শিল্পখাতে এক বছরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ
দেশের শিল্পখাতে এক বছরে কাঁচামাল ও অন্যান্য মূলধনী দ্রব্যের ব্যয় ১৩ থেকে ১৭ শতাংশ বৃদ্ধির সুবাদে শস্য প্রক্রিয়াকরণ, লোহা ও ইস্পাত, দুগ্ধজাত পণ্য, চিনি, পশুখাদ্য, পরিবহন সরঞ্জাম, মোটর সাইকেল, খাদ্য পণ্য, মৌলিক ধাতু, কাঠের আসবাবপত্র, ফল ও শাকসবজি প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ খাতে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় বেড়েছে।
পাশাপাশি উৎপাদনে ব্যবহৃত মধ্যবর্তী দ্রব্য ও মধ্যবর্তী মূলধনী দ্রব্যের ব্যয় প্রায় ৮ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক বছরে প্রথমবারের মতো সংকুচিত হয়েছে দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি উৎপাদন খাত।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রকাশিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাকশন স্ট্যাটিস্টিকস (আইপিএস) বলছে, সেপ্টেম্বর মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মিডিয়াম অ্যান্ড লার্জ স্কেল ম্যানুফেকচারিং ইন্ডাস্ট্রির কোয়ান্টাম ইন্ডেক্সের পয়েন্টস ১০.২৮ বা ২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ কমেছে।
কয়েক বছর ধরে এই সূচকে বছরে ১৪ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হলেও করোনা মহামারির প্রথম বছর ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার দেড় শতাংশে নেমে আসে। ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারা কাটিয়ে এই প্রথমবারের মতো কমছে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের উৎপাদন।
অর্থনীতিবিদ ও শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে শক্তি ও জ্বালানিসহ সব ধরনের উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে শিল্পখাতের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। একই সঙ্গে বিদ্যুতের সরবরাহের কারণে উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার কারণেও ব্যয় বেড়ে গেছে। আবার পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদাও কমে এসেছে। এর ফলে শিল্পখাতের উৎপাদনও কমেছে বলে তারা মন্তব্য করেন।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে পাট পণ্যের উৎপাদন হয়েছিল ৫১ হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ কমে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৬০০ মেট্রিক টনে। একই সঙ্গে সুতার উৎপাদন ৬৮ হাজার ৩৪৩ মেট্রিক টন থেকে তিন দশমিক ৫৫ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৯১৯ মেট্রিক টনে।
একই সময়ে সারের উৎপাদন প্রায় চার দশমিক ১২ শতাংশ কমে দুই লাখ ২৬ হাজার ৬২৬ টনে নেমে এসেছে। দুই দশমিক ০৫ শতাংশ কমে পেট্রোলিয়াম পণ্যের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৮২ হাজার ৬২৮ মেট্রিক টনে।
অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ভোজ্যতেলের উৎপাদন প্রায় ১৬ শতাংশ, সাবান ও ডিটারজেন্ট খাতে প্রায় ১৭ শতাংশ এবং চায়ের উৎপাদন ৭ শতাংশের বেশি পরিমাণে কমেছে।
যদিও টাকার অঙ্কে হিসাব করা পণ্যগুলোর উৎপাদনের পরিমাণ যথেষ্ট বেড়েছে বলে প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বছরের প্রথম প্রান্তিকে পোশাক শিল্প উৎপাদন ৩৩ হাজার ১০১ কোটি ৯০ লাখ টাকা থেকে ৩২ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৮৩৯ কোটি ৯০ লাখ টাকায়।
একই সময়ে নিটওয়্যারের উৎপাদন ৪৩ হাজার ৮৮০ কোটি ৫০ লাখ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৫৫০ কোটি ৬০ লাখ টাকায়। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২ দশমিক ০৪ শতাংশ। একই সময়ে ড্রাগস অ্যান্ড ফার্মাসিউতিক্যালস খাতে উৎপাদনের মূল্য বেড়েছে ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ।
উৎপাদন সূচক কমেছে ৯ খাতে
মোট ২২টি খাতে মিডিয়াম ও লার্জ স্কেল ম্যানুফ্যাকচারিং উৎপাদন সূচকের হিসাব করে থাকে পরিসংখ্যান ব্যুরো। এর মধ্যে ৯টি খাতের সূচক কমেছে, আর বেড়েছে ১৩টির। এর মধ্যে কেমিক্যাল ও কেমিক্যালজাত পণ্য, কম্পিউটার, ইলেকট্রনিকস, অপটিক্যাল প্রডাক্টস ও ট্রান্সপোর্ট ইকুইপমেন্ট খাতে উৎপাদন সূচক কমেছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের মত।
একই সময়ে খাদ্যপণ্য খাতে উৎপাদন সূচক ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ, মেশিন ছাড়া গড়া ধাতব পণ্য খাতে ১৩ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং বেভারেজ খাতে উৎপাদন সূচক ১৮ শতাংশ কমেছে।
কাগজ ও কাগজ পণ্য খাতে উৎপাদন সূচক ৯২ দশমিক ৭১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও পুরো ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে এর অবদান মাত্র শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ। তবে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে চার দশমিক চার শতাংশ অবদান রাখা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ২৬ দশমিক ০৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মোটর যানবাহন, ট্রেইলার ও সেমি-ট্রেইলার এবং মেশিন ও ইকুইপমেন্ট খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও এই দুই খাতের অবদান পুরো ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের আধা শতাংশের কম।
যেভাবে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়
আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রকাশিত পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রডিউসার প্রাইজ ইনডেক্স (পিপিআই) প্রতিবেদনে স্থান পাওয়া ৮৮ পণ্যের মধ্যে ৭০টির উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। অপর ছয়টির ব্যয় কমে আসার বিপরীতে অপরিবর্তিত আছে ১২টির উৎপাদন ব্যয় সূচক।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পশুখাদ্যের দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে দুগ্ধজাত পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
একই সঙ্গে শস্য প্রক্রিয়াকরণ খরচ ৩৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে, চিনি উৎপাদনের ব্যয়ও বেড়েছে ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সব মিলে খাদ্য পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ২১ দশমিক ১৩ শতাংশের মত।
প্রধান শিল্প পণ্যের মধ্যে আইরন ও স্টিল মিলের উৎপাদন ব্যয় ৩১ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে। ২১ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেড়েছে মোটর সাইকেলের উৎপাদন ব্যয়। একই হারে অন্যান্য পরিবহন যন্ত্রাংশের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. মঞ্জুর হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'করোনায় সরবরাহ চেইনের ব্যাঘাতের কারণে অনেক পণ্যের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছিল। আর এর প্রভাব থেকে পুনরুদ্ধারের আগেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধে উপকরণের দাম বৃদ্ধি, ডলার ও মূদ্রার বিনিময় হার সংক্রান্ত কারণে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়েছে। এই সংক্রান্ত কারণে উৎপাদনের ব্যয় অনেকটা যেমন বেড়েছে, ক্ষেত্র বিশেষে উৎপাদনও কমেছে'।
এ অবস্থায় পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে বাস্তব পরিস্থিতিই উঠে এসেছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও বলেন, বাড়তি দামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মানুষের আয় না বাড়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদাও হয়তো কিছুটা কমেছে।
আগামীতে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ উপকরণের সরবরাহ ঠিক না হলে এই পরিস্থিতির অবনতি হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে আসার পাশাপাশি মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান ধরে রাখাও কঠিন হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
ইসরাক স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক টিবিএসকে বলেন, 'গ্যাস সরবরাহ সংকট এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাহিদা কমে যাওয়াই চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সুতা উৎপাদন কমে যাওয়ার প্রধান কারণ'।
তিনি বলেন, 'বর্তমানে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি ও ক্রয়াদেশের উন্নতির কারণে চাহিদা বাড়ছে, তবে এখনও তা যথেষ্ট নয়'।
পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী রাশেদুল করিম মুন্না মনে করেন, পাটজাত পণ্য উৎপাদনের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। শুধু তাই নয় চাহিদা কমার কারণে আগামী তিন মাসে উৎপাদনও কমতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দেশের অন্যতম বৃহৎ পাট পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুন্না টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত পাটজাত পণ্যের ৬৭ শতাংশ সুতা, যার বেশিরভাগই ইরান ও তুরস্কে পাঠানো হয়। কিন্তু যুদ্ধের কারণে এই পণ্যের চাহিদা কমেছে। ফলে আমরা পাটের সুতা এবং অন্যান্য পাটপণ্যের প্রত্যাশিত অর্ডার পাইনি'।
'কিছুদিনের মধ্যে যদি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তাহলে পাটজাত পণ্য উৎপাদন বড় সংকটে পড়বে,' বলেন তিনি।