সালসা, কিজোম্বা, বাচাতা- ল্যাটিন আমেরিকান নাচের ফিউশন এখন ঢাকায়!
রাজধানীর গুলশান-১ এর 'সাউন্ড অব মিউজিক' স্টুডিওতে গিয়ে দেখা গেলো বিশাল এক আয়নাঘেরা দেয়াল ঘরে চলছে নাচের অনুশীলন। এই স্টুডিও'র অন্য কক্ষগুলোতে আবার চলে মিউজিকের নানা ইন্সট্রুমেন্টের চর্চা। কেউ শিখছে পিয়ানো, কেউ আবার বাজাচ্ছে গিটার। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে ঘুরে সময় যখন সন্ধ্যা ৭টা ছুঁই ছুঁই, তখন এক এক করে শিক্ষার্থীরা এসে হাজির হোন নাচ করার জন্যে।
বলছি 'হাভানা সালসা'র কথা। ২০১৮ সাল থেকে ঢাকায় এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ল্যাটিন আমেরিকান নাচের চর্চা করছেন এর স্বত্বাধিকারী আবদুল করিম সিরাজী, যিনি একেএস নামেই বেশি পরিচিত।
নতুন শিক্ষার্থীদের নাচের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ট্রেইনার একেএস শেখাচ্ছিলেন 'ওয়েট ট্রান্সফার' এর খুঁটিনাটি। কীভাবে এক পা থেকে অন্য পায়ে সম্পূর্ণ দেহের ভর দিতে হয়, নাচের এই স্টেপে তাই শেখানো হয়। সাউন্ড বক্সে কিজোম্বা নাচের জন্যে বহুল ব্যবহৃত ফ্রেঞ্চ গান 'Soha mil pasos' বাজতে শুরু করলে- গানের তালে শিক্ষার্থীরা একে অপরের হাত ধরে একত্রিত হয়ে নাচ শুরু করে দেয়।
বাংলাদেশে ল্যাটিন আমেরিকান নাচের চর্চা
"আমার ছোট থেকে বড় হওয়া দুবাইতে। সেখানে থাকাকালীন মিউজিকের ওপর দীর্ঘকালের চর্চা ও অভিজ্ঞতা হয়েছিল। পেশাগত জায়গা থেকে আমি একজন ডিজে ছিলাম। তাই বিভিন্ন ইভেন্ট ও শো এর আয়োজন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। পাশাপাশি শখের জায়গা থেকে সালসা নাচ অনুশীলন করতাম। ২০১৭ সালে ঢাকায় ফিরে এসে দেখলাম-এখানে সালসার মতো সামাজিক নাচের আয়োজন হয় না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ কেউ এই নাচ করে থাকলেও তা ছোট পরিসরে ঘরোয়াভাবে আয়োজন করা হতো। সেখান থেকে চিন্তা করলাম বড় পরিসরে সালসা নাচের আয়োজন করবো। ২০১৯ সালে ঢাকায় প্রথমবার সকলের জন্য উন্মুক্ত সালসা নাচের আয়োজন করি। ঢাকার হোটেল সেরিনায় আয়োজিত এই সালসায় অংশ নিতে অনেক আগ্রহী তরুণ-তরুণী হাজির হয়েছিল। প্রথমবার এতো বেশি সাড়া পাওয়ার পর, এটা নিয়ে সামনে এগোনোর আগ্রহ আরও বেড়ে যায়", 'হাভানা সালসা' প্রতিষ্ঠার পেছনের গল্প জানাচ্ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠানটির একমাত্র প্রশিক্ষক একেএস।
২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বর আয়োজিত সালসা নাচের প্রোগামটি ঢাকার মধ্যে প্রথম কোনো বলডান্সের আয়োজন বলা চলে। 'বলরুম ডান্স' বা বল নাচের কথাটি শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে রাজকীয় পরিবেশে তরুণ-তরুণীদের একত্রিত হয়ে একে অপরের হাত ধরে ধীরগতিতে দুলে নাচ করার দৃশ্য। ইউরোপ-আমেরিকায় কয়েকযুগ আগে থেকে এই নাচের চর্চা হয়ে আসছে। সেসময় সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকেরা বলরুম নাচের আয়োজন করতো। এরকম আয়োজনে যোগ দিতে উৎসুক তরুণ-তরুণীরা নিজেদের আকর্ষণীয় পোশাকে সাজিয়ে তুলতো। মেয়েরা পরতো লম্বা গাউন জামা এবং ছেলেদের পরনে থাকতো স্যুট বুট ও নেক টাই। সময়ের সাথে নাচের পোশাকে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এখনো বাইরের দেশগুলোতে সামাজিক ও পারিবারিক উৎসবে বলরুম নাচ বেশ ঘটা করেই আয়োজন করা হয়।
যাইহোক, এরপর থেকে একেএস প্রতিমাসে একটি করে সালসা নাচের প্রোগ্রাম আয়োজন করতে শুরু করেন-যেটিকে আয়োজকরা 'সালসা নাইট' বলে অভিহিত করে। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে সন্ধ্যায় আগ্রহীরা একত্রিত হোন সালসা নাচ পারফর্ম করার জন্য। কিন্তু করোনার ধাক্কা সব পন্ড করে দেয়। লকডাউনে অনেক লোক একত্রিত হয়ে নাচার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তাই আগ্রহীরা নিজেদের মধ্যে নাচ অনুশীলন শুরু করেন। সেখান থেকেই নাচের ক্লাস চালু করার সিদ্ধান্ত নেন ট্রেইনার একেএস। এ পর্যন্ত প্রায় ৩০টি 'সালসা নাইট' অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে 'হাভানা সালসা'।
'সালসা নাইটের' আবহ অনেকটা পার্টির মতো। বেশিরভাগই অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকার নামীদামী হোটেল ও কফি হাউজগুলোতে। জনপ্রতি রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ নির্ধারণ করা হয় ৫০০-১০০০ টাকা। স্থানভেদে নির্ধারিত ফি কিছুটা হেরফের হতে পারে। প্রতিটি 'সালসা নাইটে' ৪০-৮০ জন অংশগ্রহণ করেন। অংশগ্রহণকারীদের সকলে একে অপরের পূর্বপরিচিত। 'মিউচুয়াল বন্ধু'র বাইরে এখানে অংশগ্রহণ করার সুযোগ রাখেন না আয়োজকরা। এর কারণটা অবশ্য একেএস নিজেই জানালেন। তিনি বলেন, "ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থেকে নয়, শখ ও প্যাশনের জায়গা থেকেই 'হাভানা সালসা' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই মার্কেটিং এর প্রচার-প্রচারণায় আমরা আগ্রহী কম ছিলাম। আমাদের সালসা নাইটে যারা অংশগ্রহণ করেন এদেরকে রেফারেন্স এর ভিত্তিতে আসতে হয়। আগ্রহী সকলের জন্যে উন্মুক্ত বলা চলে, তবু নিরাপত্তার বিষয় ও অন্যদের কমফোর্ট এর কথা মাথায় রেখে কারও পরিচিত নয়- এমন কোন ব্যক্তিদের তালিকায় রাখা হয় না। বেশিরভাগ 'সালসা নাইটের' আয়োজন ও স্থান আমরা নিজেরা ঠিক করে থাকি। তবে কিছু কিছু রেস্টুরেন্ট থেকে আমাদের নিমন্ত্রণ করা হয়, তাদের ওখানে এরকম নাচের আয়োজন করার জন্যে।"
ল্যাটিন আমেরিকান নাচের আরও ২টি ধরন হচ্ছে 'কিজোম্বা' ও 'বাচাতা'। 'হাভানা সালসা' প্রথমে সালসা নাচ দিয়ে শুরু হলেও; ২০২০ সালে বাচাতা নতুন করে যুক্ত করা হয়। পাশাপাশি চালু করা হয় 'কিজোম্বা' নাচ।
হাভানার কোর্সসমূহ
'হাভানা সালসায়' সপ্তাহে ৩ দিন ল্যাটিন আমেরিকান ফিউশন নাচের ক্লাস চলে। শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১ ঘণ্টা চলে 'কিজোম্বা' অনুশীলন। প্রথমদিকে একদম নতুন শিক্ষার্থীদের নাচের ক্লাস নেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় ইম্প্রুভার শিক্ষার্থীদের ক্লাস। ২ মাসে মোট ৮টি ক্লাস নেওয়া হয়। তারিখ অনুযায়ী পূর্বেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, কোনদিন ক্লাসে নাচের কী কী স্টেপ শেখানো হবে। তাই শুরুর দিকে কেউ ক্লাস মিস করলে; পরবর্তী ব্যাচের সাথে তা পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
একইভাবে সপ্তাহের শনিবার 'সালসা' ও রবিবার 'বাচাতা' নাচের ক্লাস চলে। ২ মাসব্যাপী কোর্স ক্লাসের নির্ধারিত ফি শুরু হয় ৩৫০০ টাকা থেকে। বর্তমানে 'হাভানা সালসায়' ৩০ জন নিয়মিত শিক্ষার্থী নাচ শিখছেন। যাদের বেশিরভাগ ১৮ থেকে ৩৫ বয়সী। তবে ৪০-৫০ বয়সী কয়েকজন আছেন, যারা শখ থেকে এই বয়সে নাচ শিখতে আগ্রহী হয়ে ভর্তি হয়েছেন।
শিফতী বিনতে কবীর ইডেন মহিলা কলেজের স্নাতক শিক্ষার্থী। প্রায় ১ বছর ধরে তিনি 'হাভানা সালসায়' নাচ শিখছেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি 'সালসা নাইট' অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছেন। তার ভাষ্যমতে, "শুরুতে সালসা শিখেছি। এরপর কিজোম্বা ও বাচাতা চালু করা হলে ভর্তি হয়ে যাই। দীর্ঘদিন 'সালসা' প্র্যাকটিস করলেও-নাচের ফর্মগুলোর মধ্যে সালসা নাচের স্টেপগুলো তুলনামূলক কঠিন। এদিক থেকে বাচাতা নাচ সহজ। আর কিজোম্বা অন্যগুলোর তুলনায় একটু এডভান্স লেভেলের নাচ।"
নতুন কিছু করা
একেএস-এর 'হাভানা সালসা' বাংলাদেশের নাচের জগতে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। এইবছর যমুনা ফিউচার পার্কে 'হাভানা সালসা' দেশে প্রথমবারের মতো ল্যাটিন আমেরিকান নাচ উৎসবের আয়োজন করে। জমকালো এই নাচের উৎসবে ৩০০ এর অধিক লোক উপস্থিত হয়েছিল। যেখানে দর্শনার্থীদের টিকেটের সাথে ফ্রি ক্লাস করার সুযোগ দেওয়া হয়।
একেএস জানান, "নাচ শিখতে আসা শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক ক্লাসগুলোতে পর্যবেক্ষণ করা হয়। অনেকের শারীরিক গঠন নাচের জন্য ফ্লেক্সিবল থাকে না। তাই এক্ষেত্রে অনেকে দ্রুত শিখতে পারেন, কারও আবার দীর্ঘদিন অনুশীলন প্রয়োজন পড়ে।"
"গ্লোবাল ট্রেন্ড অনুযায়ী নাচের ধরন বাছাই করা হয়। সালসা বহুল জনপ্রিয় নাচ। বর্তমান সময়ে বাচাতা ও কিজোম্বা সামাজিক নাচ হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তাই হাভানা সালসায় এই নাচগুলো নতুন করে সংযুক্ত করা হয়েছে। আবার 'ট্যাঙ্গো' নাচ আমাদের দেশের ক্ষেত্রে তেমন উপযোগী নয়। ভবিষ্যতে গ্লোবাল ট্রেন্ড অনুযায়ী জনপ্রিয় অন্যান্য নাচ হাভানা সালসায় শেখানো হবে। কিন্তু তা হয়তো আরও ৪/৫ বছর পরে সম্ভব হবে। এখন ল্যাটিন আমেরিকান নাচের এই ৩টি ফর্ম নিয়েই এগোতে চাইছি।"
সম্প্রতি একেএস 'ইন্ডিয়া আফ্রো ল্যাটিন সেনসেশন'-এর বাংলাদেশের ব্র্যান্ড প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার ইচ্ছা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা হচ্ছে, 'হাভানা সালসা' কেবল দেশের মধ্যেই নয়, আন্তর্জাতিক নাচের উৎসবে অংশগ্রহণ ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।