প্রবাসী কর্মীরা এখন ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিমা কাভারের আওতায়
প্রবাসী কর্মীদের জন্য সুবিধা বাড়িয়ে নতুন বিমা স্কিম চালু করেছে সরকার। বলা যেতে পারে, সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসের আরও ভালো যত্ন নেওয়ার জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া নতুন এই স্কিম অনুযায়ী, একজন বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মী এখন কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু এবং উভয় চোখ বা উভয় হাত হারানোর মতো স্থায়ী পঙ্গুত্বের জন্য ১০ লাখ টাকার বিমা কাভারেজ পাবেন। আগে পেতেন ৪ লাখ টাকা।
আর এক চোখ বা কবজির ক্ষতির মতো আংশিক স্থায়ী পঙ্গুত্বের জন্য প্রবাসী কর্মীরা ১০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বিমা কাভারেজ পাবেন।
এছাড়া আগের বিমা পরিকল্পনায় একজন কর্মী প্রিমিয়াম পরিশোধের পর বিদেশ গিয়ে কাজ না পেয়ে দেশে ফিরলে কোনো ক্ষতিপূরণই পেতেন না। এখন থেকে বিদেশ গিয়ে কাজ না পেয়ে ছয় মাসের মধ্যে ফিরে এলে তারা ৫০ হাজার টাকা সহায়তা পাবেন।
আগে বিমার অঙ্ক ছিল সর্বোচ্চ ৪ লাখ টাকা, মেয়াদ দুই বছর। তখন বিমার এককালীন প্রিমিয়াম—বিমা পলিসির জন্য যে অর্থ পরিশোধ করা হয়—ছিল ৪৯০ টাকা।
নতুন স্কিমে এককালীন প্রিমিয়াম বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বিমার মেয়াদ এবার বাড়িয়ে করা হয়েছে পাঁচ বছর।
নতুন এই বিমা চালুর বিষয়ে গত ৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বিমা কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করেছে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। চুক্তি অনুসারে, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড বিদেশগামী প্রবাসীদের কাছ থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে জীবন বীমা কর্পোরেশনে জমা দেবে।
গত ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রপ্তানি বাণিজ্যে মন্দায় রিজার্ভে চাপ পড়ায় ১.৩০ কোটি রেমিট্যান্স যোদ্ধা প্রবাসী কর্মীরা গুরুত্ব পাচ্ছেন। গত অর্থবছরে দেশে ২১ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে।
ডলারের সংকটের মধ্যে সরকার অভিবাসন ও রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বাড়ানোর ওপর মনোযোগ দিচ্ছে। এ কারণে প্রবাসীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কর্তৃপক্ষকে।
কর্মকর্তারা আশা করছেন, বাড়তি সুযোগ-সুবিধা প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবৈধ কিন্তু ভালো রেটে 'হুন্ডি'তে পাঠানোর বদলে আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বেশি বেশি ডলার দেশে পাঠাতে উৎসাহিত করবে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালযয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুস সালেহীন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশনা রয়েছে।'
অভিবাসনকে টেকসই ও অর্থবহ করার জন্য ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে। আহমেদ মুনিরুস সালেহীন কল্যাণ বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি।
কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি কমাতে ও অভিবাসন নিরাপত্তা সর্বোচ্চ করতে সরকার ২০১৯ সালে সব বিদেশগামী কর্মীর জন্য বিমা বাধ্যতামূলক করে।
কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশগামী বাংলাদেশিদের বিমা সুবিধার আওতায় আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
জীবন বীমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, বিমার মেয়াদ আগের দুই বছর থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর করার কারণে প্রিমিয়াম বাড়ানো হয়েছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, চলতি বছরের অক্টোবরে প্রায় ৭৩ হাজার ১৪৩ জন বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে গেছেন, যা আগের মাসের চেয়ে ১৯ শতাংশ কম।
ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) প্রায় ৯ লাখ ৪৭ হাজার মানুষ বাংলাদেশ ছেড়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫ লাখ ৪৩ হাজার বাংলাদেশি কর্মী নিয়ে অভিবাসন গন্তব্যের শীর্ষে রয়েছে তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরব, আর ওমান ছিল ১ লাখ ৪৪ হাজারের বেশি শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রের গন্তব্য।
জুলাই মাসে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পর টানা তিন মাস রেমিট্যান্সে ব্যাপক পতন হয়। এরপর নভেম্বর মাসে অক্টোবরের চেয়ে ৪.৫৪ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স আসে। বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা নভেম্বরে দেশে ১৫৯ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন।
ডলার সংকটের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য অর্থ লেনদেনের নিয়ম শিথিল, লেনদেনের ফি মওকুফ ও বিদেশে মানি এক্সচেঞ্জ শপের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে।
এছাড়াও বিকাশ, রকেট, উপায়ের মতো জনপ্রিয় মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আনার জন্য বিদেশে অবস্থিত এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোকে অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে অর্থ লেনদেনের তিন স্তরের কাজ নেমে আসবে একটিতে—ফলে তৎক্ষণাৎ টাকা পাঠানো যাবে দেশে।
রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সর্বশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে আহমেদ মুনিরুস সালেহীন বলেন, তারা বিমা সুবিধা জনপ্রিয় করার জন্য কাজ করছেন।
তিনি বলেন, 'দেশ ছাড়ার সময় সব কর্মীরা [বিমার] টাকা দিলেও অনেক কর্মীই এর সম্পর্কে [বিমা কাভারেজ] জানেনও না।'
অভিবাসীদের অধিকার সংস্থা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য রাইটস অভ বাংলাদেশি ইমিগ্রেন্টস ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বিমা কাভারেজ বাড়ানোর এই পদক্ষেপের প্রশংসা করেন।
তবে বিমার প্রিমিয়াম অভিবাসীদের কল্যাণ ফি থেকে দেওয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া ধীরে ধীরে বিমা কাভার বাড়ানো এবং প্রবাসীরা দেশে ফেরার পর তাদের জন্য পেনশন চালু করার আহ্বানও জানান সাইফুল হক।