ডিসেম্বর থেকে দ্বিগুণ মূল্যের ১,৪০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ পাবে পিডিবি
ডলার সংকট এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে মাসকয়েক ধরেই লোডশেডিং এর কবলে পড়ে বাংলাদেশ। এই প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) জানিয়েছে, আগামী ডিসেম্বর থেকেই ১,৪০০ মেগাওয়াট কয়লা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে।
গ্রিডে এই অতিরিক্ত বিদ্যুৎ আসবে- নবনির্মিত ১,৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার রামপাল এবং ভারতের আদানি গ্রুপের ১,৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার গোড্ডা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। প্রাথমিকভাবে দুটি কেন্দ্র থেকেই তাদের সক্ষমতার অর্ধেক সরবরাহ পাওয়া যাবে। এরমধ্যে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডা প্ল্যান্টে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আন্তঃসীমান্ত সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে আমদানি করা হবে।
তবে আগে যতোটা প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল, বিশ্ববাজারে কয়লার দাম বাড়ার কারণে– উভয় প্ল্যান্ট থেকেই বিদ্যুৎ কেনার খরচ তার চেয়ে অনেকটা বেশি হবে।
রামপাল থেকে প্রতি কিলোওয়ান্ট ঘণ্টা (বা এক ইউনিট) বিদ্যুৎ ক্রয়ের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৭.৭ টাকা, এখন লাগবে ১৪ টাকা। একইভাবে, প্রাথমিকভাবে ৮.৭১ টাকা প্রাক্কলন করা হলেও গোড্ডার বিদ্যুতের দাম পড়বে ১৫ টাকা।
বর্তমানে শুধু তেল-ভিত্তিক বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে ১৫ টাকা। ইতঃপূর্বে সরকার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং ব্যয় সাশ্রয়ে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঝোঁকে।
এদিকে অতিরিক্ত যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে- তা হবে গত গ্রীষ্মে পিক লোডশেডিংয়ের সমান। ওই সময়ে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের চড়া দামের পরিস্থিতিতে ডলার সাশ্রয়ে ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলি জানিয়েছে, গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চালু হওয়ার পর সরকার যদি সেখান থেকে বিদ্যুৎ নাও কেনে, তারপরও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ প্রতিমাসে ৩০০ কোটি টাকা দিতে হবে।
একইভাবে, পূর্ণ সক্ষমতার রামপাল কেন্দ্রের মাসিক ক্যাপাসিটি চার্জ হবে ২৫০ কোটি টাকা।
চুক্তি অনুসারে, ক্রয়ের জন্য লভ্য বিদ্যুতের নির্ধারিত অংশ কিনতে ব্যর্থ হলে– বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাস্বরূপ এই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়।
বিপিডিবির সূত্রগুলি জানায়, শীতে কম থাকার পর মার্চ নাগাদ বাড়তে থাকে বিদ্যুতের চাহিদা। তাই আগামী ডিসেম্বর থেকে রামপাল কেন্দ্র এবং আদানি গ্রুপের সরবরাহ পাওয়া গেলেও– মার্চের আগে কেন্দ্র দুটির পূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগানো যাবে না।
বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি প্রণয়ন (পলিসি ফর্মেশন) শাখার পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন বলেন, 'আগামী বছর দুটি প্ল্যান্ট থেকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে, ওই সময়ে গ্রীষ্ম মওসুম এবং কৃষিতে সেচ কাজের জন্য বাড়তি চাহিদাও থাকবে। ফলে কোনো নেতিবাচক প্রভাবের বদলে চাহিদা-সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় এই বিদ্যুতের ইতিবাচক প্রভাবই পড়বে'।
দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের সংগঠন (বিআইপিপিএ)-র সভাপতি ইমরান কবিরের মতে, সার্বিকভাবে ব্যয়-সাশ্রয়ের উপায় হবে- বৃহৎ কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্রের কমিশনিং।
তিনি বলেন, 'খোলাবাজারে (স্পট মার্কেটে) এলএনজির দাম যদি প্রতি এমএমবিটিইউ (১০ লাখ ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) ৩০ ডলারই থাকে– তাহলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় হবে ৩০ টাকা। সে তুলনায়, কয়লা ও ফার্নেস-অয়েল ভিত্তিক বিদ্যুতের দাম হবে মাত্র ১৪ টাকা। তাই সার্বিক বিচারে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ দেশের ব্যয় সাশ্রয় করবে'।
জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে চলতি বছর নানান ধরনের আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে পিডিবি। ফলে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর বকেয়াও পরিশোধ করতে পারেনি।
পিডিবির কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের বকেয়া পাওনা পাঁচ মাসের বিল বা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
তাই কয়লা-ভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটি পিডিবির ওপর আরও আর্থিক চাপ সৃষ্টি করবে কিনা- সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।
এপ্রসঙ্গে পিডিবির সদস্য (অর্থায়ন) এসকে আক্তার হোসেন বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমে আসা এবং অর্থ বিভাগ থেকে নিয়মিত ভর্তুকি ছাড়ের সুবাদে সংগঠনটি বর্তমানে তহবিল সংকটকে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখতে পারছে। তার মতে, 'কয়লা-ভিত্তিক কেন্দ্র চালু হলেও– সম্প্রতি বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের বিল পরিশোধের চাপ মোকাবিলায় জন্য আরেকটি বড় সমর্থন হিসেবে কাজ করবে'।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলা নিয়ে যখন বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব বাড়ছে– তারমধ্যে আলোচনা-সমালোচনার উত্তপ্ত একটি ইস্যু হয়ে উঠেছে কয়লা-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র।
গত এপ্রিলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে- গ্লোবাল এনার্জি মনিটর জানায়, ২০২১ সালে ১০.৪ গিগাওয়াট সক্ষমতার কয়লা-ভিত্তিক প্রকল্পগুলি বাদ দেওয়ার পরেও, চলমান প্রকল্পগুলি বাংলাদেশের ১.৮ গিগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় চারগুণ করবে।
গ্লোবাল এনার্জি মনিটরের বিশেষজ্ঞ ফ্লোরা চ্যাম্পেনোইস এসময় বলেছিলেন, 'বাংলাদেশে কয়লার উচ্চমূল্য ও নিশ্চিত ক্রয়চুক্তি গ্রাহক এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে'।
তিনি বলেন, 'কয়লা সহজ এবং সস্তা হওয়ার প্রতিশ্রুতি মিথ্যা, এবং কয়লার ওপর দেশটির নির্ভরতা অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে উঠছে'।
আদানি প্ল্যান্টের বিদ্যুতের ক্রয়মূল্য
অন্যান্য বেসরকারি কেন্দ্রের মতোই আদানির গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্টের বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হবে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দামের ওপর। তার সাথে স্থায়ী ব্যয় হিসেবে থাকবে ক্যাপাসিটি চার্জ।
নিউ ক্যাসল ইনডেক্স অনুসারে, বর্তমানে (প্রতিকেজিতে ৬৩২২ ক্যালরিফিক ভ্যালুর) উচ্চ মানের তাপ সৃষ্টিকারী কয়লার দাম টনপ্রতি ৩৫০ ডলার। এটি ব্যবহার করলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি-বাবদ ব্যয় হবে ১৭-১৮ টাকা।
তবে তুলনামূলক নিম্ন-মানের কয়লা ব্যবহার করা হবে গোড্ডা প্ল্যান্টে। পিডিবির সূত্রগুলো জানায়, এখানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় হবে ১২ টাকা।
অন্যদিকে, চুক্তি অনুসারে প্রতি ইউনিটের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ৩.২৬ টাকা দিতে হবে।
সবমিলিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে এক ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ দাঁড়াবে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টায় ১৫ টাকারও বেশি।
২০১৭ সালে করা চুক্তি অনুসারে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২৫ বছর ধরে ১,৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে আদানি পাওয়ার। তবে করোনা মহামারির কারণে, এই প্রকল্পের কাজ পেছানো হয় এবং ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে চালু করার সিদ্ধান্ত হয়।
সীমিত পরিসরে চালু হবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র
বিশ্ব ঐতিহ্য- সুন্দরবনের কাছে অবস্থিত হওয়ার কারণে বহুল সমালোচিত মৈত্রী সুপার ১৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে। পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করবে কেন্দ্রটি।
পিডিবির মুখপাত্র শামীম হাসান বলেন, 'টেস্ট রানের অংশ হিসেবে বর্তমানে আমরা রামপাল প্ল্যান্ট থেকে সীমিত পরিমাণে বিদ্যুৎ পাচ্ছি। এর প্রথম ইউনিটে আগামী মাসে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর সম্ভাবনা আছে'।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে, বাগেরহাটের রামপালে অবস্থিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ভারতীয় সমকক্ষ নরেন্দ্র মোদি।
পিডিবি এবং ভারতের জাতীয় তাপ-বিদ্যুৎ কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগ হিসেবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডে(বিআইএফপিসিএল)।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্ল্যান্টটির প্রথম ইউনিটে এবং ওই বছর আগস্টে দ্বিতীয় ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু, পরবর্তীতে এই তারিখ পিছিয়ে প্রথম ইউনিটের জন্য ২০২২ সালের মার্চ এবং দ্বিতীয় ইউনিটের জন্য জুলাই নির্ধারণ করা হয়।
এরপর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা আরও পিছিয়ে যথাক্রমে চলতি বছরের জুন ও নভেম্বরে করা হয়।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের ঘোষণার সময় এর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ করেন পরিবেশবাদীরা। তারা বলেছিলেন, এই কেন্দ্র শুধু সুন্দরবন নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।