দুই দশকের শিরোপা খরা কাটবে ব্রাজিলের?
'ব্রাজিলে ফুটবলের চাষ হয়'- কোনো ব্রাজিলিয়ান নন, পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তের কোনো এক ফুটবলভক্ত যদি এমন দাবি করেন, দ্বিমতের সুযোগ আছে? নির্দ্বিধায় হয়তো বলে দেওয়া যায়, 'কোনো দ্বিমত নেই।' সাম্বার তালে তালে ব্রাজিলিয়ানরা যে ফুটবল উপহার দেন, তা অনেকের কাছেই তুলনাহীন, অপার্থিব। পেলে থেকে নেইমার; আদি, উন্নত ও শৈল্পিক ফুটবলের কারিগর তো তারাই!
রেকর্ডও সেলেসাওদের পক্ষে রায় দেয়, 'ফুটবলের 'কালো মানিক' পেলের দেশ ব্রাজিলই সেরা।' ১৯৫৮ সালে প্রথমবারের মতো ফুটবল মহাযজ্ঞে শেষ্ঠত্বের মুকুট জেতে ব্রাজিল। এরপর থেকে ব্রাজিলের ফুটবলের বিশ্ব শাসনের শুরু। ৫৮ বিশ্বকাপের পর আরও চারটি আসরে শিরোপা উচিয়ে ধরে লাতিন অঞ্চলের ফুটবল পাগল এই দেশটি।
ব্রাজিলের ট্রফি কেসে শোভা পায় পাঁচটি বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট। যা 'গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ' ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসের সর্বোচ্চ। কিন্তু সেই ব্রাজিলই দীর্ঘদিন ধরে তীর্থের কাকে মতো চেয়ে আছে আরেকবার সোনালী শিরোপাটি ছুঁয়ে দেখার আশায়। সর্বশেষ ২০০২ সালে শিরোপা ঘরে তুলেছে ব্রাজিল। এরপর আর শিরোপার দেখা নেই, দুই দশকে তাদের সেরা সাফল্য সেমি-ফাইনাল খেলা।
রোববার মাঠে গড়ানো কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিলের শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা কেমন? এবার তাদের ২০ বছরের অপেক্ষা ফুরোবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে ব্রাজিলের গায়ে ফেবারিটের তকমা সেটে দিয়েছেন ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য এবারের ব্রাজিলের দলটি নিয়ে আশা করতে ফুটবলবোদ্ধা হওয়ার দরকার নেই। নেইমার, ভিনিসিউস জুনিয়র, ফ্যাবিনহো, কাসেমিরো, ফ্রেড, রিচার্লিশন, গ্যাব্রিয়েল হেসুসদের নিয়ে তারকা ঠাসা দল ব্রাজিল। অনেকেই এবার ব্রাজিলের হাতে শিরোপা দেখতে পাচ্ছেন।
এক নজরে ব্রাজিলের বিশ্বকাপ রেকর্ড
বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ: ২১তম
শিরোপা: পাঁচটি
সেরা সাফল্য: চ্যাম্পিয়ন (১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৯৪ ও ২০০২)
বিশ্বকাপের ম্যাচ রেকর্ড: ১০৯ ম্যাচ; ৭৩ জয়, ১৮ ড্র ও ১৮ হার
বিশ্বকাপে গোল: ২২৯ (বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ)
সর্বোচ্চ জয়: ৭-১, প্রতিপক্ষ- সুইডেন (১৯৫০)
যার ওপর নজর থাকবে: নেইমার
ফিফা র্যাঙ্কিং: এক নম্বর
কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ম্যাচ
সার্বিয়া (২৪ নভেম্বর)
সুইজারল্যান্ড (২৮ নভেম্বর)
ক্যামেরুন (২ ডিসেম্বর)
ব্রাজিলের শেষ চার বিশ্বকাপ:
সর্বশেষ চার বিশ্বকাপে শিরোপার কাছাকাছি যেতে পারেনি ব্রাজিল। তবে আগেভাগেও বিদায় নেয়নি তারা। তিন আসরে কোয়ার্টার ফাইনাল ও একটিতে সেমি-ফাইনাল খেলে তারা। আর এই চার আসরের প্রতিবারই ইউরোপের কোনো দলের বিপক্ষে হেরে বিদায় নিতে হয়েছে তাদের। ২০০৬ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের বিপক্ষে, ২০১০ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে, ২০১৪ বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে এবং সর্বশেষ ২০১৮ বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের বিপক্ষে হার মানে পেলের দেশ।
গ্রুপ পর্বে এবারের প্রতিপক্ষ:
এবার গ্রুপ পর্বে দুই ইউরোপিয়ান দেশের সঙ্গে দেখা হচ্ছে ব্রাজিলের। ক্যামেরুন ছাড়া সার্বিয়া ও সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে লড়বেন নেইমাররা। এই দুই দলকে হাল্কা করে নেওয়ার সুযোগ নেই তাদের। কারণ চার বছর আগের বিশ্বকাপ নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা ব্রাজিলের। ২০১৮ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে এই দুই দলের বিপক্ষে লড়ে তারা। শেষ ম্যাচে সার্বিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে জিতলেও আগে সুইজল্যান্ডের বিপক্ষে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয় ব্রাজিলকে, মাঠ ছাড়তে হয় ১-১ গোলের ড্র নিয়ে। বাকি প্রতিপক্ষ ক্যামেরুনকেও নিয়ে অস্বস্তি না থাকলেও নির্ভার থাকার সুযোগ নেই।
এবারের আসরে ব্রাজিল দল:
বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে দুর্বার ছন্দে ছিল ব্রাজিল। কাতার বিশ্বকাপের টিকেট কাটার পথে অপরাজিত থাকা ব্রাজিল প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠায় ৪৫ বার, হজম করে মাত্র ৫টি। বাছাই পর্বে দারুণ সময় কাটানোর পরও অবশ্য তিতে ও তার দল জানে বিশ্বকাপের মতো মঞ্চটা আলাদা জায়গা, এখানে পুরনো হিসেব-নিকেশ চলে না। তবে সব মিলিয়ে ২০২২ সালের ব্রাজিল দলটাকে অন্যতম সেরা মনে করা হচ্ছে।
চলতি বছরে উয়েফা নেশন্স লিগ চালু হওয়ায় ইউরোপিয়ান দলগুলোর বিপক্ষে খেলার তেমন সুযোগই হয়নি তাদের। এরপরও আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর থেকে কাতার বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। এর অন্যতম কারণ এবারের বিশ্বকাপে ব্রাজিল নেইমার নির্ভর দল নয়। তরুণ প্রজন্মের খেলোয়াড়দের আগমনে নেইমারের কাধ থেকে প্রত্যাশা বোঝা অনেকটাই কমেছে।
গত এক দশকে নেইমারকে ঘিরেই আবর্তিত হতো ব্রাজিলের পরিকল্পনা। কিন্তু এবার ভিনিসিউস, রিচার্লিশন, হেসুস, পেদ্রো, অ্যান্টনি, রাফিনহাদের মতো ফুটবলারদের ওপর ভরসা রাখতে পারছে তারা। রিয়ালে নিজেকে অপ্রতিরোধ্য প্রমাণ করা ভিনিসিউস মূলত এবার ব্রাজিলের প্রাণভোমরা। এ ছাড়া ফরোয়ার্ড সংখ্যা ৯ জন হওয়ায় সার্বিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের আগে মধুর সমস্যাতেই পড়তে হয়েছে ব্রাজিলের কোচ তিতেকে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বকাপে পাঁচ আক্রমণভাগের খেলোয়াড় খেলানোর বিষয়ে প্রশ্ন ক রা হলে তিতে বলেন, 'আমি জানি না, প্রতিপক্ষে শক্তিমত্তা এবং এই দলটা কতোটা ভালো করে, সেটা বিবেচনায় এই ব্যাপারটি চূড়ান্ত করা হবে। মাঠ কথা হবে, আপনি যদি অ্যাথলেটদের দিকে তাকান, পাকিতা মিডফিল্ডার হলেও রক্ষণ করতে জানে। নেইমারের পেছনে থাকবে রিচার্লিশন, রাফিনহা অসাধরণ আর ভিনি প্রস্ফুটিত।'
সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স ও প্রত্যাশা
বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের মতো বাকি সব ম্যাচেও দাপট ছিল ব্রাজিলের। সব ম্যাচেই শাসন করে জয় তুলে নেয় দলটি। সর্বশেষ সাত ম্যাচের ছয়টিতেই বিশাল ব্যবধানের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ব্রাজিল। দারুণ ছন্দ তো আছেই, দলও তারকায় ঠাসা। তাই ব্রাজিলকে নিয়ে প্রত্যাশাও এবার আকাশছোঁয়া। দীর্ঘ অপেক্ষাও তাড়িয়ে ফিরছে তাদের। ১৯৫৮ বিশ্বকাপ জেতার পর বাকি চারটি বিশ্বকাপ জয়ের মাঝে এর চেয়ে কেবল একবারই বেশি সময় লেগেছে সেলেসাওদের। ১৯৭০ বিশ্বকাপ জেতার পর ২৪ বছর অপেক্ষা করতে হয় ব্রাজিলকে, চতুর্থ শিরোপার দেখা মেলে ১৯৯৪ সালে। এবার অপেক্ষাটা ২০ বছর হয়ে গেছে। উড়তে থাকা ব্রাজিলের কাছ থেকে এবার তাই ষষ্ঠ শিরোপার আশায় তাদের ভক্ত-সমর্থকরা।