দাম কমেছে বিশ্ববাজারে, তবু আমরা যুদ্ধকালীন দাম কেন দিচ্ছি?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে বিশ্ববাজারে প্রতিবুশেল (২৫ কেজি) গমের দাম ওঠে সর্বোচ্চ ১২.৯৪ মার্কিন ডলারে। এটি ছিল প্রায় ৫ ডলারের চেয়ে বেশি বাড়ার ঘটনা।
পৃথিবীর প্রায় সকল খাদ্যবাজার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে; যার প্রধান ভুক্তভোগী হয়- বাংলাদেশের মতো দেশের নিম্ন আয়ের ভোক্তারা।
আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দামে আগুন এখন নিভেছে অনেকটাই, দাম প্রতিবুশেল ৭.৮৬ ডলারে নামলেও–দেশের বাজারে প্রধান শস্যটির দামে তার প্রভাব পড়েনি। চলমান ডলার ও গ্যাস সংকট অত্যাবশ্যক এই পণ্যের দাম অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরেই রাখছে।
বিশ্ববাজারে দরপতন স্থানীয় বাজারের জন্য সহায়ক হয়নি
গত কয়েক মাসে প্রধান কয়েকটি খাদ্যপণ্যের আমদানি, বিশেষভাবে বলা যায় গম ও চিনির কথা–কমেছে অব্যাহতভাবে। অথচ ওই সময়ে বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য সূচকগুলো ছিল পড়তির দিকে, এতে করে দাম কমার এই সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বাংলাদেশের ভোক্তারা।
মাসিক আমদানি ৯০০ কোটি ডলারের মতো উচ্চতায় চলে যাওয়ায়–বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে চাপমুক্ত রাখতে– ওই সময়টা ছিল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু বিধিনিষেধ দেওয়ার সমসাময়িক। তখন রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় কমে আসায় রিজার্ভ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়।
এরপর অত্যাবশ্যক নয়– এমন পণ্যের আমদানি কমিয়ে রিজার্ভের ওপর চাপ সহনীয় করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও–ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্য আমদানির এলসি খোলা কমে আসে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান খাদ্য আমদানিকারকরা।
তথ্যউপাত্তে দেখা যাচ্ছে, এই বছরের মে-অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে গম আমদানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় অর্ধেক কমেছে। বাংলাদেশ ইউক্রেন থেকে নিজস্ব গম চাহিদার একটি বড় অংশ আমদানি করে। আর জুলাই মাসেই কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলি দিয়ে শস্য রপ্তানির সুযোগ পায় ইউক্রেন, কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগানো যায়নি। একই সময়ে চিনি আমদানিও কমে।
টান টান এই সরবরাহের প্রভাব পড়ে স্থানীয় বাজারে এবং ভোক্তা পর্যায়ে গম এবং চিনি- উভয়ের দামই ঊর্ধ্বমুখী হয়। এমনকি চিনির দাম কেজিতে ১০০ টাকার ঘর ছাড়িয়ে যায়।
আমদানি স্বাভাবিক করতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
চলতি সপ্তাহের গত রোববার সচিবদের সাথে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে আমদানি স্বাভাবিক করার দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতেও বলেছেন তিনি।
সরকারি মজুদ যাতে কোনভাবেই ১৫ লাখ টনের নিচে না নামে সে বিষয়েও সতর্ক করেছেন। একইসঙ্গে স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো, খোলাবাজারে বিক্রয় (ওএমএস) কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেন।
সচিব সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ খাদ্যপণ্যের আমদানি, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজার পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরেন।এই প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, চলতি বছরের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ মাসে চাল, গম, অপরিশোধিত-চিনি, পেঁয়াজ ও অপরিশোধিত পাম ওয়েলের আমদানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে কম হয়েছে।
এর তথ্যানুসারে, এই পাঁচ মাসে দেশে গম আমদানি হয়েছে ১৭.২০ লাখ টন, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে আমদানি হয় ৩৩.৭৪ লাখ টন। অর্থাৎ এই সময়ে প্রায় ১৬ লাখ টন সরবরাহ কমেছে স্থানীয় বাজারে এবং তার ফলে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি টিবিএসকে বলেন, 'বিশ্ববাজারে যেসব পণ্যের দাম পড়তির দিকে সেগুলোর সুফল আমরা পাচ্ছি না। এর প্রধান কারণ ডলারের উচ্চমূল্য। আবার গ্যাস সংকটের কারণে স্থানীয় উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে'।
ডলার সংকটে পণ্যের দাম বাড়তি
এপ্রসঙ্গে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার টিবিএসকে বলেন, 'ডলার সংকটের কারণে এখনও আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটার সমাধান না হলে, আমদানি স্বাভাবিক হবে না'।
মেঘনা গ্রুপ বছরে ৮-৯ লাখ টন গম আমদানি করে থাকে, কিন্তু এবছর তার অর্ধেকেরও কম আমদানি করেছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই- আন্তর্জাতিক বাজারে এই দুই বড় সরবরাহকারী দেশের গম রপ্তানি ব্যাহত হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম আমদানির পতনও স্থানীয় বাজারকে প্রভাবিত করছে। শুধু চাল ও গম নয়, এই পাঁচ মাসে (মে-অক্টোবর) প্রায় ৬৫ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি, ২১ হাজার টন পেঁয়াজ এবং সাড়ে চার হাজার টন অপরিশোধিত পাম অয়েল কম আমদানি হয়েছে।
তবে এই সময়ে দাম বেশি থাকা সত্ত্বেও অপরিশোধিত সয়াবিন, সয়াবিন বীজ এবং মশুর ডালের আমদানি বেড়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে প্রতিপাউন্ড সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে ০.৮২০ ডলার পর্যন্ত হয়, যা এখন নেমে এসেছে ০.৭৩৪ ডলারে। কিন্তু, দাম পতনের সুফল দেশের বাজারে নেই।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-র বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, এক কেজি খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৩ টাকায়, যা আগের বছরের এই সময়ে ছিল সর্বোচ্চ ৩৪-৩৮ টাকা। একইভাবে প্যাকেটজাত আটার দাম ৫৮.৮২ শতাংশ বেড়ে সর্বোচ্চ ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট না থাকলেও- প্যাকেটজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯০ টাকা, সরবরাহ সংকটের কারণে চিনি ১১০-১২০ টাকা এবং মানভেদে মশুর ডাল ১২০-১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
সারের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে চালের দামে, যেকারণে এবার আমন ধানের দাম মণপ্রতি ১,৩০০ টাকার উপরে। মোটা চাল ৫৫ টাকা এবং চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকারও বেশি দামে।
বেসরকারি খাতকে ১৫ লাখ টন আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও, প্রকৃত আমদানি হয়েছে ২.৬২ লাখ টন
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে চলতি অর্থবছরের ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ২.৬২ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। যদিও প্রায় তিন মাস আগে চাল আমদানির এসব অনুমতি দেওয়া হয়।
বাণিজ্য সচিবের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, মে-অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ মাসে চাল আমদানি হয়েছে ৩.০৫ লাখ টন, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯.০৮ লাখ টন।
আমদানি শুল্ক কমিয়ে সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও– চাল আমদানিকারকরা সরকার অনুমোদিত পরিমাণের এক-চতুর্থাংশেরও কম আমদানি করেছেন, এতে দেশের বাজারে প্রধান খাদ্যপণ্যটির দাম বেড়েছে।
এর আগে গত ৩০ অক্টোবর দেশের বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার ৪১৫টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ১৭ লাখ ২ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, এরমধ্যে মাত্র ৩.৮৬ লাখ টন আমদানি হয়েছে।
উৎস দেশগুলি রপ্তানি বন্ধ করেছে
টিকে গ্রুপের পরিচালক সাইফুল আতহার তাসলিম টিবিএসকে বলেন, ডলার সংকটের পাশাপাশি সোর্সিং কান্ট্রির নিষেধাজ্ঞাও এখানে কাজ করছে। যেমন ভারত থেকে আমরা প্রচুর গম আমদানি করতাম। এখন তারা গম রপ্তানি বন্ধ করে রেখেছে। এটাও একটা সমস্যা'।
তিনি বলেন, আমদানি বন্ধ থাকলেও এলসি খোলা যায়। কিন্তু, এলসি দায় নিষ্পতি না হলে তো আমদানি হয় না।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১৫ জুলাই থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ১৫.৬৫ লাখ টন গম আমদানির উদ্দেশ্যে এলসি খোলা হয়েছে।
এরমধ্যে অক্টোবরের শেষপর্যন্ত মাত্র ৬.৬১ লাখ টনের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ের আমদানি ছিল চার লাখ টনের কিছু বেশি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে প্রায় ১.৯৮ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। ভারত, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে ৫.৩০ লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি করেছে সরকার।
এসব প্রচেষ্টার ফলে সরকারের কাছে বর্তমানে ১৬.০৭ লাখ টন খাদ্যশসের মজুদ রয়েছে।