বাধলে মুহূর্তের মধ্যে ৩৬ কোটি মানুষ মারা যাবে।
যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, ইসরায়েল, ভারত, পাকিস্তান, ও উত্তর কোরিয়ার কাছে সবমিলিয়ে আনুমানিক প্রায় ১,২০০-এর বেশি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
পারমাণবিক যুদ্ধের দীর্ঘকালীন প্রভাব
পারমাণবিক যুদ্ধে তাৎক্ষণিক মৃত্যুর পরে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে। সারাবিশ্বেই খুব দ্রুত বিস্ফোরণ-পরবর্তী সংকট দেখা যাবে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, দীর্ঘকালীন তেজস্ক্রিয়তা, সামাজিক অরাজকতা; কয়েক দশক ধরে এসবে ডুবে থাকবে বিশ্ব।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন
১৯৮০'র দশক থেকেই বিজ্ঞানীরা পরিবেশের ওপর পারমাণবিক বিস্ফোরণের দীর্ঘকালীন ও বিস্তৃত প্রভাব বিষয়ে জানতে গবেষণা শুরু করেন।
মার্কিন বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের তথ্যমতে, পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর সৃষ্ট বিশালাকার দাবানল থেকে উৎপন্ন ধোঁয়ায় বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক শীতকাল বিরাজ করতে পারে।
রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রায় পরিবর্তন হওয়ার ফলে বিশ্বব্যাপী কৃষি ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।
এছাড়া পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হলে অনেক শহর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এসব অগ্নিকাণ্ড থেকে সৃষ্ট কালি, ঝুল, কার্বন কণা, ধোঁয়া ইত্যাদিতে পূর্ণ হয়ে যাবে বৈশ্বিক বায়ুমণ্ডল।
পরিবেশগত পরিবর্তন
বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগ কার্বন কণায় ভর্তি হয়ে গেলে তা সেখানে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর অবস্থান করতে পারে। ফলে পৃথিবীতে সরাসরি সূর্যালোক পৌঁছাতে পারবে না এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে যাবে।
কিন্তু বিপরীতে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওজোন স্তর।
ভূমিতে পরিবর্তন
ওজোন স্তর ক্ষয়ে গেলে মাটিতে অতিবেগুনী রশ্মি সরাসরি এসে পড়বে। আবার পরিবেশের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে নেমে গেলে সমুদ্রে বরফের পরিমাণ বেড়ে যাবে, তুষারপাতের পরিমাণও বেশি ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। ফলে ব্যাহত হবে খাদ্য উৎপাদন।
সামুদ্রিক পরিবর্তন
বৈশ্বিকভাবে সমুদ্রের তাপমাত্রা কমে যাবে। এরপর বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন কণা সরে গেলে ও তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা কমে গেলেও যুদ্ধপূর্ববর্তী তাপমাত্রায় পৌঁছাতে অনেক বেশি সময় লাগবে সমুদ্রগুলোর।
সহসা সমুদ্রের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের। আর তার সরাসরি প্রভাব পড়বে বৈশ্বিক খাদ্য চেইনে।
বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ
বায়ুমণ্ডল, ভূপৃষ্ঠ, ও সমুদ্রে ভয়ানক পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দেবে। আর তা বৈশ্বিক মাত্রায় কয়েক দশক ধরে বজায় থাকবে।
আবার যেটুকু খাবার উৎপাদন করা সম্ভব হবে, তা তেজস্ক্রিয়তার দ্বারা দূষিত হতে পারে। কোনো দেশ যদি দয়াপরবশ হয়ে অন্য দেশকে নিজেদের খাদ্যভাণ্ডার থেকে সহায়তা করতেও চায়, তাহলেও সমুদ্রে বরফের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তা পরিবহন করা কষ্টসাধ্য হবে।
বড় মাপের পারমাণবিক যুদ্ধের পর যারা বেঁচে থাকবেন, তাদের অনেকেই বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটায় দুর্ভিক্ষের কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হবেন। এ সংখ্যা লাখ থেকে শুরু করে কয়েকশ কোটিতেও পৌঁছাতে পারে।