ভোক্তা পর্যায়ে রডের দাম কমানো সম্ভব: ট্যারিফ কমিশন
রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে ধারবাহিকভাবে কমতে থাকায় এবং ডলারের মূল্য স্থিতিশীল হওয়ার কারণে ভোক্তা পর্যায়ে নির্মাণ খাতের এ পণ্যটির দাম কমানো সম্ভব। এর জন্য আন্তর্জাতিক বাজার মনিটরিং করে স্থানীয় মূল্যের সমন্বয় করার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া এম এস রডের কাঁচামালের আমদানি, উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজার পরিস্থিতির উপর তৈরি করা এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন।
তবে বেসরকারি খাতের রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ডলার সংকটে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হওয়া, গ্যাসের সংকটে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, ডলারের বাড়তি দামসহ বিভিন্ন কারণে এখনো রডের দাম কমানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত জুন মাসে প্রতি মে. টন স্ক্র্যাপের গড় আমদানি মূল্য ছিল ৫৯০.৭৫ ইউএস ডলার। যেটা সেপ্টেম্বর মাসে কমে দাঁড়িয়েছে ৫২১.২৯ ডলারে। অর্থাৎ চার মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে গড় আমদানি মূল্য ১১.৫ শতাংশ কমেছে। এই দাম সমন্বয় করলে উৎপাদন ব্যয় ৭.৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব।
শুধু কাঁচামালই নয়, জুন মাসে আমদানি ব্যয় পরিশোধে ডলারপ্রতি বিনিময় হার ছিল ১০৮-১১২ টাকা, যা বর্তমানে ১০১-১০৫ টাকায় নেমে এসেছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে বর্তমানে এম এস রডের দাম কমানো সম্ভব।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্য বলছে, বর্তমানে ৬০ গ্রেডের প্রতি মে. টন রড স্থানীয় মার্কেটে ৮৫ হাজার থেকে ৯৩,৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কাঁচামাল ব্যবহারের উপর নির্ভর করে উৎপাদন ব্যয়ের ৬০-৬৫ শতাংশই খরচ হয় স্ক্র্যাপের পেছনে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম কমলেও তার সুবিধা স্থানীয় বাজারে পড়ার সুযোগ নেই বলে জানান বেসরকারি খাতের আমদানিকারকরা।
আমদানিকারকরা বলেন, কাঁচামাল আমদানির বিপরীতে অফশোর ব্যাংক থেকে স্থানীয় রড উৎপাদনকারীরা এলসির বিপরীতে ৩৬০ দিনের ঋণ সুবিধা পেয়ে থাকে। যে কারণে এখন যে কাঁচামাল স্থানীয় উৎপাদনকারীদের কাছে আসে সেগুলো ডলারের বিনিময় মূল্য যখন ৮৪ টাকা ছিল তখনকার। কিন্তু ৩৬০ দিনের ঋণ সুবিধার কারণে সেগুলো পরিশোধ করতে হয়েছে ১০৬ টাকা বা তারও বেশি। যে কারণে খরচ কমছে না। তবে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নভেম্বরে দেশে হ্রাসকৃত মূল্যের কাঁচামাল প্রবেশ করবে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এবং মেট্রোসেম ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, "স্ক্র্যাপের দাম কমেছে, কিন্তু আমরা এর সুবিধাটা নিতে পারছি না। কারণ এলসির বিপরীতে ৩৬০ দিনের যে ঋণ সুবিধা নিয়েছি সেখানে ডলারের বাড়তি রেট দিতে হচ্ছে। আবার কাঁচামাল আমদানির জন্য নতুন যে এলসি খুলতে যাচ্ছি সেখানে ১০ টাকা এলসি খুলতে গেলে হয়তো ব্যাংক একটার জন্য এলসি করতে পারছে।"
তিনি বলেন, "এসব কারণে কাঁচামালের আমদানি ৫০% কমে গেছে। এখন যেসব কোম্পানি রড উৎপাদন করছে সেগুলো আগের আমদানি করা কাচামাল দিয়ে। কিন্তু আগামী জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে যখন পণ্যটির পিক সিজন তখন তো আমরা পর্যাপ্ত সরবরাহ দিতে পারবো না। কারণ আমাদের কাঁচামালের সংকট। অথচ আমাদের কিন্তু উৎপাদন সংশ্লিষ্ট সব ধরনের ব্যয় একই রকম আছে।"
তিনি জানান, বিদ্যুতের সমস্যার অনেকটা সমাধান হলেও গ্যাসের সংকট রয়েই গেছে। যে কারণে ইন্ডাস্ট্রিগুলোর উৎপাদন এখনো ২০-২৫ শতাংশ কম। এ কারণেও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
কমিশনের প্রতিবেদনেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ না থাকার কারণে শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার করতে না পারায় একদিকে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে সরবরাহের পরিমাণ সংকুচিত হচ্ছে বলে উঠে এসেছে।
দেশে বর্তমানে প্রতি বছর এম এস রডের চাহিদা ৭ মিলিয়ন মে. টন। এর বিপরীতে স্থানীয় উৎপাদন ক্ষমতা ৯ মিলিয়ন মে. টন। স্থানীয় এই উৎপাদন ক্ষমতার ৫০% দেশের কয়েকটি বড় মিল পূরণ করে থাকে।
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের এক গবেষণার তথ্যে দেখা গেছে, উৎপাদনের ভিত্তিতে চারটি বড় কোম্পানির মার্কেট শেয়ারই হচ্ছে ৩৩.৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে ১৫.৮৬ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে শীর্ষে রয়েছে আবুল খায়ের স্টীল, বিএসআরএম এর ১১.৬৭ শতাংশ, কেএসআরএম এর ৩.৬৫ শতাংশ এবং জিপিএইচ ইস্পাতের ২.৪৭ শতাংশ।
এম এস রডের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় কোম্পানিগুলোর ভূমিকা বেশি বলে উঠে এসেছে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় বাজারে সর্বনিম্ন মূল্যের তুলনায় সর্বোচ্চ মূল্য বেশি বাড়ে। বাজারে যে সকল ব্র্যান্ড শক্তিশালী তারা যেভাবে মূল্য বাড়াচ্ছে সে তুলনায় দুর্বল ব্র্যান্ডের এমএস পণ্যের দাম বাড়ছে না। এদিকে এক্স-ফ্যাক্টরী মূল্য বিবেচনায় খুচরা মূল্যে প্রতি মেট্রিক টনে দামের পার্থক্য ৫-৮ হাজার টাকা।
জানা যায়, চাহিদার ভিত্তিতে সরকারি কাজে ৬০%, হাউজহোল্ডে ২৫% এবং বাণিজ্যিকভাবে নির্মাণ খাতে ১৫% স্টিলের ব্যবহার হয়ে থাকে।
ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রধান কাচামাল স্ক্র্যাপের আমদানি মূল্য কমলেও স্থানীয় বাজারে এর সম্পর্ক বিপরীত। ফলে ভোক্তা-সাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে আমদানি মূল্যের যথাযথ সমন্বয় করতে পারলে ভোক্তা উপকৃত হবে।
এদিকে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রড উৎপাদনের মধ্যবর্তী কাঁচামাল বিলেট আমদানিতে ৪৪ শতাংশ শুল্ক ও প্রতি মেট্রিক টনে ৫০০ টাকা অগ্রিম আয়কর রয়েছে। তবে রড আমদানি করতে হলে ৮৯.৩২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে স্থানীয় শিল্পকে প্রটেকশন দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু স্ক্র্যাপ আমদানিতে প্রতি মেট্রিক টনে কাস্টমস ডিউটি স্পেসিফিক শুল্ক ১৫০০ টাকা এবং অগ্রিম আয়কর রয়েছে ৫০০ টাকা। পাশাপাশি রডের বিক্রয় পর্যায়ে সর্বনিম্ন আয়কর হার ২ শতাংশ। এই কাঁচামালের অগ্রিম আয়কর এবং বিক্রয় পর্যায়ের আয়কর হার সমন্বয় করা হয় না। ব্যবসায় লাভ হোক আর লোকসান হোক এ ট্যাক্স সরকারকে প্রদান করতে হচ্ছে যা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীদের মুনাফার সাথে সমন্বয় করতে পারছে না।
এ কারণে স্ক্র্যাপ আমদানিতে অগ্রিম আয়কর ৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ৩০০ টাকা এবং বিক্রয় পর্যায়ে ২% কর কমিয়ে ১% করার সুপারিশ করেছে কমিশন। একই সঙ্গে নভেম্বরে কম মূল্যের যেসব কাঁচামাল দেশে প্রবেশ করবে সেগুলোর মূল্য সমন্বয় হচ্ছে কিনা তা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বাজারমূল্য পর্যবেক্ষণ করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া স্থানীয় উৎপাদন স্থিতিশীল রাখার জন্য গ্যাস বিদ্যুতের সরবরাহ ঠিক রাখা, উৎপাদনকারীদের বাজারজাতকৃত পণ্যের মূল্যের হ্রাস বৃদ্ধির পূর্বে সরকারকে জানানো বাধ্যতামূলক করা এবং কাঁচামালের মূল্য বিবেচনায় উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনার বিষয়ে তদারকির সুপারিশও করেছে কমিশন।
উল্লেখ্য, গত ৩০ আগস্ট তারিখে বাণিজ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত একটি সভা হয়। এই সভায় রড, সিমেন্ট, ভোজ্যতেল, চিনি, মসুর ডাল সহ যেসব পণ্যের বাজার মূল্যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে সেসব পণ্যের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার পর্যালোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ট্যারিফ কমিশনবকে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।