বিজয়গাথার এক অনন্য প্রতীক: উত্তরবঙ্গ জাদুঘর
ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা লিংকন 'পাগল না প্রতিভাবান! আমি এই সংশয়ে পড়েছি'; এই মন্তব্য লেখক কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকের। শুধু আনোয়ারা কেন, এমন মন্তব্য তাকে নিয়ে কুড়িগ্রামের কিংবা উত্তরাঞ্চলের অনেকেই করেছেন। তবে লিংকন তার কাজের মাধ্যমেই দিয়ে চলেছেন সে উত্তর।
দারিদ্র্যপীড়িত জেলা কুড়িগ্রামে এ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে– স্থানীয়দের সামনে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নানান অধ্যায় ও তার প্রেক্ষাপট, প্রভাব সহজবোধ্যভাবে তুলে ধরেছেন।
দেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে রক্ষা এবং মানুষের সামনে তুলে ধরতে নিজের সর্বোচ্চটা করেছেন লিংকন। তার জাদুঘরের মাধ্যমে জাতির সামনে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র হাজির করেছেন।
'এই নক্ষত্র অন্ধকারে পথ দেখাবে। বাতিঘরের মতো জ্বলজ্বল করবে'- জাদুঘরটি সম্পর্কে এমন মন্তব্য সাংসদ, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী ও নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূরের।
উত্তরবঙ্গ জাদুঘর আজ দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। আইনজীবী এসএম আব্রাহাম লিংকনের দূরদর্শী নেতৃত্বে এই জাদুঘর নিজ নাম প্রতিষ্ঠিত করেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসের গৌরব উজ্জ্বল অথচ বেদনাবিধুর এক অধ্যায় তুলে ধরার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে।
এই জাদুঘর নিয়ে লেখালেখি অনেক হলেও, এর প্রতিষ্ঠাতা ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী– এসএম আব্রাহাম লিংকন সম্পর্কেও জানা দরকার। তিনিও তার সৃষ্টির চেয়ে কোনো অংশেই কম নন।
শৈশবেই লিংকনের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ছিলেন তুখোড় ছাত্রনেতা।লিংকন উত্তর জনপদের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ- রাকসুর সাবেক এজিএস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর। সে সময়ে এ দুই পদেই বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন মুক্তিকামী বাঙালির ইতিহাস সংগ্রহের কারিগর লিংকন, যা তৎকালীন ছাত্র সমাজে তার জনপ্রিয়তাকেও প্রমাণ করে।
১৯৯০ এর দশকে স্বৈরাচারী এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে ছিল তার নেতৃস্থানীয় ভূমিকা। সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার পর হন– হাইকোর্টের আইনজীবী। কিন্তু, সব প্রতিভাবানের মতোনই ছিলেন বড় অস্থিরচিত্ত। নাড়ির টানে এক সময় ফিরে আসেন কুড়িগ্রামে। সেখানেই শুরু করেন আইন পেশা। আর এটাও যথেষ্ট ছিল না তার জন্য, সব সময়ই প্রেরণাদায়ক কিছু করার একটা তাগিদ তার ভেতর কাজ করেছে।
লিংকন চেয়েছেন আরও অনেক কিছু করতে। সেই তাগিদ থেকেই ঐতিহাসিক নথি আর নিদর্শন সংগ্রহ শুরু করেন। নিজ বাড়িতেই গড়ে তোলেন একটি জাদুঘর।
তার গড়া উত্তরবঙ্গ জাদুঘর শুধু ইতিহাসের পাঠশালাই নয়, মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধসহ নানান পর্বের প্রমাণকও বটে। যুদ্ধাপরাধের বিচারে নানা সাক্ষ্য-সহযোগিতার আমলযোগ্য প্রতিষ্ঠান এই জাদুঘর।
শুরুর গল্প
দৃঢ় রাজনৈতিক আদর্শ এবং পারিবারিক প্রভাবই লিংকনের জাদুঘরটি গড়ে তোলার পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখে।
তার পিতা– প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদ কুড়িগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি কুড়িগ্রাম মহকুমায় আনসার কমান্ডার ছিলেন। তার নেতৃত্বে কুড়িগ্রামে আনসার সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
লিংকনের মেজভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন ওরফে রশীদ লাল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জেলার সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ছিলেন। তারা বাবা-ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা– একই সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবা একটি শিশুকে পেয়েছিলেন। শিশুটি এত ছোট্ট ছিল যে বাবা-মা ঠিকানা কিছুই বলতে পারেনি। হয়তো সে ভারতমুখী শরণার্থীর মিছিল থেকে ছিটকে পড়েছে কিংবা পাকিস্তানী সেনাদের হাতে শহীদ হয়েছে তার বাবা-মা। পরে এই শিশুটিকে পালক নেন তারা। নাম রাখেন– এসএম আল মাহমুদ সজীব।
লিংকন বলেন, "আমাদের বাড়িতেই মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত স্মৃতিস্মারক রয়েছে; ওকে (সজীব) যখন দেখি তখন প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধ দেখি। এখনো সে তার জন্মদাতা বাবার খোঁজ করে। জন্মপরিচয় খুঁজে বেড়ায়।"
আক্ষরিক অর্থেই, আজো কুড়িগ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক নিদর্শন।
এক পর্যায়ে বাংলা একাডেমী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখার দায়িত্ব দেয় তাঁকে। যার ফসল 'মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস:রংপুর' নামক বইটি।
তার আগে রংপুর গবেষণা পরিষদ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। সেখানে 'রংপুরের বরেণ্য ব্যক্তিগণ' নামে একটি যৌথগ্রন্থের কাজ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংকলনে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছেন। মাঠে কাজ করতে গিয়ে স্বাধীনতা-বিরোধীদের কিছু নথি তাঁর হাতে আসে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের সহযোগী কারা ছিল, তারা কীভাবে সহযোগিতা করেছে; হিন্দু সম্পদ আত্মসাতের নানান দলিল তার হাতে আসে। স্বাধীনতা-বিরোধীদের স্বহস্তে লিখিত কুকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে লেখা আবেদনপত্রও পেয়ে যান, যা মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রামাণ্য দলিল।
গড়ে তোলার যাত্রা
অ্যাডভোকেট লিংকন মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মারক ইতঃপূর্বে ঢাকা ও রংপুরে দিয়েছিলেন। কিন্তু, নানা কারণে সেগুলো প্রদর্শিত হয়নি। আঞ্চলিকতার কারণে হয়তো সেসব জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব পায়নি। এবিষয়টি লিংকনকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি উপলদ্ধি করেন, ''এসব ইতিহাস তো আমাদের। আমাদের অঞ্চলের। এগুলো অবশ্যই মানুষকে দেখানো দরকার'।
তখন উত্তর জনপদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে জাদুঘর গড়ার ইচ্ছা জাগে তার। এটা করতে তিনি রাজনীতিবিদ, সামাজিক ব্যক্তিত্ব, স্থানীয় প্রশাসন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান– অনেকের কাছে সহযোগিতা চান। কিন্তু, কেউ এগিয়ে আসেনি।
আব্রাহাম লিংকন হতাশ হননি। দমেও যাননি। তিনি কোথাও সাড়া না পেয়ে, তাঁর সকল কাজের সহযোগী- স্ত্রী অধ্যাপক নাজমুন নাহার সুইটির শরণাপন্ন হন। তাঁর সাথে পরামর্শ করে বাড়িতেই জাদুঘর গড়ে নিদর্শনগুলো প্রদর্শন শুরু করেন।
এভাবেই ২০১২ সালে যাত্রা শুরু করে উত্তরবঙ্গ জাদুঘর।
শুরুটা হয়েছিল ড্রয়িং রুম থেকে, কিন্তু অচিরেই তার পুরো বাড়ি হয়ে ওঠে স্মৃতির পাঠাগার।
প্রথমদিকে জাদুঘরটি শুধু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছিল, পরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হকসহ অনেকের পরামর্শে এটিতে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ঐতিহ্যের বিষয়গুলোকেও ধারণ করা হয়।
বিরল এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বাসভবনের সাথে জাদুঘরের পৃথক ভবন নির্মাণের জন্য কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জমিও দান করেছেন লিংকন। সে জমিতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ইতোমধ্যে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করছে।
ইতিহাসের উজ্জ্বল শৈলী
জাদুঘরের প্রদর্শনীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিক্ষেপিত বিস্ফোরিত মর্টার শেল, গ্রেনেড-গোলার বাক্সও রয়েছে।
রয়েছে একাত্তরে নর্থ জোনের বেসামরিক প্রশাসনের নানান দলিল, রাজস্ব সংগ্রহের রেকর্ড কালেকশন, বিচারিক নথি ইত্যাদি।
রয়েছে স্থানীয় শান্তি কমিটির কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ, রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেওয়ার কিছু আবেদনপত্র, শান্তি কমিটির রেজ্যুলেশন-তালিকা, হিন্দু সম্পত্তি দখলের আবেদনপত্র, স্থানীয় দালাল-রাজাকারদের স্বহস্তে লিখিত ক্ষমা প্রার্থনার কপিও।
একাত্তরে যারা যুদ্ধ করেছেন এবং খেতাব পেয়েছেন– এমন বরেণ্য যোদ্ধাদের ছবি ও পরিচয় নিয়ে আছে গ্যালারি। আছে কুড়িগ্রামে স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরির সেলাই মেশিন, বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহৃত ল্যারেটরির কেমিক্যাল স্কেল, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে শের-ই-বাংলার লিখিত চিঠি, শহীদ জায়া ও জননীদের লেখা বঙ্গবন্ধুর চিঠি– এমন বহু নিদর্শন। আছে রণাঙ্গন থেকে প্রকাশিত হাতে লেখা 'অগ্রদূত' পত্রিকার সব সংখ্যা।
প্রদর্শনীতে আরও রয়েছে, দালাল আইন বা 'দ্য বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২- এর অভিযোগপত্রের কোর্ট রেজিস্ট্রারের ফটোকপি। উলিপুর থেকে উদ্ধার করা প্রাচীন মন্দিরের টেরাকোটার ইট।
ব্রিটিশ পূর্ব ও পরবর্তী বিভিন্ন আমলের ধাতব ও কাগজের মুদ্রাও রয়েছে উত্তরবঙ্গ জাদুঘরে।
মিত্রবাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল স্যাম হরমুসজি জামশেদজী মানেকশ' পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়ে যে লিফলেট জারি করেন, তার মূল কপিসহ গুরুত্বপূর্ণ অজস্র নথি রয়েছে।
জাদুঘরের রূপকার আব্রাহাম লিংকন বলেন, এখন সারাদেশের বধ্যভূমি ও গণকবর থেকে ক্রমান্বয়ে মাটি সংগ্রহ করা হচ্ছে। দেশের ৬৪ জেলার বধ্যভূমি ও গণকবরের মাটি দিয়ে জাদুঘরের মধ্যে বাংলাদেশের একটি মানচিত্র নির্মাণ করা হবে। এটিও জাতির জন্য এক অনন্য নিদর্শন বহন করবে।
জাদুঘর নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এর নতুন ভবনটিকে ঘিরেই। ২০২১ সালের ২ জুলাই যার নির্মাণকাজ শুরু হয়। এর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ কোটি টাকা; এরমধ্যে তারা পেয়েছেন ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
লিংকন জানান, এই জাদুঘরে তিনি বৃহত্তর বাংলা (পূর্ব ও পশ্চিম) অঞ্চলের নিদর্শন সংরক্ষণ করতে চান। এটির ব্যবস্থাপনার জন্য একটি স্থায়ী তহবিল গঠনের প্রতিও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
তার মতে, 'আসলে প্রতিষ্ঠা আমরা করলেও, বাংলাদেশের জনগণই তো এর প্রকৃত মালিক'।