দুই মুক্তিযোদ্ধার নামে ‘সিতারা’র কাজ দিয়ে শামারুহ যেভাবে অস্ট্রেলিয়ান অভ দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ডে মনোনীত হলেন
বহুভাষী সম্প্রদায়ের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে দেশে-বিদেশে গত পাঁচ বছর ধরে বাড়িয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশি ড. শামারুহ মির্জা। অস্ট্রেলিয়ায় তৈরি করেছেন 'সিতারা'স স্টোরি' নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সিতারা শব্দের আভিধানিক অর্থ নক্ষত্র কিংবা তারা। তাই তারাদের মনের গল্প শোনার কাজ করে সিতারা'স স্টোরি।
সিতারা'স স্টোরির সিতারা শব্দের নামকরণের ইতিহাসও বেশ চমকপ্রদ। শামারুহ মির্জা 'সিতারা' শব্দটির নামকরণ করেছেন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত দুজন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম ও তারামন বিবির নামানুসারে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের মেয়ে ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী শামারুহ মির্জা তার এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মনোনীত হয়েছেন ২০২৩ সালের অস্ট্রেলিয়ান অভ দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ডের জন্য। ৪১ বছর বয়সি শামারুহ মনোনীত হয়েছেন 'এসিটি লোকাল হিরো' ক্যাটাগরিতে।
ব্যক্তিগত জীবনে শামারুহ মির্জা এক কন্যাসন্তানের জননী। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী তার মেয়ে। শামারুহর স্বামী ফাহাম আব্দুস সালাম অস্ট্রেলিয়া সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত।
আজ (২৭ অক্টোবর) সকালেই পুরস্কারের জন্য অস্ট্রেলিয়ান অভ দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হওয়ার খবর পান এই বাংলাদেশি চিকিৎসক। এই মনোনয়ন প্রাপ্তি উপলক্ষে ক্যানবেরার নিজ বাসায় বসে অনলাইনে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন শামারুহ।
প্রশ্ন: কেমন করে শুরু হলো?
ড. শামারুহ মির্জা: আমি মূলত একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী। অস্ট্রেলিয়ার সরকারের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট হিসেবে কর্মরত আছি। সেখানে ফুলটাইম হিসেবে কাজ করি।
পাঁচ বছর আগে আমি 'সিতারা'স স্টোরি' গঠন করি। বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের স্কুল-কলেজগুলোতে সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চা, শিক্ষকদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কিছুই নেই। তাই আমরা বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান 'ইনোভেশন ফর ওয়েলবিং ফাউন্ডেশন', তাদের সঙ্গে পার্টনারশিপে গ্রামের স্কুলগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কাজ করছি, ওয়ার্কশপ করাচ্ছি। ক্যানবেরায় শুরু করেছি গত তিন-চার বছর ধরে। ক্যানবেরায় ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে যেসব মহিলা-বাচ্চারা আসে, তাদের নিয়ে আমরা কাজ করছি। তাই এই স্বীকৃতি পাওয়ায় ভালো লাগছে অনেক।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের কাজটা কীভাবে সমন্বয় করেন?
শামারুহ: মনিরা রহমানকে নিশ্চয়ই চেনেন। এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের কথাও জানেন? নব্বই দশকের প্রথমদিকে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের অগ্রদূত বা প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মনিরা রহমানের এখন একটা প্রতিষ্ঠান আছে, যার নাম 'ইনোভেশন ফর ওয়েলবিং ফাউন্ডেশন'। আমরা এদের সঙ্গে অংশীদারিত্বেই গ্রামে গিয়ে কাজ করছি। আমাদের পক্ষে তো শারীরিকভাবে সবসময় গ্রামে গিয়ে কাজ করা সম্ভব না, কারণ আমি ক্যানবেরাতে আছি। আমরা যেটা করি—এখানে তহবিল সংগ্রহ করি; অস্ট্রেলিয়ান যারা আছে তারা আমাদের ফান্ড দেয়। সেই ফান্ডটা আমরা ট্রান্সফার করি মনিরা আপার 'ইনোভেশন ফর ওয়েলবিং ফাউন্ডেশন'কে। তারা আমাদের প্রজেক্টগুলো বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশের গ্রামে, বিভিন্ন স্কুলে।
এ বছর আমরা যে প্রকল্পটি শুরু করেছি, তার জন্য ফান্ড পাওয়া গেছে। আর এই প্রকল্পটি আমার হৃদয়ের খুব কাছের। এটা হচ্ছে, বাংলাদেশে যেসব সেক্সওয়ার্কাররা আছেন, তাদের বাচ্চারা তো খুব একটা সুস্থ পরিবেশে বড় হয় না। তাই তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এ বছর কাজ শুরু করেছি। তাদেরকে আমরা ওয়ার্কশপ করাচ্ছি, 'মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড'—বিশ্বস্বীকৃত একটি প্রোগ্রাম—এর আওতায় কাজ হচ্ছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে কাজের শুরুটা কবে?
শামারুহ: ২০১৮ সালে বাংলাদেশে কাজ শুরু করি আমি। ২০১৭ সালে আমরা সিতারা'স স্টোরি গঠন করি, আর এখানেও ২০১৮ সাল থেকেই কাজ শুরু করি। তারপর আমরা বিভিন্ন গ্রাম, মফস্বল শহরের মোট ২০-২৫টি সুবিধাবঞ্চিত স্কুলের বাচ্চাদের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে প্রশিক্ষণ করিয়েছি। তাদের এন্টি-বুলিং, হ্যারাসমেন্টের বিরুদ্ধে যাতে তারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে পারে, এই প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তাছাড়া তাদের মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড কিট এই প্রোগ্রামের অধীনে এনেছি। শুধু বাচ্চারাই নয়, আমরা তাদের অভিভাবক এবং শিক্ষকদেরও ওয়ার্কশপের অধীনে এনেছি।
এটা আমাদের নিয়মিত কাজ, এর বাইরেও আমরা আরো দু-তিনটে ছোটখাটো কাজ করেছি। ২০২১-এ করোনার জন্য নির্বাচিত সরকারি হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্যকর্মীদের অবস্থা তো খুবই খারাপ ছিল। সেখানকার নার্স, ডাক্তারদের নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের ওয়ার্কশপ করেছি।
প্রশ্ন: ক্যানবেরায় কোন ধরনের কাজ করছে সিতারা?
শামারুহ: ক্যানবেরায় কাজ হচ্ছে গত চার বছর ধরে। এখানে ককেশিয়ান বাদেও প্রচুর মানুষ আছে যারা বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে এসেছে, তাদের সাথেও প্রায় একই ধরনের ওয়ার্কশপ আমরা করি। আমরা যারা বাইরে থেকে আসি, তারা বেশিরভাগই শিক্ষিত ও পেশাদার। কিন্তু সংস্কৃতিগত কারণেই বলুন বা ধর্মীয় কারণেই বলুন বা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কারণেই বলুন, আমাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে স্টিগমা রয়েছে। আমাদের আসলেই যদি কোনো মানসিক সমস্যা হয়ে থাকে, তা নিয়ে আমরা কথা বলতে চাই না। আমরা যেটা করি, পাগল বলে উড়িয়ে দেই। এটা করতে গিয়ে ক্যানবেরায় দেখেছি যে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে আসা একজন আত্মহত্যা করেছে। এটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বুঝলাম, আমাদের মধ্যে এখনো প্রচুর স্টিগমা কাজ করে।
প্রশ্ন: একজন আত্মহত্যা করেছেন বললেন, এমন ঘটনা কি আরো আছে?
শামারুহ: এ বিষয়ে গোপনীয়তার স্বার্থে বিস্তারিত বলতে পারছি না। তবে একটা ছোট উদাহরণ দেই, যেটা পত্রিকায় এসেছে। দু-বছর আগে মেলবোর্নে ছয় মাসের ব্যবধানে প্রায় ৭ থেকে ৮ জন ভারতীয় আত্মহত্যা করেছেন। সেটার কারণ যখন অনুসন্ধান করা হয়, তখন দেখা গেছে যোগাযোগগত বাধা থেকে শুরু করে গার্হস্থ্য ও পারিবারিক হিংস্রতাসহ অনেক কারণ ছিল এর পেছনে। তখন অস্ট্রেলিয়ান সরকার চিন্তা করল—কেন তারা এই কাজটি করল, কেন তারা সাহায্য নিল না? পরে দেখা গেল, তাদের সংস্কৃতিগত বাধা, যোগাযোগের বাধা, ইংরেজিতে কথা বলা, তাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভীতি—এগুলোর কারণে তারা কোনোরকম সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করে না। এ কারণে সিতারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নারীদের জন্য একটা স্থান তৈরি করেছে; যেখানে তারা আসছে এবং তারা যা চায় তা-ই বলতে পারে। এখানে কোনো ভাষাগত বাধা নেই; একইসাথে আমরা বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা তৈরির প্রশিক্ষণও দিচ্ছি। ধরুন, ইংরেজি ভাষা শিখতে সাহায্য করা, তারপর কীভাবে চাকরির জন্য রেজুমে লিখতে হয়, কীভাবে চাকরির জন্য আবেদন করতে হয়, কথা বলার দক্ষতা বাড়ানো, যোগাযোগে দক্ষতা—এগুলো নিয়ে আমরা ট্রেনিং দিচ্ছি।
প্রশ্ন: এই পুরস্কার কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
শামারুহ: গুরুত্বপূর্ণ। খবরটা পাওয়ার পরপরই বাবাকে ফোন করে জানিয়েছি। ২৬ জানুয়ারি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান ডে। সেদিন পুরো অস্ট্রেলিয়ায় 'অস্ট্রেলিয়ান অভ দ্য ডে' ঘোষণা করা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় যারা পেশাগতভাবে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন, নিজ নিজ সম্প্রদায়ে তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করছেন এবং প্রভাব ফেলতে পারছেন, তাদেরকে নির্বাচন করা হয় এর জন্য। এই মনোনয়নটিতে প্রত্যেক স্টেট থেকে তারা কয়েকজনকে মনোনীত করে। উদাহরণস্বরূপ, একটা স্টেটে ধরুন সাত লাখ লোক আছে, যেখানে ১০০ জন এ ধরনের কাজ করেন। সেখান থেকে তারা ৪ জনকে মনোনীত করে। আমি সেই চারজনের মধ্যে একজন।
প্রশ্ন: আশা করি, চূড়ান্তও হয়ে যাবেন।
শামারুহ: এই মনোনয়নটি আমাদের জন্য অনেক বড় স্বীকৃতি। আমাদের কাজ যে সম্প্রদায়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে এটা তারই স্বীকৃতি। এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার আমার কাছে।