যে কারণে ৩০ বিলিয়ন ডলারের সৌদি বিনিয়োগের তেমন অগ্রগতি নেই
বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ আগ্রহী হলেও গত ছয়-সাত বছরে সৌদি আরবের অনেক প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন খাতে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিলেও তা বাস্তবে কখনো আলোর মুখ দেখেনি।
কেবল সুনামগঞ্জের ছাতকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে একটি সিমেন্টের কারখানা স্থাপনের প্রকল্পে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমানে এ প্রকল্পের দরপত্র মূল্যায়নের কাজ চলছে।
তবে এ প্রকল্প নিয়েও এখনও অনিশ্চয়তা কাটেনি। কারণ সৌদি বিনিয়োগের মাধ্যমে কারখানা স্থাপনের পরও উৎপাদনে যেতে না পারার অনেক উদাহরণ রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিনিয়োগ প্রস্তাব কার্যকর করার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাগুলো ও সংশ্লিষ্ট সৌদি কোম্পানি একমত্যে না পৌঁছাতে পারা ও বাংলাদেশি আমলাদের পক্ষ থেকে সহযোগিতার অভাবে এ প্রস্তাবগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে।
কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই সরকারি সংস্থাগুলো ঘনঘন প্রকল্পবিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সময়ক্ষেপন করার কারণে সৌদি বিনিয়োগের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সহ আরও কিছু সরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা এসব কথার সত্যতা স্বীকার করেছেন।
বিডা'র নির্বাহী সদস্য মোহসিনা ইয়াসমিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সৌদি বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো সরকারি সংস্থা ও সৌদি আরবের কোম্পানিগুলোর মধ্যকার যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব। এগুলো কার্যকর হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়।'
সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মশি উল্লেখ করেন, ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগের আগ্রহ বেড়েছে।
'এ সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার সৌদি আরব সফর করে সে দেশের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। সৌদি আরবের অনেক বড়-বড় কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই হয়। কিন্ত সরকারি সংস্থাগুলোর অসহযোগিতার কারণে কোনো বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তব রূপ পাচ্ছেনা,' তিনি বলেন।
ইতোমধ্যে অনেক সৌদি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়েছে বলেও জানান সাবেক এ রাষ্ট্রদূত।
এ পরিস্থিতিতে আগামী ৩০-৩১ অক্টোবর রিয়াদে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ-সৌদি আরব যৌথ কমিশনের (জেসি) ১৪তম বৈঠক।
এ বৈঠকে বাংলাদেশ দুই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন করার জন্য সৌদি আরবকে অনুরোধ করবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
এর আগে দুই দেশের মধ্যকার জেসি বৈঠক ২০২০ সালের ১২-১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
সৌদি'র বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রস্তাবের কী হয়েছে?
২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর সৌদি আরবের অন্যতম বৃহৎ পাওয়ার কোম্পানি এসিডব্লিউএ পাওয়ার ৩,৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণের জন্য বাংলাদেশে ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।
কোম্পানিটি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)-এর সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাস/আর-এলএনজিভিত্তিক একটি কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একটি সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) স্বাক্ষর করে।
কিন্তু প্রাকৃতিক গ্যাসের ঘাটতির কারণে, বাংলাদেশ চেয়েছিল সৌর বা বায়ুচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে।
পরে সৌদি কোম্পানিটি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বিনিয়োগ করতে রাজি হয়। এটি বরিশালের চরাঞ্চলে এ কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দেয়।
কিন্তু প্রস্তাবিত এলাকায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন না থাকায় এই প্রস্তাবে পিডিবি আপত্তি জানায়। একই সঙ্গে পিডিবি বাগেরহাটের রামপালে একটি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য এসিডব্লিউএ পাওয়ারকে প্রস্তাব দেয়।
কিন্ত সৌদি কোম্পানিটির কাছ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ নাজমুল আবেদিন বলেন, ওই সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করার তিন বছর হয়ে গেছে, কিন্তু উভয় পক্ষের ধীরগতির কারণে এখনো প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বিডা'র সূত্রে জানা গেছে, একই কারণে আরেক সৌদি কোম্পানি আলফানার বাংলাদেশে একটি ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, তিন বছর আগে ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশনস (ইডি) নামক একটি সৌদি কোম্পানি চট্টগ্রামে তাদের নিজস্ব জায়গায় জেনারেল ইলেকট্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড (গেমকো) নামক একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ উৎপাদন কারখানা স্থাপন করলেও এখনো উৎপাদনে যেতে পারেনি।
ইডি-কে ডিপিএম (ডিরেক্ট প্রকিউরম্যান্ট মেথড) সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়। এ সুবিধার আওতায় কোম্পানিটি তাদের কারখানায় উৎপাদিন পণ্য দরপত্রে অংশগ্রহণ করা ছাড়াই সরাসরি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে বিক্রি করতে পারবে।
কিন্তু পরে ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশনস আলাদা কোম্পানি গঠন করে নিজেই উৎপাদনে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে শিল্প মন্ত্রণালয় এটিকে ডিপিএম সুবিধা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
যদিও চুক্তি অনুযায়ী গেমকো'র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ইডি'র একটি ট্রান্সফর্মার ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উৎপাদনকারী কারখানা স্থাপনের কথা ছিল বলে জানিয়েছেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এখন ইডি-কে নতুন একটি চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে মন্ত্রণালয়। সৌদি প্রতিষ্ঠানটি এ খাতে ৩৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পরে এ বিনিয়োগ ৮০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার কথা ছিল।
সার কারখানারও অগ্রগতি নেই
এছাড়া একটি ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) কারখানা স্থাপনের জন্য একটি বিনিয়োগ প্রস্তাবেরও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
হানওয়াহ সৌদি আরব লিমিটেড ৭০০-৯০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে মরক্কো বা সৌদি আরবে একটি ডিএপি কারখানা স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে।
ডিএপি উৎপাদনের ৯০ শতাংশ কাঁচামাল ও জ্বালানি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় বলে সৌদির কোম্পানিটি বাংলাদেশে কারখানা করতে চায় না।
অন্যদিকে বিসিআইসি চায় এই কারখানাটি বাংলাদেশেই হোক। ফলে এই বিনিয়োগ প্রস্তাবের অগ্রগতি হয়নি।
আগ্রহ হারিয়েছে সৌদি আরামকোও
এদিকে সৌদি কোম্পানি আরামকো পেট্রোকেমিক্যাল, ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন ও এলএনজি টার্মিনালসহ বিভিন্ন খাতে প্রায় ১৫-২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ কোম্পানিটিকে ধরে রাখতে পারেনি। যদিও কোম্পানির কর্মকর্তারা তিনবার বাংলাদেশ সফর করে গেছেন।
সৌদি প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উন্নয়নে ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় বে কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণে ১.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী চলতি মাসের শুরুতে সৌদি আরব সফরকালে রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে সৌদি কোম্পানিটি ফের বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়।
এছাড়া নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল, আল-জোমাইহ গ্রুপের গাইবান্ধা ও দিনাজপুরে ৩০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাবও দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে।
একমাত্র ব্যতিক্রম
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিলম্বিত হওয়ার পর অবশেষে সুনামগঞ্জের ছাতকে সৌদি-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগের অধীনে একটি ক্লিঙ্কার-সিমেন্ট কারখানা স্থাপনের প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে।
বর্তমানে কারাখানায় ৬০% অংশীদারিত্বের মালিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট। বাকি ৪০% বিসিআইসির মালিকানায় বিনিয়োগের পরিমাণ ৬০০ মিলিয়ন ডলার করা হয়েছে।
২০২০-এর ৩০ জুন বিসিআইসি সৌদি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে প্রতিদিন ১৫ হাজার টন ক্লিংকার-সিমেন্টের উৎপাদনক্ষমতার একটি কারখানা স্থাপনের জন্য একটি যৌথ উদ্যোগ চুক্তিতে প্রবেশ করে।
সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চললে বর্তমান সরকারি ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির পাশে ১৬০ একরের বেশি জমিতে সিমেন্ট উৎপাদন ইউনিট তৈরি করা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
বিসিআইসির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেছেন, এ বিষয়ে ২০২১ সালের জুন মাসে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছিল এবং এখন দরপত্র মূল্যায়নের কাজ চলছে।
প্রকল্পটি বাংলাদেশের ক্লিংকারভিত্তিক সিমেন্ট কারখানার চাহিদা পূরণ করবে এবং বার্ষিক ১৯ মিলিয়ন টন আমদানির বিপরীতে বছরে চার মিলিয়ন টন ক্লিংকার সরবরাহ করবে। পাশাপাশি এটি বার্ষিক ২২৫ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করবে।
২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের সময় সুনামগঞ্জের ছাতকে একটি সিমেন্ট ও ক্লিংকার তৈরির কারখানা স্থাপনের জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
বর্তমানে সৌদি আরব পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ)-এর সম্পদ রয়েছে ৬০০ বিলিয়ন ডলার। দেশটি বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগের জন্য এই তহবিল গঠন করেছে।
২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরের সময় পিআইএফ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে।