মহুয়া: ব্রিটিশদের নিষিদ্ধ করা মদ এখন বিশ্ববাজারের পথে...
অতীতে ভারতের মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পাওয়া যেত মহুয়া গাছ। উপমহাদেশের সঙ্গে এ গাছটির সম্পর্ক বহু আগের। এমনকি পুরাণেও এ গাছের উল্লেখ রয়েছে।
শত শত বছর ধরে আদিবাসীদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে মহুয়া। ফুল, ফল, ছাল, পাতা, বীজ - সবকিছুর ব্যবহার রপ্ত তাদের। কেবল সাংস্কৃতিকভাবেই নয়, অর্থনৈতিক দিক দিয়েও এই দেশি মদ তাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। উপনিবেশকালে ব্রিটিশরা এই মহুয়া ফুল এবং এর ফল থেকে তৈরি মদ নিষিদ্ধ করেছিল। সে ধারা অব্যহত ছিল স্বাধীনতা-উত্তর ভারতেও।
তবে এবার মহুয়ার খ্যাতির ছটা আবার ফিরে আসছে। কেবল সমগ্র ভারতেই নয়, ঘ্রাণে এবং স্বাদে অনন্য এই পানীয়কে বিশ্ববাজারে 'ব্র্যান্ড' হিসেবে প্রচলিত করার কথা ভাবছেন দেশটির উদ্যক্তারা।
আদিবাসীদের পাকা হাতে তৈরি এবং ব্রিটিশ আমল অতিক্রম করে আসা মহুয়ার বর্তমান ভারতীয় বাজার এবং এর সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা বিবিসির এক প্রতিবেদনে লিখেছেন সুগত মুখার্জি।
ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জ জেলার বাঘ সংরক্ষণের অভয়ারণ্য সিমলিপাল জাতীয় উদ্যান। সেখানে সকাল সকাল ড্রাইভে গিয়ে একসময় থামলাম এক ঝর্ণার পাশে। বনটি যেন সবুজ এক প্রাকৃতিক কার্পেটে মোড়ানো; চারপাশের গাছ থেকে ঝরে পড়ছিল হাজারো ফুল। চিত্রবৎ সুন্দর সে দৃশ্য!
তখনো মহুয়া গাছ চোখে পড়েনি, কিন্তু ঠিকই এর সুগন্ধ নাকে ধরা পড়ল। কিছুক্ষণ পর একটা মহুয়া গাছ দেখিয়ে দিয়ে আমার সাথে থাকা সাঁওতালি গাইড সুরেশ কিসকু বললেন, 'এগুলোই মহুয়া গাছ।'
পূর্ব-পশ্চিম ও মধ্য ভারতের সমতল বনভূমিতে প্রচুর পরিমাণে দেখা মিলবে এ গাছের। এসব অঞ্চলেই সাঁওতাল, গোন্ড, মুণ্ডা, ওরাওঁ আদিবাসীরা বাস করে আসছেন বিগত ৩,০০০ বছর ধরে। তাদের কাছে মহুয়া যেন অনেক কাছের কোনো বস্তু। তারা এ গাছকে বলে 'জীবনবৃক্ষ'।
এই আদিবাসী সম্প্রদায়েরা ঐতিহ্যগতভাবেই নিজেদের খাবার, গবাদি পশুর জাব, জ্বালানী এবং ওষুধ হিসেবে মহুয়ার ফুল, ফল, পাতা এবং শাখা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছে। এমনকি শস্যের বিনিময়ে মুদ্রা হিসেবেও তারা এগুলো ব্যবহার করত।
মহুয়া তাদের কাছে নিছক একটি উপকারি বস্তু নয়; নানা লোক উৎসব, গীতি এবং গাথায় মহুয়াকে স্থান দিত তারা, এক কথায় সম্মান দেখাত। তবে মহুয়ার সবচেয়ে বহুল ও জনপ্রিয় ব্যবহার হচ্ছে মিষ্টি সুরাজাতীয় পানীয়। একই নামে পরিচিত এ পানীয়টির ঘ্রাণ বেশ কড়া এবং সুগন্ধ। নিখুঁতভাবে প্রায় আট দিন প্রক্রিয়াজাত করে বানানো হয় এ পানীয়।
সিমলিপাল বন থেকে ফিরে সুরেশ আমাকে নিয়ে যান তার বাড়িতে। বনের ধারে অবস্থিত এ বাড়িতে ছোট বোন গীতা ও মাকে নিয়ে থাকেন সুরেশ। সেখানে পৌঁছে দেখলাম কাঠ-পোড়ানো আগুনের চুলার ওপরে একটি শক্ত ধাতব পাত্র, যার থেকে বেরোচ্ছে মহুয়ার সুগন্ধ। চুলার পাশে বসে ছিলেন গীতা ও তার মা।
বড় পাত্রটির ওপরে ছিল আরও দুটো ছোট পাত্র। যেটিতে মহুয়া ভেজানো পানির বাষ্প ঘণীভূত হয়ে একটি নলের মাধ্যমে জমা হবে মাটির মেঝেতে রাখা আরেকটি পাত্রে। কিছুক্ষণ পরে গীতা এক চামচ মহুয়া নিয়ে আগুনে ছুঁড়ে দিলেন আর সাথে সাথে জ্বলে উঠল আগুনের সাদা স্ফুলিঙ্গ। সুরেশ বোঝালেন, 'এর মানে মহুয়ার আত্মা বিশুদ্ধ।' অর্থাৎ যে মহুয়া তৈরি হচ্ছে তা একেবারে নির্ভেজাল, এক কথায় খাঁটি।
মহুয়া দেখতে পরিষ্কার, বর্ণহীন। সেদিন সন্ধ্যায় সবুজ পাতা দিয়ে বানানো কাপে করে আমার দিকে মহুয়া এগিয়ে দিলেন গীতা। বেশ ধীরেসুস্থে এক চুমুক দিলাম। সদ্য তৈরি এই পানীয় গলা দিয়ে নামতেই মনে হলো, কেন আগে টেস্ট করে দেখিনি!
উনিশ শতাব্দীর শেষের সময় থেকে সুরেশদের মতো আদিবাসী পরিবারগুলো কোনো খরচ ছাড়াই মহুয়া বানাত, পান করত এবং বিক্রিও করত। ভারতবর্ষকে মহুয়া গাছের আদি বাসস্থান বলে ধারণা হলেও, এই উপমহাদেশের মাটিতেই মহুয়াকে ব্রিটিশ উপনিবেশকালে 'আঘাতের' সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
সেসময় মহুয়াকে গণ্য করা হতো জনস্বাস্থ্য এবং নৈতিকতার জন্য হানিকর একটি মাদকদ্রব্য। এ কারণে ঔপনিবেশিক আইনপ্রণেতারা ১৮৭৮ সালে বোম্বে আকবরি আইন এবং ১৮৯২ সালে মৌরা আইন প্রণয়ন করেন। আইন দুটোর মাধ্যমে মহুয়া কেবল নিষিদ্ধ কিংবা এর ব্যবহার সীমাবদ্ধই করা হয়নি, আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মহুয়া ফুল সংগ্রহ এবং সংরক্ষণকেও কঠোর হস্তে দমন করা হয়েছিল এগুলোর দ্বারা।
আবার আইনীভাবে নিষিদ্ধ হলেও কেউ কেউ চোরা উপায়ে মহুয়া তৈরি করতেন; তবে সেগুলো আগের মতো শতভাগ খাঁটি হতো না, কারণ এতে মেশানো থাকত অন্য দ্রব্য। এভাবে মহুয়ার মান ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তবে এতে লাভবান হয় ব্রিটিশরা। তাদের নিজ দেশ অর্থাৎ ব্রিটেন এবং জার্মানি থেকে ভারতবর্ষে অ্যালকোহল আমদানি থেকে তারা প্রচুর লাভবান হতেন। এভাবে একদিকে উপমহাদেশের স্থানীয় বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখছে, অন্যদিকে বাজারে নতুন সৃষ্ট মহুয়ার অভাব মেটাতে ব্রিটেন থেকে আমদানি করা মদ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছিল ব্রিটিশরা।
বাইরে থেকে আসা মদের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও মহুয়ার স্থানীয় চাহিদা থেকে গিয়েছিল। 'মহুয়ার মতো দেশী পানীয়ের সাংস্কৃতিক এবং পুষ্টিমূ্ল্যের যে গুরুত্ব ছিল - তা উপলব্ধি করলেও আয়ের হুমকিকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন ঔপনিবেশিক কর্মকর্তারা,' এমনটাই বলেন ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন-এর মডার্ন হিস্ট্রির অধ্যাপক এরিকা ওয়াল্ড।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরও মহুয়ার ক্ষেত্রে একই নিয়ম চালু ছিল। অ্যালকোহলের উৎপাদন ও বিক্রয় অনুমোদিত হলেও আগেকার শাসকদের সময়ের মতোই মহুয়া ছিল কঠোর আইন ও সীমাবদ্ধতার বেড়াজালে।
প্রথম দিককার জাতীয়তাবাদীদের চোখে অ্যালকোহল ছিল 'ভিনদেশী', আর মহুয়াসহ অনেক মদজাতীয় পানীয়কে 'সমস্যাযুক্ত' বলে গণ্য করা হতো। এভাবেই নিম্নমানের 'বিপজ্জনক' পানীয়ের কাতারে রয়ে যায় মহুয়া; ফলে গ্রামের স্থানীয় বাজারের বাইরে এটি বিক্রি করা থেকে বঞ্চিত হয়েই থেকে যায় আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো।
এটিকে আদিবাসীদের জীবনধারাকে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় অভিজাতদের ঘৃণামিশ্রিত চোখে দেখার প্রবণতার প্রতিচ্ছবি বলে মনে করেন নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি-এর ফুড স্টাডিজের অধ্যাপক কৃষ্ণেন্দু রায়। তার মতে, মহুয়া ব্যবসায়ের সীমাবদ্ধতা ভারতীয় মদ শিল্পে 'মাঝারি মানের' পানীয়ের প্রাচুর্য সৃষ্টি করেছে।
এমন সময়ে মহুয়ার মতো বিশুদ্ধমানের পানীয়কে পুনরায় ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজন উদ্যোক্তাদের শক্তিশালী হস্তক্ষেপ এবং আইনী সীমাবদ্ধতা দূর করার প্রচেষ্টা।
২০১৮ সালে ডেসমন্ডজি নামে ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করেন ডেসমন্ড নাজারেথ; বাজারে আনেন 'মহুয়া স্পিরিট' এবং 'মহুয়া লিকার'। তিনি জানান, 'আমরা আইএমএল (ইন্ডিয়াম-মেইড-লিকার) এই ট্যাগের অধীনে গোয়ায় মহুয়ার বিক্রয় শুরু করি। এই ট্যাগটি ব্যবহারের অনুমতি পেতে সরকারের সাথে বহুবার আলোচনায় বসতে হয়েছিল।'
গোয়া এবং কর্ণাটক- ভারতের কেবল এ দুটি রাজ্য মহুয়াকে আইএমএল বলে স্বীকৃতি দেয়, যেখানে অন্যান্য রাজ্যে এটি 'কান্ট্রি স্পিরিট' বা দেশী মদ হিসেবে বিবেচনা করে। দেশটির আইন অনুসারে, 'কান্ট্রি স্পিরিট' আন্তঃরাজ্য সীমান্ত দিয়ে বিক্রি করা যাবে না। সুতরাং আইএমএল এই ট্যাগে মহুয়া স্বীকৃত হলে এটিলে আরও বৃহত্তর ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
তবে গত কয়েক বছর ধরে স্থানীয় সরকার এবং এজেন্সিগুলোর রক্ষণশীল মনোভাবে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, গতবছর (২০১১) মধ্যপ্রদেশের সরকার মহুয়াকে ঐতিহ্যবাহী মদ বলে স্বীকৃতি দেয়। অন্যদিকে আদিবাসীদের মহুয়া ফুল সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অনুমতি প্রদান করতে পুরোনো আইন সংস্কার করে মহারাষ্ট্রের সরকার। একইবছর সরকারি সংস্থা এগ্রিকালচার অ্যান্ড প্রসেসড ফুড প্রোডাক্টস এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর দ্বারা সংগৃহীত এবং শুকানো মহুয়া ফুল ফ্রান্সে আমদানি করেছিল।
কিছু রাজ্যে মহুয়া নিষিদ্ধকরণের নিয়ম তুলে নেওয়া হলেও আরও কার্যকরী ব্যবসায় উদ্যোগ ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়োজন সারা দেশে এই নিষিদ্ধকরণ নিয়ম বাতিল করা।
আদিবাসী মহুয়া উৎপাদনকারীদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা প্রদানের জন্য একটি মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রি গঠন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন মুম্বাইভিত্তিক স্টার্ট-আপ নেটিভ ব্রুজ-এর পরিচালক সুজ্যান ডিয়াজ। তার মতে, মহুয়া শিল্পের জন্য একটি টেকসই উন্নয়ন মডেল তৈরি করলে আদিবাসী সম্প্রদায় আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।
নাজারেথের বিশ্বাস, মহুয়া ভারতের জাতীয় ঐতিহ্যবাহী মদ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য একদম উপযুক্ত, বৈশ্বিক বাজারেও সুপরিচিত হয়ে উঠতে পারে প্রাকৃতিকভাবে সুমিষ্ট ফুল থেকে তৈরি অনন্য ফ্লেভারের এই 'দেশী মদ'।
'মহুয়া টু দ্য ওয়ার্ল্ড' নামক একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে আগামী বছর (২০২৩) নাগাদ যুক্তরাজ্যে এবং পরবর্তীতে উত্তর আমেরিকাসহ বৈশ্বিক বাজারে মহুয়া প্রচলন করার পরকল্পনা করছেন নাজারেথ।
বছরের পর বছর ধরে নিষিদ্ধ ও সীমাবদ্ধ প্রচলনের মহুয়া ভারত ছাড়িয়ে বিশ্ববাজারে ব্র্যান্ড হিসেবে স্থান করে নিলে তা দেশটির অর্থনীতিতে বড়সড় প্রভাব আনতে পারে।
- বিবিসি ট্রাভেল থেকে অনূদিত