রাশিয়ান গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ করতে এলএনজি’তে শতকোটি ইউরো ব্যয় করছে ইউরোপ
নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করার বিষয়ে ইউরোপ বদ্ধপরিকর থাকলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এ অঞ্চলের দেশগুলো এখন আবার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপরই নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো বর্তমানে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)-এর পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করছে। বিস্তারিত ডয়েচে ভেলে'র প্রতিবেদনে।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। এর সপ্তাখানেক পরে মার্চের ৫ তারিখে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লায়েন জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ইইউ'র নির্ভরতা নিয়ে একটি টুইট করেন।
রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেবে এমন আশঙ্কা করে ওই টু্ইটে তিনি লিখেন, 'ইইউকে অবশ্যই জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্ত হতে হবে।' এসময় তিনি স্পেনের এলএনজি সক্ষমতার কথা উল্লেখ করে এটিকে এ প্রক্রিয়ার অগ্রগ্রামী দেশ হিসেবে প্রশংসা করেন।
এলএনজিকে ভন ডার লায়েন নবায়নযোগ্য শক্তির কাতারে ফেললেও বাস্তবে এটি জীবাশ্ম জ্বালানি। এটি মাটির নিচ থেকেই উত্তোলন করা হয় এবং এমনভাবে ব্যবহার করা হয় যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক।
মার্চ মাসে দ্য ইকোনমিস্ট-এর সাসটেইনেবিলিটি সামিটে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস জীবাশ্ম জ্বালানিকে 'বুদ্ধুদের বিনিয়োগ' হিসেবে অভিহিত করে বিশ্বের দেশগুলোকে 'কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ক্রমশ কমিয়ে আনার গতি বাড়াতে' আহ্বান করেন।
অথচ বর্তমানে ইইউ কয়েক বিলিয়ন ইউরো জীবাশ্ম জ্বালানির অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করছে। এ বিনিয়োগ হয় একসময় অকেজো হয়ে যাবে অথবা রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে আরও বেশি ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে।
বাড়ছে এলএনজি'র ব্যবহার ও দাম
ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি সবচেয়ে বেশি গ্যাস ব্যবহার করে। এর পরে রয়েছে ইতালি, নেদারল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, ও ফ্রান্স। এ দেশগুলো বর্তমানে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করে অন্য উৎস থেকে ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
'রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইউরোপের এলএনজি আমদানি ৫৮ শতাংশ বেড়েছে। এর ফলে জার্মানি, গ্রিস, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, পোল্যান্ড ইত্যাদি দেশগুলো এলএনজি'র জন্য নতুন নতুন অবকাঠামো গড়ে তুলছে,' বলেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমোডিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসেস (আইসিআইএস)-এর গ্যাস বিশেষজ্ঞ পলা ডি মাত্তিয়া।
এসব বিনিয়োগের ফলে ইউরোপের 'রিগ্যাসিফিকেশন' (তরল গ্যাসকে তাপ দিয়ে প্রাকৃতিক গ্যাসে পরিণত করা) সক্ষমতা বেড়ে বছরে ৭০ বিলিয়ন ঘনমিটারে দাঁড়াবে।
রিগ্যাসিফিকেশন প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজন হয় টার্মিনালের। ইইউ'র সরকারগুলো এখন উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত এলএনজি টার্মিনারগুলোতে বড় পরিমাণে বিনিয়োগ করছে। বর্তমানে উত্তর সাগর ও বাল্টিক সাগরে ইইউ'র গ্যাসের চাহিদা পূরণ করার জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক টার্মিনাল নেই।
'চলমান সংকটকাল'
২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু-নিরপেক্ষ পৃথিবী তৈরি করতে চায় জাতিসংঘ। অন্যদিকে জার্মানি জানিয়েছিল দেশটি ২০৪৫ সালের মধ্যেই এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়। কিন্তু ইইউ এলএনজি ব্যবহার আরও বাড়ালে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণও বাড়বে।
'আমাদের এখন একটি আপৎকালীন মুহূর্ত চলছে,' বলেন ইউরোপিয়ান এনার্জি রিসার্স অ্যালায়েন্স (ইইআরএ)-এর নবায়নযোগ্য শক্তি বিষয়ক গবেষক গানা গ্ল্যাডকিখ।
'ইইউ সব প্রতিশ্রুতির বিপরীতে এখন কয়েক বিলিয়ন ইউরো গ্যাস অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করছে। এলএনজিতে এবং বিশেষত ইউরোপে এলএনজিতে বিনিয়োগ করার এখন কোনো মানেই হয় না,' বলেন গ্ল্যাডকিখ।
ব্যয়বহুল হাইড্রোজেনের আশা
জলবায়ুবান্ধব উপায়ে গ্যাস উৎপাদন করার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো জলবায়ু সমস্যাকে লঘু করা। এজন্য জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে অ্যামোনিয়া ও বিশেষত তরল হাইড্রোজেন উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
এরকমটা হলে বিদ্যমান ট্যাংকার, টার্মিনাল, ও পাইপলাইনগুলোকে নতুন ধরনের জ্বালানি পরিবহনের উপযোগী করে তুলতে হবে। আর এ পরিবর্তনকে অনেকে সন্দেহের চোখে দেখছেন।
'তারা (সরকারগুলো) তাদের বিদ্যমান স্থাপনাগুলোকে হাইড্রোজেন জ্বালানির জন্য প্রস্তুত দাবি করে স্রেফ জনগণকে আশ্বাস প্রদান করছে,' গ্ল্যাডকিখ বলেন।
হাইড্রোজেন আরও বেশি বিস্ফোরক পদার্থ বলে এটি বর্তমানে প্রচলিত বেশিরভাগ জ্বালানির তুলনায় বিপজ্জনক। হাইড্রোজেনকে জ্বালানিতে পরিবর্তন করতে হলে প্রয়োজন বাড়তি বিনিয়োগের। তাই হাইড্রোজেনকে জ্বালানি হিসেবে গ্রহণ করার প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি সুনিশ্চিত নয়।
ইন্টারন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি এজেন্সির অনুমান, হাইড্রোজেন জ্বালানির জন্য পাম্প, ভালভ, যন্ত্রাংশ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইত্যাদি স্থাপনের জন্য এলএনজি প্ল্যান্ট স্থাপনের খরচের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি খরচ হতে পারে। বর্তমানে যেসব ট্যাংকার ও টার্মিনাল এলএনজি পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, এগুলো দিয়ে হাইড্রোজেনের কাজ চালানো যাবে না।
অন্যদিকে সব হাইড্রোজেন বায়ু বা সৌরশক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন করতে হবে। আর এ কাজ করার জন্যও ইউরোপের পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই।
এলএনজি'র জন্য বর্তমানে এত বিনিয়োগ করার ফলে ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য এ বিনিয়োগ থেকে মুখ ফেরাতে চাইবে না ইউরোপের দেশগুলো; এমনটাই আশঙ্কা করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
পাইপলাইন বনাম এলএনজি: জলবায়ুর ক্ষতি কিসে বেশি?
রাশিয়া এর পাইপলাইন ব্যবহার করে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করে। কিন্তু কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস ইউরোপে স্থানান্তর করার আগে তরলীকৃত করে নিতে হয়। এ জন্য এ গ্যাসকে প্রথমে চাপ দিয়ে সংকুচিত করে পরে চাপ কমানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় ৮-২৫ শতাংশ পর্যন্ত শক্তি অপচিত হয়।
এরপর এই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসকে সমুদ্রপথে জাহাজে করে পরিবহন করা হয়। যাত্রাপথ যত বেশি দীর্ঘ হয়, তত বেশি কার্বন ফুটপ্রিন্ট তৈরি হয়।
রাশিয়ার ইউরোপের গ্যাসের বাজার রাজনৈতিক কারণে ক্রমশ ছোট হবে। ক্রেমলিনকে হয়তো তাদের মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের পাইপলাইনের কথা ভুলে গিয়ে এলএনজি প্ল্যান্ট ও টার্মিনাল তৈরির দিকে নজর দিতে হবে। কারণ ইউরোপের বাজার হ্রাস পেলে দেশটিকে চীন বা জাপানের মতো দেশে গ্যাস বিক্রি করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পর্যাপ্ত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের গ্যাসের চাহিদা কমিয়ে আগামী 'এক থেকে চার বছরের মধ্যে' রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা সম্পূর্ণভাবে দূর করতে পারবে।
এসব পরিকল্পনার মধ্যে আছে ইউরোপীয় কমিশনের 'ফিট ফর ৫৫' পরিকল্পনা অনুসরণ; হিট পাম্প, ইনসুলেশন ও নবায়নযোগ্য শক্তির পরিধি বাড়ানো এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অবশিষ্ট গ্যাস আমদানি।