প্রথমবারের মতো লোকসানের খাতায় নাম ওয়ালটনের
টাকার বিপরীতে ডলারের দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো লোকসানের মুখে পড়েছে দেশের ইলেকট্রনিক্স ও প্রযুক্তি জায়ান্ট ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ওয়ালটনের ৪৬ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে এবং ২৮০.৯৮ কোটি টাকা মুনাফা থেকে শেয়ার প্রতি আয় ১.৫২ টাকায় নেমে এসেছে; গত বছর একই সময়ে শেয়ার প্রতি আয় বৃদ্ধি পায় ৯.২৮ টাকা।
২০২১ সালের জুলাই মাসে ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪.৮২ টাকা। সেটা চলতি বছরের মে মাস থেকে অস্বাভাবিকহারে বাড়তে শুরু করে। মে মাসেই খোলা বাজারে ডলারের মূল্য ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর ব্যাংকে ডলারের মূল্য ১০০ টাকা অতিক্রম করে জুলাই মাসে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ডলারের মূল্য ২৭ শতাংশ বেড়েছে।
এর ফলে এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ওয়ালটনের খরচ সাত গুণ বেড়ে ৩২২.৪২ কোটি টাকা হয়। কোম্পানির একটি সূত্র মতে তাই অপারেটিং প্রফিট ২৭৫.৭২ কোটি টাকা সত্ত্বেও কোম্পানিটি লোকসানে পড়েছে।
অথচ এর আগের বছর একই সময়ে কোম্পানিটির অপারেটিং প্রফিট ছিল ৩২২.৫৮ কোটি টাকা এবং ফাইন্যান্স কস্ট ছিল ৩৬.৭৬ কোটি টাকা। ফলে কোম্পানিটি ২৮০.৯৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল।
ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও গোলাম মুর্শেদ বলেন, "ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এলসি সেটেলমেন্টের খরচ বেড়ে গেছে। আর এই বাড়তি খরচের কারণে ফাইন্যান্স কস্ট বেশি দেখানো হয়েছে। তাই ওয়ালটন এ প্রথম লোকসান করেছে।"
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, "কাঁচামাল আমদানির জন্য জুলাই-সেপ্টেম্বর কোয়ার্টারে প্রতিটি ডলার ৯৮ টাকা দরে আমরা এলসি করেছি। কিন্তু সেটেলমেন্টে ডলারের মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০২ টাকা। এই পার্থক্যের কারণে আমাদের খরচ বেড়েছে।"
তিনি বলেন, "এই খরচের বেশিরভাগই এখনো 'আন-রিয়েলাইজড'। তারপরও আমরা রিয়েলাইজড ধরে হিসাব করেছি। এতে আগামী কোয়ার্টারের হিসাবে কারেন্সি ভলাটিলিটির প্রভাব কম পড়বে।"
এদিকে কোম্পানিটির নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সিঙ্গার বাংলাদেশ জুলাই-সেপ্টেম্বর কোয়ার্টারে ৮.৫০ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
বর্তমানে বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ওয়ালটনের উৎপাদনও ব্যাহত হয়েছে; যা কোম্পানির ব্যবসায়িক খরচ আরো বাড়িয়েছে, জানান কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যমতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।
আর এই মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়েছে ওয়ালটনের পণ্য বিক্রিতে। চলতি হিসাব বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কোম্পানিটির রাজস্ব আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ শতাংশ কমেছে।
ওয়ালটনের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার হাওলাদার বলেন, "ইনফ্লেশনের কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তাই মানুষ এখন ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য কম কিনছে। আবার কাঁচামালের উচ্চমূল্য সত্ত্বেও আমরা পণ্যের মূল্য সে অনুযায়ী বাড়াতে পারছি না। ইনফ্লেশনের কারণে মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও ভুগছে।"
সিঙ্গার লোকসান করলেও এর বিক্রি কিন্তু বেড়েছে ১৩%।
এ বিষয়ে কোম্পানিটির এক সূত্র জানায়, কিস্তিতে পণ্য বিক্রির সুবিধা সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ায় কোম্পানিটির বিক্রিতে মূল্যস্ফীতির প্রভাব কম পড়েছে।
বাংলাদেশে ইলেক্ট্রনিক্স ও হোম অ্যাপ্লায়েন্সের মার্কেট ছিল আমদানি-নির্ভর। সেখানে ২০০৮ সালে ওয়ালটন দেশে তৈরি ইলেক্ট্রনিক্সের পণ্য নিয়ে বাজারে প্রবেশ করে।
'বাংলাদেশের পণ্য কিনুন, দেশের টাকা দেশেই রাখুন'-স্লোগান দিয়ে দ্রুতই প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নেয়।
বর্তমানে ৭২ শতাংশের বেশি মার্কেট শেয়ার নিয়ে রেফ্রিজারেটরের বাজারকে লিড দিচ্ছে ওয়ালটন।
পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি টেলিভিশন, এয়ার কন্ডিশন, সিলিং ফ্যান, এলইডি লাইট এবং হোম অ্যাপ্লায়েন্সে ভাল ব্যবসা করছে।
দেশের চাহিদা মিটিয়ে কোম্পানিটি ২০১১ সালে রেফ্রিজারেটর রপ্তানি শুরু করে। বর্তমানে ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশীয় দেশগুলো্তে ওয়ালটন রেফ্রিজারেটর, মোবাইল ফোন, কম্প্রেসার এবং টেলিভিশনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্য রপ্তানি করছে।