৮ বছর ধরে বন্ধ সৈয়দপুরের সেতু কারখানা, আমদানি-নির্ভর রেলওয়ে
জনবলের সংকট, দীর্ঘদিন আধুনিকায়ন না হওয়া ও তদারকির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে ব্রিটিশ আমলের প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনা নীলফামারী সৈয়দপুরের রেলওয়ে সেতু কারখানা। শুধু বাংলাদেশই নয়, এটি ছিল উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ রেলওয়ে সেতু কারখানা। ২০১৪ সালে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে সৈয়দপুরের ঐতিহ্যবাহী এ সেতু কারখানাটি।
রেলসূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ তিন দেশের রেল নেটওয়ার্ক ছিল একই। রেল ব্যবস্থাকে স্বনির্ভর করতে ও রেল সেবা নির্বিঘ্ন করতে গড়ে তোলা হয় বিশাল এই রেল সেতু কারখানা। আসাম-বেঙ্গল রেলওয়েকে ঘিরে ১৮৭০ সালে ১১০ একর জমিতে স্থাপন করা হয় সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। একই সময়ে উপমহাদেশের অন্যতম এ বৃহৎ কারখানাটির অভ্যন্তরে অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিমাংশে প্রায় ১৮ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয় ব্রিজ ওয়ার্কশপ তথা সেতু কারখানাটি। মূলত ব্রডগেজ, মিটারগেজ, রেলপথের ব্রিজ এবং রেলপথের পয়েন্টস অ্যান্ড ক্রসিং ও গার্ডার ইয়ার্ড তৈরির জন্যই এ সেতু কারখানাটি গড়ে তোলা হয়েছিল।
শুরুতে এ কারখানার কর্মকাণ্ড পরিচালনায় মেশিন শপ, পয়েন্টস অ্যান্ড ক্রসিং শপ ও গাডার ইয়ার্ড শপ নামে তিনটি উপ-কারখানায় প্রায় এক হাজার শ্রমিক কাজ করত। রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের সব স্টেশনের প্লাটফর্ম শেডের মালামাল, রেললাইনের পয়েন্ট অ্যান্ড ক্রসিং, ব্রিজ গার্ডার, ট্রলি ও মোটরট্রলি মেরামত এবং তৈরি, মোর গার্ডার, পানির ট্যাংক, ফুটওভার ব্রিজের মালামাল, ট্যাং স্টেজিংসহ ১০০ ধরনের মালামাল তৈরি হতো এ কারখানায়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত কারখানাটিতে প্রায় এক হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। কিন্তু ১৯৯১ সালে রেলওয়ের ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে 'গোল্ডেন হ্যান্ডশেক' ঘোষণা দিলে ওই সুবিধা নিয়ে অনেক শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি ছেড়ে অবসরে যান। পরবর্তীতে মঞ্জুরিকৃত ১২৭টি পদের মধ্যে নিয়মিত অবসরে যেতে যেতে মাত্র ছয়জন শ্রমিক-কর্মচারীতে নেমে আসে। ফলে ২০১৪ সালে এটিকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
বর্তমানে একজন স্টোরকিপার, একজন অফিস সহকারী এবং একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী- এ তিনজন মিলে কারখানাটি দেখভাল করছেন। দায়িত্বে থাকা সহকারী সেতু প্রকৌশলী নিয়মিত কর্মস্থলে আসেন না। এছাড়া কাগজ-কলমে সেতু কারখানাটির নির্বাহী প্রধান হিসেবে প্রকৌশলী মো. আবদুর রহিমের নাম থাকলেও তিনি রেলওয়ের পাকশী বিভাগে কর্মরত রয়েছেন।
২০১৪ সাল পর্যন্ত রেলের বিভিন্ন সেতু, কালভার্ট, ব্রিজ এখানকার উৎপাদিত মালামাল দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা মেরামত হয়েছে।
কারখানাটির মেশিনগুলো ইংল্যান্ড, জার্মানি, আমেরিকা, জাপান আর ফ্রান্স থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। প্রতিটি মেশিনের দাম কয়েক কোটি টাকা করে। কোনো কোনো ভারী মেশিনের দাম আছে কয়েকশ কোটি টাকা পর্যন্ত। আশি-নব্বইয়ের দশকে এই কারখানা রেলের নিজস্ব চাহিদা পূরণ করে উৎপাদিত মালামাল বাইরেও বিক্রি করত। এতে রেল প্রতিবছর আর্থিকভাবে লাভবানও হতো বেশ।
জানা যায়, বর্তমানে এ কারখানার ৩টি উপ-কারখানার মধ্যে প্লাটফর্ম শেড বা নকশা ঘরটি তালাবদ্ধ। ভিতরে আবর্জনার স্তূপ। এছাড়া জরাজীর্ণ অফিসঘর, পরিচ্ছন্নতার অভাবে খোলা আকাশের নিচে মাটির ওপরে অ্যাঙ্গেল রড, স্কয়ার রড, কভার প্লেট, মিটার ও ব্রডগেজ লাইনের সেতুর স্পিয়ার গার্ডার, তিস্তা ও পাকশি হার্ডিঞ্জ সেতুর পরিত্যক্ত লোহা-লক্কড়, রেললাইন, একটি বিকল স্টিম ক্রেনসহ বিভিন্ন ধরনের লোহার মালামাল বিক্ষিপ্তভাবে রাখায় এর ভেতর দিয়ে বেরিয়েছে জংলি গাছ। পুরো ইয়ার্ডজুড়ে মাটির নিচে চাপা পড়েছে ফ্রেঞ্চ প্লেট ও কভার প্লেট। যার আনুমানিক বাজারমূল্য অন্তত হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছে এখানে কর্মরতরা।
রেল কর্মকর্তারা জানায়, কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রেলের নতুন সেতু নির্মাণ কিংবা ছোট-বড় সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত পুরোপুরি বিদেশনির্ভর হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর ১০০ কোটি টাকার অধিক মালামাল কিনতে হচ্ছে বিদেশ থেকে। বিগত ৮ বছরে প্রায় ১ হাজার কোটির টাকা মালামাল কিনতে হয়েছে বিদেশ থেকে। যেসব মালামাল একসময় এখানে উৎপাদন করা হতো তার সবাই এখন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। অথচ শুধু লোকবলের অভাবে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও চালু করা যাচ্ছে না রেলওয়ে সেতু কারখানা।
সৈয়দপুর রেলওয়ে সেতু কারখানার সহকারী সেতু প্রকৌশলী জুয়েল মিঞা জানান, নষ্ট মেশিনপত্র এদেশে মেরামত সম্ভব নয়। এ সকল মেশিন ক্রয়ে ৪ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি।
রেল সূত্রে জানা যায়, গত দশ বছরে রেলের উন্নয়ন বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরে রেলের বাজেট ১২ হাজার কোটি টাকা। এর আগের বছর ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। এ মুহূর্তে রেলের উন্নয়ন প্রকল্প চলছে ৪৩টি। এসব প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। এত কোটি টাকার বিশাল প্রকল্প, কিন্তু কারখানাটি সচল করার কোনো প্রকল্প নেই। উদ্যোগ নেয়া হয়নি ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলোকে ভালোভাবে মেরামতেরও।
নূরুল ইসলাম সুজন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন রেলপথ নির্মাণ ছাড়াও পথ ও কালভার্ট ব্রিজের সংস্কার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, দ্রুতই পূর্ণাঙ্গ জরিপ করে যেখানে যেমন সংস্কার বা নির্মাণ প্রয়োজন তা করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রেলপথকে ঢেলে সাজানোর কাজও করা হবে।
তবে মন্ত্রী দায়িত্ব নেয়ার প্রায় চার বছরে হয়ে গেলেও এখনও সংস্কার হয়নি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু এবং চালু হয়নি সৈয়দপুরের সেতু কারখানাটি।
এদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ের ২০১৯-২০ সালের তথ্যমতে, দেশের রেলপথে ছোট-বড় মিলিয়ে রেলওয়ের সেতু রয়েছে ৩ হাজার ৫৫৩টি। ৩৪৭ বড় সেতু এবং ছোট সেতু রয়েছে ৩ হাজার ২০৬টি। এসবের মধ্যে ৪০২টি সেতুই ঝুঁকিপূর্ণ, যেগুলোর উপর দিয়ে অহরহ চলছে ট্রেন।
জানা যায়, এসব সেতুর অধিকাংশেরই নির্মাণকাল ব্রিটিশ আমলে, সেতুগুলোর বয়স বর্তমানে ৮০-১০০ বছর। বেশিরভাগ সেতু নির্মাণ করা হয় ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে। রেল কর্তৃপক্ষের বছরভিত্তিক জরিপে দেখা যায়, এসব ব্রিজ-কালভার্ট এখন চলাচলের অনুপযোগী বা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু সংস্কার না হওয়ায় রেল চলাচলে ক্রমাগত ঝুঁকি বাড়ছে।
গত বছরের ১১ জানুয়ারি রেল মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় এক সভায় উল্লেখ করা হয়, ২০০৮-২০১৮ সালে লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় ২৬৩ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৯ সালে ১৮ জন ও ২০২০ সালে ১৭ জন প্রাণ হারান। এই সময়ে আহত হন কমপক্ষে এক হাজার মানুষ।
রেলওয়ের হিসাবে, ২০১৪ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত ছয় বছরে রেলে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৭৫ জন। এসব দুর্ঘটনার পেছনে অন্যান্য কারণ ছাড়াও রেলসেতুগুলো দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়া অন্যতম একটি কারণ।
স্বাভাবিক নিয়মে সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৭০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন পরিচালনার কথা থাকলেও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ঘণ্টায় মাত্র ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার গতিতে এ সব সেতু পার করেন তারা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোঃ হাদিউজ্জামান বলেন, "রেলের জন্য কম করে হলেও ১০০০ ধরনের যন্ত্রাংশ প্রয়োজন। রেলওয়ের সেতু কারখানাটি বন্ধ থাকায় প্রতিবছর শতশত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে, দিনদিন রেলের সেতুগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিত আর কালক্ষেপণ না করে কারখানাটি পুনরায় চালু করা এবং কারখানাটি পরিচালনার জন্য দক্ষ-আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল নিয়োগ দেয়া।"
তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস এম সলিমুল্লাহ বাহার বলেছেন, "রেলওয়ে সেতু ওয়ার্কশপের কার্যক্রম পুনরায় চালু করার কোনো পরিকল্পনা বর্তমানে আমাদের নেই।"