বছরে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার যাতায়াত সময়, যানবাহন পরিচালনার ব্যয় সাশ্রয় করবে মেট্রোরেল লাইন-৬
সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে মেট্রোরেলে ৪০ মিনিটেই যাওয়া যাবে রাজধানীর মতিঝিল থেকে উত্তরায়। যাত্রাপথে ট্রেন থামবে ১৪টি স্টেশনে। বর্তমানে সড়কপথে এই ২০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে লাগে অন্তত ২০৮ মিনিট সময়। এ হিসাবে পুরো রুটে যাত্রীদের সময় বাঁচবে ১৬৮ মিনিট।
মেট্রোরেল প্রকল্পে অর্থায়ককারী– জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকার) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা শহরে যে হারে জনসংখ্যা ও মানুষের চাপ বাড়ছে, ২০২৫ সাল নাগাদ এই পথে চলাচল করতে লাগবে ৪৪৬ মিনিট। কিন্তু, দৈনিক প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মেট্রোরেলে চলাচল করলে, এবং লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সড়কে প্রাইভেট কার ও অন্যান্য যানবাহনের সংখ্যা কমিয়ে আনা গেলে, এই সময় ১৬৪ মিনিটে নামবে।
এভাবেই ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় মেট্রোরেলের সংযোজন অন্যান্য বাহনের যাত্রীদেরও উপকৃত করবে।
মেট্রোরেলের মালিকানা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের তথ্যমতে, এমআরটি-৬ লাইন চালু হলে, দৈনিক যাতায়াতে যে যাত্রা সময় বাঁচবে তার আর্থিকমূল্য ৮.৩৮ কোটি টাকা। একইসঙ্গে, অন্যান্য যানবাহন পরিচালনার দৈনিক ব্যয় কমবে ১.১৮ কোটি টাকা।
এই হিসাবে, এমআরটি-৬ চালুর পর এই দুই খাতে বার্ষিক ব্যয় সাশ্রয় হবে ৩ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকারও বেশি।
কোম্পানিটি আরও দাবি করছে যে, বিদ্যুৎচালিত মেট্রোরেল সেবা চালু হলে– তরল জ্বালানি ও গ্যাসে চালিত যানবাহনের সংখ্যাও কমবে সড়কে। এতে বার্ষিক কার্বন নিঃসরণ কমবে দুই লাখ টনেরও বেশি।
রাজধানীতে যানবাহনের গড় গতি নেমে আসছে পায়ে চলার গতির কাছাকাছি, এই অবস্থায় ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংক সমর্থিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি)-তে রাজধানীতে যান চলাচলে গতি আনতে মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের সুপারিশ করা হয়।
'যাত্রী বহনের মাধ্যমে সময় ও পরিবেশের সুরক্ষা' এই মূলমন্ত্রকে পুঁজি করে ২০১২ সালে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি এমআরটি-৬ লাইন বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে। ২০৩০ সাল নাগাদ মোট ১২৭.৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের সময়-নির্ধারিত পরিকল্পনা নিয়েছে সরকারি সংস্থাটি।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকায় যানজট উল্লেখযোগ্য হারে কমবে। এতে উন্নত হবে ব্যবসাবাণিজ্যের পরিবেশ, বিনিয়োগও বাড়বে। এতে মানুষের আয় ও কর্মসংস্থানেও যুক্ত হবে ইতিবাচক প্রভাব।
২০১৫ সালে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি)-তে বলা হয়, ঢাকা শহরে দৈনিক ৩.৫৯ কোটি ট্রিপের চাহিদা আছে, তবে ২০২৫ সাল নাগাদ এই চাহিদা বেড়ে হবে ৬.৫৫ কোটি।
উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোলাইন মোট ট্রিপ চাহিদার ০.৮ শতাংশ বহন করবে। ফলে, বাসযাত্রীর সংখ্যা ২.০৬ কোটি থেকে নেমে আসবে ১.৮১ কোটিতে। একইসময়, সিএনজি চালিত যানের আরোহী ৬৬ লাখ থেকে কমে হবে ৬০ লাখ। তবে মেট্রোরেল স্টেশনে যাওয়ার জন্য রিক্সাযাত্রীর সংখ্যা সামান্য বাড়বে বলে আরএসটিপিতে উল্লেখ করা হয়।
সমীক্ষার ফলাফল অনুসারে, ঢাকায় ছয়টি মেট্রোলাইন চালু হলে, দৈনিক ৫০ লাখ মানুষ মেট্রো ট্রেনে যাতায়াত করবে, যা ২০৩৫ সাল নাগাদ প্রক্ষেপিত ট্রিপের ১১.৫২ শতাংশ।
ফলে এ সময়ে বাস ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৫.১৩ শতাংশ থেকে কমে ৩৬.৮২ শতাংশে ও পায়ে হেঁটে যাতায়াতকারীর সংখ্যা ৩০ শতাংশ থেকে কমে ২৫ শতাংশে নেমে আসবে।
ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানির তথ্য অনুসারে, এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পটিতে ২,০০০ তরুণ প্রকৌশলীকে নিয়োগ দেওয়া হবে। সবগুলো লাইনের জন্য দরকার হবে ১২,০০০ প্রকৌশলী। এর পাশাপাশি ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ সেক্টরে আরও একাধিকবার কর্মী নেওয়া হবে।
এছাড়াও মেট্রো রেলের সুবাদে যদি জীবাশ্ম জ্বালানিতে চলা ছোট গাড়িগুলোর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বর্জ্যের পরিমাণও অনেক কমে যাবে। সব মিলিয়ে এ প্রকল্পের মাধ্যমে জিডিপি'র এক শতাংশের বেশি সঞ্চিত হবে।
ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম. এ. এন. সিদ্দিক বলেন, মেট্রো রেলের কাজ শুরু হওয়ার সময় উত্তরা ফেজ-৩ এলাকায় মানুষের বসবাস ছিল খুবই কম। অবকাঠামো নির্মাণ শুরু হওয়ার পর থেকে এ এলাকায় স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বসবাসের হারও ক্রমশ বাড়ছে বলে যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, ছয়টি মেট্রো রেল নির্মাণে বিশাল পরিমাণে বিশেষায়িত বৈদ্যুতিক তারের প্রয়োজন হয়েছে। যদিও এ উপাদানগুলো দীর্ঘসময় ধরে বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছে, বর্তমানে স্থানীয় একটি কোম্পানি এ খাতে বিনিয়োগ করতে চায়।
মেট্রো রেলকে লক্ষ্য করে সিমেন্ট ও ইস্পাত উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ছে বলেও জানান তিনি।